আল-কুরআন ও আল-হাদীসে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের সত্তা, গুণাবলী, কুদরাত ও অধিকার সম্পর্কে অনেক কথা ছড়িয়ে আছে। সেই কথাগুলোর নিরিখে অতি সংক্ষেপে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরার উদ্দেশ্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
আল্লাহর পরিচয়
আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়।
আল্লাহর আব্বা নেই, আম্মা নেই।
আল্লাহর স্ত্রী নেই, পুত্র নেই, কন্যা নেই।
আল্লাহ তখনো ছিলেন যখন আর কেউ ছিলো না, আর কিছু ছিলো না।।
আল্লাহ তখনো থাকবেন যখন আর কেউ থাকবে না, আর কিছু থাকবে না।
অর্থাৎ আল্লাহ চিরকাল ছিলেন, চিরকাল আছেন, চিরকাল থাকবেন।
আল্লাহ ধ্বংসের ঊর্ধ্বে।
আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই ধ্বংসশীল।
আল্লাহর ক্ষুধা নেই, পিপাসা নেই।
আল্লাহ কিছু খান না।
আল্লাহ কিছু পান করেন না।
আল্লাহর তন্দ্রা নেই, নিদ্রা নেই।
আল্লাহ অন্যমনস্ক হন না।
আল্লাহ কিছু ভুলে যান না।
আল্লাহকে কোন সৃষ্টি দেখতে পায় না।
কিন্তু সকল কিছু তাঁর দৃষ্টির অধীন।
আল্লাহর দৃষ্টির বাইরে কোন কিছুই থাকা সম্ভব নয়।
আল্লাহ একই সময়ে মহাবিশ্বের সকল প্রাণী, বস্তু ও শক্তি (energy) দেখতে পান।
আল্লাহ সব কিছুই শুনেন।
মহাবিশ্বের সর্বত্র উচ্চারিত প্রতিটি কথা ও উত্থিত প্রতিটি আওয়াজ তিনি একই সময়ে শুনতে পান।
আল্লাহ একচ্ছত্র সম্রাট।
মহাবিশ্ব আল্লাহর সাম্রাজ্য।
এই সাম্রাজ্যের মালিকানায় ও পরিচালনায় তাঁর কোন অংশীদার নেই।
আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন।
প্রতিটি প্রাণী, বস্তু ও শক্তি (বহবৎমু) অস্তিত্ব লাভের জন্য ও টিকে থাকার জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী।
আল্লাহ সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
মহাবিশ্বের সর্বত্র তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত।
আল্লাহ মহাজ্ঞানী।
আল্লাহর জ্ঞান সীমাহীন।
আল্লাহ সর্ব শক্তিমান।
আল্লাহর শক্তি সীমাহীন।
আল্লাহ সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা।
আল্লাহর সৃষ্টি-ক্ষমতার শেষ নেই।
আল্লাহ জীবন দেন।
আল্লাহ মৃত্যু দেন।
আল্লাহ জীবিত থেকে মৃতকে এবং মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন।
আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো ওপর বিপদ-মুছীবাত আসতে পারে না।
আল্লাহর ক্ষমতা অ-প্রতিরোধ্য।
আল্লাহ যদি কারো কল্যাণ করতে চান তাতে বাধ সাধবার শক্তি কারো নেই।
আল্লাহ যদি কারো অ-কল্যাণ করতে চান তা প্রতিরোধ করার শক্তি কারো নেই।
আল্লাহ সর্ব-বিজয়ী, মহা পরাক্রমশালী।
আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী।
আল্লাহ মহাবিজ্ঞ।
আল্লাহ পরম দয়ালু, করুণাময়।
আল্লাহ শাস্তি দাতাও।
আল্লাহর পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন।
আল্লাহ সার্বভৌম সত্তা।
আদেশ-নিষেধের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র তাঁর।
আল্লাহর বিধানই চূড়ান্ত আইন।
আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন।
আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই সৃষ্টি করতে পারেন, করেন।
আল্লাহ কোন কিছু সৃষ্টি করতে চাইলে বলেন “হও”, আর অমনি তা হয়ে যায়।
আল্লাহ শূন্য থেকে বা অনস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি করতে পারেন।
আল্লাহ যা করেন তার জন্য কারো কাছে জওয়াবদিহি করতে হয় না।
অন্য সবাইকে তাঁর নিকট জওয়াবদিহি করতে হয়।
আল্লাহ সকল মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ সকল যৌগিক পদার্থ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ মহাবিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুর স্রষ্টা।
তিনি শ্রেণী মতো পরমাণুগুলোকে সংযুক্ত কিংবা সংমিশ্রিত করে বিভিন্ন
বস্তুসত্তার অস্তিত্ব গড়ে তোলেন।
আল্লাহ প্রথমে আসমান ও পৃথিবীকে যুক্ত অবস্থায় সৃষ্টি করেন, পরে এইগুলোকে পৃথক করে দেন।
আল্লাহ সময়ের ছয়টি অধ্যায়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে আরশে সমাসীন হয়েছেন।
আল্লাহ মহাবিশ্বকে সাতটি স্তর বা অঞ্চলে বিন্যস্ত করেছেন।
আল্লাহর নির্দেশেই আসমান ও পৃথিবী সু-প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
আল্লাহ মহাকর্ষ বল (Gravitation) সৃষ্টি করে এর দ্বারা মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন।
আল্লাহ মহাবিশ্বের সকল কিছুর আকার, আয়তন ও গতিপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করে প্রত্যেকটিকে তার করণীয় জানিয়ে দিয়েছেন।
আসমান ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর ফরমানের অধীন।
আল্লাহ সূর্য ও চাঁদকে এমন নিয়মের অধীন করে রেখেছেন যার ফলে পৃথিবীতে একের পর এক বিভিন্ন ঋতুর আবির্ভাব ঘটে, রাত দিনের আবর্তন ঘটে এবং মানুষ মাস ও বছরের হিসাব রাখতে পারে।
আল্লাহ আলো সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ আঁধার সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ ছায়া সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ পৃথিবী-পৃষ্ঠে পাহাড়-পর্বত গেড়ে দিয়েছেন যাতে পৃথিবী আপন পথে চলতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে হেলে দুলে না পড়ে।
আল্লাহ ভূ-পৃষ্ঠকে বাসোপযোগী ও আবাদযোগ্য বানিয়েছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর চারদিকে বায়ুর একটি পুরু বেষ্টনী সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ ঘনীভূত অক্সিজেনময় ওজোন (ozone) স্তর সৃষ্টি করে তেজষ্ক্রিয় মহাজাগতিক রশ্মিকে ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছতে বাধাগ্রস্ত করেছেন।
আল্লাহ পৃথিবীকে মাটি সম্পদ, বন-সম্পদ, ঘাস-সম্পদ, উদ্ভিদ সম্পদ, লতা-গুল্ম সম্পদ, পানি সম্পদ, সামুদ্রিক উদ্ভিদ সম্পদ, মাছ সম্পদ, পাখি সম্পদ, পশু সম্পদ, তাপ-বিদ্যুৎ সম্পদ, খনিজ-সম্পদ ইত্যাদি সম্পদে ভরপুর করেছেন।
আল্লাহ মাটির গভীরে সোনা, রূপা, হীরা, লোহা, তামা, কয়লা, পেট্রোল, গ্যাস ইত্যাদি সম্পদ মওজুদ করে রেখেছেন।
আল্লাহ ভূ-পৃষ্ঠে গাছ-গাছালির খাদ্য হবার উপযোগী বহু জৈবিক উপাদান মওজুদ করে রেখেছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর মাটিকে শস্য ফলানো, শাক-সবজি ফলানো, গাছ জন্মানো ও নানা প্রকারের গাছে নানা আকারের নানা রঙের নানা স্বাদের ফল ফলানোর উপযোগী বানিয়েছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর বুকে নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগর সৃষ্টি করে সেইগুলোকে পানির রিজার্ভারে পরিণত করেছেন।
আল্লাহ নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরকে অফুরন্ত মাছ সম্পদে পরিপূর্ণ করেছেন।
আল্লাহ সাগর-মহাসাগরের গভীরে বিচিত্র ধরনের প্রাণী, মণি-মুক্তা, সৌন্দর্য-শোভার অন্যান্য উপকরণ ও সামুদ্রিক উদ্ভিদ মওজুদ করে রেখেছেন।
আল্লাহ পানি সৃষ্টি করেছেন এবং এটিকে যমীনকে সিক্ত করা, প্রাণীর পিপাসা মেটানো ও দানা-বীজকে অংকুরিত করার গুণ দান করেছেন।
আল্লাহ আগুন সৃষ্টি করেছেন এবং এটিকে তাপ ও আলো বিতরণের গুণ দান করেছেন।
আল্লাহ বিদ্যুৎ শক্তি সৃষ্টি করেছেন এবং এটিকে বিভিন্ন যন্ত্র চালানো ও বালবের ভেতর সঞ্চালিত হয়ে আলো ছড়ানোর গুণ দান করেছেন।
আল্লাহ পানি থেকে বাষ্প, বাষ্প থেকে মেঘ ও মেঘ থেকে বৃষ্টি সৃষ্টি করেন।
আল্লাহর নির্দেশে বায়ু প্রবাহিত হয়, বায়ুতে ভর করে মেঘ দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে ও মেঘ থেকে বৃষ্টি নামে।
আল্লাহ খাদ্য দ্রব্যে মানুষের দেহ পুষ্ট করার গুণ দান করেছেন।
আল্লাহ মধুসহ বিভিন্ন দ্রব্যে রোগ নিরাময়ের গুণ দান করেছেন।
আল্লাহ নূর থেকে ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে তাঁর অবাধ্যতা করার ক্ষমতা দেননি।
ফেরেশতারা আল্লাহর বিশ্বস্ত অনুগত কর্মচারী।
আল্লাহ আগুন থেকে জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ জিনদেরকে তাঁর আনুগত্য করার কিংবা অবাধ্যতা করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
আল্লাহ মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ মানুষদেরকে তাঁর আনুগত্য করার কিংবা অবাধ্যতা করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
আল্লাহ জিন ও মানুষদেরকে তাঁর আনুগত্য করার পুরস্কার ও অবাধ্যতা করার শাস্তি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ মানুষ, বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ ও বিদ্যুৎ কণা ইত্যাদির জুড়ি সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ প্রথম মানুষ আদম (আ) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া (রা) থেকে মানুষের বংশধারা চালু করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে পুরুষ ও নারী রূপে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরম প্রশান্তি লাভ করতে পারে এবং সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতির আসল দুর্গ পরিবার সংগঠন গড়ে তুলতে পারে।
আল্লাহ পুরুষকে দুর্ধর্ষতা, সাহসিকতা, ক্ষিপ্রতা ও কঠোরতার আধিক্য দান করেছেন।
আল্লাহ নারীকে নম্রতা, মায়া-মমতা ও সৌন্দর্যানুভূতির আধিক্য দান করেছেন।
আল্লাহ নির্দিষ্ট সংখ্যায় মানুষ ও নির্দিষ্ট পরিমাণে সম্পদ সৃষ্টি করে থাকেন।
আল্লাহ সকল মানুষ ও অন্যান্য সকল প্রাণীর রিয্কের ব্যবস্থা করে থাকেন।
আল্লাহ মানুষকে অভাবের আশংকায় সন্তান হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যা যা প্রয়োজন সবই সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর সম্পদ-সম্ভার মানুষের ভোগ-ব্যবহারের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর সৃষ্ট নিয়ামাতগুলো গণনা করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আল্লাহ কাউকে বেশি অর্থ-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন।
আল্লাহ কাউকে কম অর্থ-সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন।
আল্লাহই মানুষের আকৃতি, গায়ের রঙ, ভাষা, কণ্ঠস্বর, চলনভংগি ইত্যাদির পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ জীবকুলের মধ্যে মানুষকে সবচে’ বেশি জ্ঞান দান করেছেন। তবে জ্ঞানময় আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় এই জ্ঞান খুবই সামান্য।
আল্লাহ মানুষকে রূহ দান করেছেন।
আল্লাহ যদ্দিন রূহকে মানুষের মাঝে অবস্থান করতে দেন তদ্দিনই মানুষ জীবিত থাকে।
আল্লাহ মানুষকে মস্তিষ্ক দান করেছেন।
আল্লাহ এটিকে চিন্তা-ভাবনা করা, পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করা, বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা ও বহু কিছু উদ্ভাবন করার যোগ্যতা দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে হৃদপিণ্ড দান করেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে এটি ছন্দবদ্ধভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে দেহের সর্বত্র রক্ত-সঞ্চালনের কর্তব্য পালন করে।
আল্লাহ মানুষকে ফুসফুস দান করেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে এটি ছন্দময় প্রক্রিয়ায় রক্তে অক্সিজেন ঢুকানো ও রক্ত থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সরানোর কর্তব্য পালন করে।
আল্লাহ মানুষকে একজোড়া কিডনি দান করেছেন। এরা পানিকে পরিস্রুত করে রক্ত-রসে পরিণত করা ও অ-প্রয়োজনীয় পানিকে বের করে দেয়ার কর্তব্য পালন করে।
আল্লাহ মানুষকে পাকস্থলি দান করেছেন।
এটি আহার্য দ্রব্য হজম করে দেহ পরিপোষণের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।
আল্লাহ যকৃত (লিভার) দান করেছেন। এটি পিত্ত ক্ষরণ করে পিত্তথলিতে জমা রাখে ও বিশেষ বিশেষ খাদ্যকে পরিপাকের পর রক্ত স্রোতে পাঠানোর কর্তব্য পালন করে।
আল্লাহ গোটা দেহে বহু সংখ্যক হাড়, পেশী, কোষ, কলা, অন্ত্র, ঝিল্লি, গ্রন্থি ইত্যাদি দান করেছেন যেইগুলো দেহকে সজীব, সুস্থ, সবল রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মে বায়ু পাখিদেরকে উড়তে ও মানুষকে প্লেনে চড়ে দ্রুত দেশ-বিদেশে পৌঁছতে সাহায্য করে।
আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মে নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরের পানি জাহাজগুলোকে ভাসিয়ে রাখে যাতে মানুষ দূর দূর স্থানে পৌঁছতে ও মালসামগ্রী আমদানী-রফতানী করতে পারে।
আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মে বাষ্প বিভিন্ন মেশিনে শক্তি সঞ্চালন করে যাতে বিভিন্ন যানে চড়ে মানুষ দ্রুত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারে।
আল্লাহ মানুষকে চিন্তাশক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে দেখার শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে লেখার শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে কথা বলার শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে শুনার শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে ধরার শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে চলার শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদনের শক্তি দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও কর্ম-প্রচেষ্টার স্বাধীনতা দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দান করেছেন।
আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদাতের (উপাসনা-দাসত্ব-আদেশানুবর্তিতার) জন্য সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ একমাত্র মানুষকেই তাঁর খালীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে খিলাফাত (আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল শাসন) কায়েম করে পূর্ণাংগ ইবাদাতের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব দিয়েছেন।
আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ইসলাম।
আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান নির্ভুল, পূর্ণাংগ, ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণময়।
আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে এমন জীবন বিধান রচনা করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা মানুষের নিকট পেশ করেছেন।
আল্লাহ প্রথম মানুষ আদমকে (আ) প্রথম নবী বানিয়েছেন।
আল্লাহ যুগে যুগে বহু নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন যাতে তাঁরা মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত (উপাসনা-দাসত্ব-আদেশানুবর্তিতা) এবং তাগুতের (আল্লাহদ্রোহী শক্তির) বিরোধিতা করার শিক্ষা দেন।
আল্লাহ সর্বশেষে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি সর্বশেষ আসমানী কিতাব আলকুরআন নাযিল করেছেন।
আল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলকুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলকুরআনের প্রায়োগিক রূপ শিক্ষা দেবার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণকে তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার শর্ত বানিয়েছেন।
আল্লাহ মানুষকে খালীফার (প্রতিনিধির) মর্যাদা দেয়ায় হিংসা-কাতর ইবলীস ও তার অনুসারীরা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালাবার শপথ নেয়।
আল্লাহ ঘোষণা করেন যে যারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে চলবে ইবলীস ও তার অনুসারীরা তাদের ওপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।
আল্লাহ অলৌকিকভাবে কোন ভূ-খণ্ডে তাঁর জীবন বিধান চালু করেন না।
আল্লাহ জোর করে তাঁর জীবন বিধান কোন জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেন না।
আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যদি তারা তাদের চিন্তাধারা ও কর্মধারা পরিবর্তন না করে।
আল্লাহ চান, মানুষ স্বেচ্ছায় তাঁর দেয়া জীবন বিধান তাদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবনে কায়েম করুক।
আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্বশীল শাসন কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ শূরা বা পরামর্শ ভিত্তিক শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ যেই কোন মূল্যে সুবিচার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ অর্থ-সম্পদের অবাধ আবর্তন, সুষম বণ্টন ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সুদমুক্ত ও যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ ছালাত বা নামায কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ ছাউম বা রোযা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ বিত্তবানকে যাকাত দেবার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ বিত্তবানকে হাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তাঁর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ আব্বা-আম্মা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অপরাপর মানুষের সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ ওয়াদা-প্রতিশ্র“তি রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ আইনের দাবি ব্যতিরেকে কাউকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ আমানাতের খিয়ানাত করতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ মাপ ও ওজনে ঠকাতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ সুদ, ঘুষ, জুয়া ও মওজুদদারী নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ চুরি-ডাকাতি নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ অপব্যয়-অপচয় নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ যুল্ম-অত্যাচার নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ অহংকার নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ রিয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ গীবাত নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ অপবাদ নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ মিথ্যা কথা বলা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ গান-বাজনা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ সকল প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীল কাজ নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ প্রবৃত্তির আনুগত্য নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ আম্মা, দুধ মা, খালা, ফুফু, বোন, দুধ বোন, কন্যা, স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরশজাত কন্যা, ভাতিঝি, ভাগিনী, শ্বাশুড়ী, পুত্রবধূ, একত্রে দুই বোন, একত্রে ফুফু-ভাইঝি এবং একত্রে খালা-বোনঝিকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ মুশরিক নারীকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ সামাজিক পবিত্রতা ও সুস্থতার জন্য আল হিজাব বা পর্দার বিধান নাযিল করেছেন।
আল্লাহ মদ ও মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ শর নিক্ষেপ করে ভাগ্য গণনা নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ গণকের কথায় বিশ্বাস স্থাপন নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ মরা পশুর গোশত, শূকরের গোশত, রক্ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবাইকৃত পশু, কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আহত হয়ে ওপর থেকে পড়ে মৃত পশু, হিংস্র জন্তু কর্তৃক নিহত পশু এবং কোন বেদীতে উৎসর্গীকৃত পশুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ নখরযুক্ত ও হিংস্র জন্তু খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
আল্লাহ জ্ঞান অর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ আলকুরআনের আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ মহাবিশ্বকে নিয়ে চিন্তা-গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ হালাল জীবিকা অন্বেষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ একমাত্র তাঁকে ভয় করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ একমাত্র তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ সকল নেক কাজ একমাত্র তাঁর সন্তোষ হাছিলের অভিপ্রায়ে (নিয়াতে) সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ একনিষ্ঠভাবে তাঁর নির্দেশগুলো মেনে চলবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিহার করবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষের সকল ত্যাগ-কুরবানী একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত হবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষের মাথা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নত হবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ একমাত্র আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সাংঘর্ষিক কোন আনুগত্য মেনে নেবে না।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ আল্লাহকেই সবচে’ বেশি ভালোবাসবে।
এটা আল্লাহর অধিকার যে মানুষ তার প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্যই করবে।
যেই জনগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের নিরিখে তাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলে আল্লাহ তাদের জন্য আসমান ও পৃথিবীর বারাকাতের দুয়ার খুলে দেন।
অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে প্রভূত কল্যাণ, উন্নতি ও সমৃদ্ধি দান করেন।
আল্লাহ তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে উত্তম রিয্ক দান করেন।
আল্লাহ তাঁর না-ফরমান বান্দাদেরকে পেরেশানী-যুক্ত জীবিকা দেন।
আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও কর্ম-প্রচেষ্টার স্বাধীনতা দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন।
যেই ব্যক্তি আল্লাহর আদেশানুবর্তী জীবন যাপন করে সে কামিয়াব।
যেই ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে সে ব্যর্থ।
আল্লাহ নিজেই সকল মানুষের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছেন।
আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির সংগে দুইজন ফেরেশতাকে সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছেন।
আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা অবিরাম মানুষের সকল তৎপরতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে চলছেন।
আল্লাহ মানুষকে দুর্বল রূপে সৃষ্টি করেন, যৌবনে তাকে শক্তিমান করেন, বার্ধক্যে আবার তাকে দুর্বলতার শিকারে পরিণত করেন।
আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুক্ষণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। সেই নির্দিষ্ট ক্ষণেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতর লুকিয়েও মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
আল্লাহ বর্তমান মহাবিশ্বকে অনন্তকালের জন্য সৃষ্টি করেন নি।
আল্লাহ বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থাকে ভেংগে দেয়ার জন্য একটি দিন-ক্ষণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে সেই দিন অন্যতম ফেরেশতা ইসরাফীল (আ) তাঁর বিশাল শিংগায় ফুঁ দেবেন।
শিংগার আওয়াজ উত্থিত হওয়ার সংগে সংগে আসমান ও পৃথিবী থরথর করে কেঁপে উঠবে।
আল্লাহ যেই মহাকর্ষ বলের (Gravitation) দ্বারা মহাবিশ্বের সব কিছুকেই পরস্পর সম্পর্কিত রেখেছেন তা ছিন্ন করে দেবেন।
কোটি কোটি তারকা, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু ইত্যাদি সব কিছু ছিটকে পড়বে। পাহাড়-পর্বত টুকরো টুকরো হয়ে উড়তে থাকবে। সাগরগুলো উৎক্ষেপিত হবে।
আসমান, পৃথিবী ও এদের মধ্যকার সব কিছু ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে।
সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।
একমাত্র আল্লাহই বিদ্যমান থাকবেন।
অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে নতুন আকারে, নতুন বিন্যাসে মহাবিশ্ব অস্তিত
লাভ করবে।
আল্লাহর নির্দেশে বড়ো আকারে নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে।
নতুন পৃথিবী হবে এক বিশাল, সমতল, ধূসর প্রান্তর। ‘আলকাউসার’ নামে একটি জলাধার ছাড়া আর কিছু থাকবে না সেই সুবিস্তৃত ময়দানে।
আল্লাহর অনুগ্রহে আলকাউসারের পানি হবে দুধের মতো সাদা ও মিসকের চেয়েও বেশি সুগন্ধযুক্ত।
আল্লাহ প্রতিটি গলিত লাশের পরমাণুগুলোর কোনটি কোথায় অবস্থান করে একটি কিতাবে তার বিবরণ সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করেছেন।
আল্লাহ মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহ মাটিতেই মানুষকে ফিরিয়ে নেন।
আল্লাহ এই মাটি থেকেই মানুষকে জীবিত করে উঠাবেন।
আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফীল (আ) আবার শিংগায় ফুঁ দেবেন।
আল্লাহর নির্দেশে সকল মানুষ জীবিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে এবং বিস্ময়ভরা চোখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকবে।
আল্লাহর নূর পৃথিবীময় ঝলমল করতে থাকবে।
প্রচণ্ড উত্তাপে ও আতংকে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়বে।
আল্লাহর অনুগত বান্দারা ‘আলকাউসারের’ সুমিষ্ট ও শীতল পানি পান করে পিপাসা দূর করবে। যারা দুনিয়ায় আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে তাদেরকে আলকাউসারের’ কাছে ঘেঁষতে দেয়া হবে না।
আল্লাহর আদালতে সারিবদ্ধভাবে মানুষ দাঁড়িয়ে যাবে।
একদিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাবেন ফেরেশতারা।
আল্লাহর নির্দেশে যেইসব ফেরেশতা মানুষের তৎপরতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁরা তা পেশ করবেন।
আল্লাহর নির্দেশে প্রত্যেকের হাতে প্রত্যেকের আমলনামা তুলে দেয়া হবে।
আল্লাহর অনুগত বান্দারা ডান হাতে তাদের আমলনামা গ্রহণ করবে।
আল্লাহর অবাধ্য বান্দারা হাত পেছনে নিয়ে গেলেও আমলনামা হাতে নিতে
বাধ্য হবে।
আল্লাহ ঘোষণা করবেন : ‘তোমার আমলনামা পড়’।
প্রত্যেক ব্যক্তি দেখতে পাবে তার কৃত প্রতিটি কাজের বিবরণ নিখুঁতভাবে নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
আল্লাহ মানুষকে তার জীবনকাল সে কিভাবে কাটিয়েছে সেই সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহ মানুষকে তার দেহসত্তায় যেইসব শক্তি দান করেছেন সেইগুলোর ব্যবহার (ঁংব) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহ মানুষকে যেই জ্ঞান দান করেছেন তার ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহ মানুষকে যেইসব অর্থ-সম্পদ দান করেছেন তার ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহ মানুষকে যেইসব ক্ষমতা-ইখতিয়ার দিয়েছেন সেইগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহ মানুষকে যেইসব আদেশ-নিষেধ করেছেন সেইগুলোর পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহ মানুষকে অপরাপর মানুষের তত্ত্বাবধান করার যেই দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
আল্লাহর নির্দেশে মানুষের হাত ও পা সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে কোন্ কোন্ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
আল্লাহর নির্দেশে মানুষের জিহ্বা, কান, চোখ ও ত্বক সাক্ষ্য দেবে তাদেরকে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।
আল্লাহর নির্দেশে মানুষের অন্তর সাক্ষ্য দেবে কখন কোন্ চিন্তা তার মাঝে লালিত হয়েছে।
মানুষের দুনিয়ার জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর আল্লাহ যাদেরকে শাস্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেবেন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেবেন।
আল্লাহ যাদেরকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নেবেন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করার নির্দেশ দেবেন।
আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ তাঁর কাছে কারো মুক্তির জন্য শাফাআত বা সুপারিশ করতে পারবেন না।
আল্লাহ যাঁকে শাফাআত করার অনুমতি দেবেন তিনি কেবল ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে শাফাআত করতে পারবেন যার জন্য শাফাআত করার অনুমতি দেয়া হবে।
আল্লাহর অনুমতিক্রমে নবী-রাসূল, শহীদ ও তাঁর অন্যান্য প্রিয় বান্দারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য শাফাআত করলে আল্লাহ অনুগ্রহ করে তা কবুল করবেন এবং তাদের মুক্তির নির্দেশ দেবেন।
এক পর্যায়ে জাহান্নামীরা প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী আদমের (আ) নিকট জড়ো হয়ে তাদের মুক্তির জন্য শাফাআত করার অনুরোধ জানাবে। তিনি অপারগতা প্রকাশ করবেন।
তারা ছুটে যাবে নূহের (আ) কাছে। তিনিও অপারগতা প্রকাশ করবেন।
তারা ছুটে যাবে ইবরাহীমের (আ) কাছে। তিনিও অপারগতা প্রকাশ করবেন।
তারা ছুটে যাবে মূসা ইবনু ইমরানের (আ) কাছে। তিনিও অপারগতা প্রকাশ করবেন।
তারা ছুটে যাবে ঈসা ইবনু মারইয়ামের (আ) কাছে। তিনিও অপারগতা প্রকাশ করবেন।
তারা ছুটে যাবে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে।
তিনি সাজদায় পড়ে আল্লাহর তাসবীহ করতে থাকবেন।
আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন ততক্ষণ তিনি সাজদারত থাকবেন।
আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনি একদল লোকের নাজাতের জন্য শাফাআত করবেন।
আল্লাহ অনুগ্রহ করে তাঁর শাফাআত কবুল করবেন।
আল্লাহর নির্দেশে তিনি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো কিছু লোকের জন্য শাফাআত করার অনুমতি লাভের জন্য আবার সাজদায় লুটিয়ে পড়বেন।
আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন ততক্ষণ তিনি সাজদায় থাকবেন।
আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনি আরো একদল লোকের জন্য শাফাআত করবেন।
আল্লাহ অনুগ্রহ করে তাঁর শাফাআত কবুল করবেন।
আল্লাহর নির্দেশে তিনি সেই লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারবার সাজদারত হয়ে শাফাআতের অনুমতি চাইতে থাকবেন। আল্লাহ অনুগ্রহ করে তাঁকে একের পর এক বহু সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনার অনুমতি দেবেন।
আল্লাহ সর্বশেষে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের অন্তরে সরিষার বীজের পরিমাণ ঈমান আছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনার অনুমতি দেবেন।
জাহান্নামীরা জাহান্নামে ও জান্নাতীরা জান্নাতে অবস্থান গ্রহণের পর একজন ফেরেশতা মধ্যবর্তী স্থান থেকে ঘোষণা করবেন : ‘ওহে জাহান্নামীরা, আর মৃত্যু নেই। ওহে জান্নাতীরা, আর মৃত্যু নেই। সামনে অনন্ত জীবন।’জাহান্নাম কঠিন শাস্তির স্থান।
আল্লাহ ভয়ংকর আকৃতির ফেরেশতাদেরকে জাহান্নামীদের শাস্তির জন্য নিযুক্ত করে রেখেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা অপরাধীদেরকে গলায় বেড়ি ও দেহে লোহার শিকল পেঁচিয়ে টেনে হেঁচড়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে।
জাহান্নামীদেরকে আলকাতরার পোশাক পরানো হবে।
আল্লাহ দুনিয়ার আগুনের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি তেজযুক্ত আগুন দিয়ে জাহান্নাম ভরে রেখেছেন।
ঘন শ্বাসরুদ্ধকর ঝাঁঝালো কষ্টদায়ক ধোঁয়া জাহান্নামে আবর্তিত হতে থাকবে।
আল্লাহ জাহান্নামের বিভিন্ন অংশ বিশাল আকৃতির ভয়ংকর বিষধর সাপ দিয়ে ভর্তি করে রেখেছেন।
আল্লাহ জাহান্নামীদের দেহকে বিশাল আকৃতি দেবেন।
ফেরেশতারা ভারী গুর্জ দিয়ে আঘাত হেনে জাহান্নামীদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবেন।
জাহান্নামীরা ভীষণ চিৎকার করতে থাকবে।
আগুনের উত্তাপে ও পিপাসায় তারা হাঁপাতে থাকবে।
জাহান্নামীদেরকে তাদের দেহ-নির্গত রক্ত-পুঁজ পান করতে দেয়া হবে।
টগবগ করে ফুটছে এমন পানি তাদেরকে পান করতে দেয়া হবে।
উত্তপ্ত তেলের গাদ তাদেরকে পান করানো হবে।
জাহান্নামীদেরকে কাঁটাযুক্ত, তিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত যাক্কুম গাছ গিলতে বাধ্য করা হবে।
জাহান্নামীদের গায়ের চামড়া পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে, নতুন চামড়া জন্মাবে ও নতুনভাবে পুড়তে থাকবে।
আল্লাহ জাহান্নামে আরো বহুবিধ শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন।
জাহান্নামে সবচে’ কম শাস্তি যাকে দেয়া হবে তাকে আগুনের ফিতাযুক্ত একজোড়া জুতা পরানো হবে। এতে তার মাথার মগজ চুলার ওপর হাঁড়ির পানির মতো টগবগ করে ফুটতে থাকবে।
জান্নাত অনাবিল সুখ-শান্তির স্থান।
আল্লাহ তাঁর আদেশানুবর্তী বান্দাদেরকে মেহমানের মর্যাদা দেবেন।
আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা তাঁদেরকে সাদর-সম্ভাষণ জানিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।
আল্লাহ সবচে’ কম মর্যাদাবান জান্নাতীকে বর্তমান পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ বেশি স্থান দান করবেন।
আল্লাহ জান্নাতকে নয়নাভিরাম বাগানময় করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতের বাগানগুলোকে পাখ-পাখালিতে পূর্ণ করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতকে ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ করে রেখেছেন।
আল্লাহর নির্দেশে জান্নাতে সুপেয় পানির ঝর্ণা, সুস্বাদু দুধের ঝর্ণা, স্বচ্ছ মধুর ঝর্ণা ও অন্যান্য উন্নত মানের পানীয়র ঝর্ণা অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে।
আল্লাহ জান্নাতে অতি সুস্বাদু মাছ, গোশত, রকমারি খাদ্য ও ফলের সমারোহ ঘটিয়েছেন।
আল্লাহ জান্নাতে অনুপম উপদানে তৈরি সুউচ্চ, সুবিস্তৃত ও সুদৃশ্য প্রাসাদ সারি সজ্জিত করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতের প্রাসাদগুলোর মেঝেকে অতি উচ্চমানের পুরু কার্পেটে সজ্জিত করেছেন।
আল্লাহ জান্নাতীদের জন্য অতীব সুন্দর ও অতীব আরামদায়ক পোশাক মওজুদ করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতীদের জন্য অতীব আরামদায়ক আসন ও শয্যার ব্যবস্থা করেছেন।
আল্লাহ জান্নাতকে আলো-ঝলমল করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতকে অগণিত সৌন্দর্য-শোভার উপকরণে সজ্জিত করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতের প্রতিটি বস্তুকে তুলনাহীন সুঘ্রাণ যুক্ত করে রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতকে উত্তাপ ও শীতের প্রকোপ মুক্ত করে গড়েছেন।
আল্লাহ জান্নাতের সব কিছু জান্নাতীদের নাগালের মধ্যেই রেখেছেন।
আল্লাহ জান্নাতীদের খিদমাতের জন্য গিলমান (চির বালকদল) মুতায়েন করে রেখেছেন।
স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে জান্নাতী হলে আল্লাহ তাঁদেরকে জান্নাতেও অনন্তকালের জন্য জীবন-সাথী বানিয়ে দেবেন।
আল্লাহ জান্নাতে পুরুষদেরকে হুরও দেবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে ষাট হাত দৈর্ঘ্য দান করবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে চির যুবক ও চির যুবতী বানাবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে কখনো বুড়ো হতে দেবেন না।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে চিরকাল রোগমুক্ত রাখবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে যাবতীয় দৈহিক ও মানসিক অশান্তি মুক্ত রাখবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে অসাধারণ দৈহিক সৌন্দর্য দান করবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে অসাধারণ সুঘ্রাণযুক্ত করবেন।
আল্লাহ জান্নাতে এক বিশাল মার্কেট বানিয়ে রেখেছেন যেখানে প্রতি জুমাবার জান্নাতী পুরুষেরা একত্রিত হবেন।
সেখানে প্রবাহিত হাওয়ার ছোঁয়ায় তাঁদের রূপ-সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁদের পোশাক থেকে নতুন সুগন্ধ বের হতে থাকবে।
তাঁরা তাঁদের প্রাসাদে ফিরে তাঁদের স্ত্রীদেরকেও পূর্বের চেয়ে আরো বেশি রূপ-লাবণ্যে ভরা দেখতে পাবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে এমন ক্ষমতা দেবেন যে হাজারো মাইল দূরে অবস্থিত ব্যক্তিকে তাঁরা দেখতে চাইলে দেখতে পাবেন এবং কথা বলতে চাইলে বলতে পারবেন।
আল্লাহ এমন এমন বৃক্ষ তৈরি করে রেখেছেন যার একটির শাখা-প্রশাখার নিচে একজন অশ্বারোহী একশত বছর অশ্ব চালনা করেও তার সীমানা অতিক্রম করতে পারবেন না।
আল্লাহ জান্নাতীদের জন্য এমন বাহন মওজুদ করে রেখেছেন যাতে আরোহণ করে তাঁরা গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারবেন।
[সম্ভবত জাহান্নামের অংশটুকু ছাড়া মহাবিশ্বের বাকি অংশকে জান্নাতে রূপান্তরিত করা হবে।]
আল্লাহ পৃথিবীটাকেও জান্নাতের অংশ বানিয়ে দেবেন।
একজন জান্নাতী যা চাইবেন তা-ই পাবেন।
আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে আরো অনেক কিছু দেবেন।
আল্লাহ জান্নাতে এমন সব নিয়ামাত মওজুদ করে রেখেছেন যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, যার কথা কোন কান কখনো শুনেনি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয়নি।
আল্লাহ নতুন নতুন নিয়ামাত সৃষ্টি করে জান্নাতীদেরকে উপহার দিতে থাকবেন।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে তাঁর দর্শন দান করে ধন্য করবেন।
আল্লাহর দর্শনই হবে জান্নাতীদের নিকট সবচে’ বেশি আনন্দের বিষয়।
আল্লাহ মহাশিল্পী।
আল্লাহ মহাবিজ্ঞানী।
আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য তুলনাহীন।
আল্লাহর কোন খুঁত নেই।
আল্লাহর কোন ত্র“টি নেই।
আল্লাহর কোন অপূর্ণত্ব নেই।
আল্লাহর কোন অপারগতা নেই।
পৃথিবীর সবগুলো গাছ দিয়ে যদি কলম বানানো হয়, সমুদ্রগুলোর পানির সাথে আরো সাত সমুদ্রের পানি মিলিয়ে যদি কালি বানানো হয়, তবুও আল্লাহর কথা লিখে শেষ করা যাবে না।
আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।
আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।
আল্লাহর জন্যই সব সম্মান।
লেখক : এ.কে.এম. নাজির আহমদ
March 19, 2025
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ মানব-সত্তায় বহুবিধ চাহিদা জুড়ে দিয়েছেন। আবার, এই আল্লাহই মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই সৃষ্টি করেছেন। তদুপরি আল্লাহ মানুষকে তার চাহিদা পূরণে সম্পদ আহরণ, সম্পদ রূপান্তরিতকরণ এবং সম্পদ ভোগ-ব্যবহারের জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা দান করেছেন। এই জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্ম-ক্ষমতা প্রয়োগ করেই মানুষ আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব করে থাকে। মানুষের কোন কোন চাহিদা আপনা-আপনিই পূরণ হয়। কোন কোন চাহিদা মানুষ একক প্রচেষ্টায় পূরণ করতে পারে। কোন কোন চাহিদা পূরণের জন্য মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নানাবিধ চাহিদা পূরণের জন্যই পরিবার, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা, আর্থিক সংস্থা এবং রাষ্ট্র-সংগঠন গড়ে ওঠে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চাই বায়ু। পৃথিবীর চারদিকে একটি পুরো বায়ুমণ্ডল জুড়ে দিয়ে আল্লাহ মানুষের এই চাহিদা পূরণ করেছেন।এই চাহিদা আপনা-আপনি পূরণ হয়। শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে বায়ু অটোমেটিক মানুষের ফুসফুসে যাতায়াত করে। বায়ুর চাহিদা মেটাবার জন্য মানুষকে কষ্ট করতে হয় না। চেষ্টা চালাতে হয় না। শীতের দিনে শীত তাড়াবার জন্য তাপের প্রয়োজন। তাপ লাভের অন্যতম উপায় রোদ পোহানো। কেউ শীত তাড়াতে চাইলে রোদে গিয়ে দাঁড়ালে শীত দূর হয়। এইভাবে তাপ লাভের জন্য তাকে কারো সহযোগিতা নিতে হয় না। অর্থাৎ সে একাই তার এ চাহিদা পূরণ করতে পারে।
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্য চাই। আল্লাহ শস্য, ফল, শাক-সবজি, তরি-তরকারি ইত্যাদি উৎপন্ন করার উপযুক্ত করে মাটি সৃষ্টি করেছেন। এই মাটি কর্ষণ করে, এতে বীজ বপন করে এবং চারাগাছ পরিচর্যা করে এইগুলোর উৎপাদন নিশ্চিত করতে হয়। আবার, চুলোর উপর পাতিলে সেদ্ধ করে এইগুলো খাওয়ার উপযোগি করতে হয়। খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং খাদ্য প্রস্তুতকরণের বিভিন্ন স্তরে একজন মানুষকে অপরাপর মানুষের সহযোগিতা নিতে হয় এবং আল্লাহ পৃথিবীময় যেইসব উপাদান মওজুদ করে রেখেছেন সেইগুলোর রূপান্তর ঘটিয়ে অপরাপর মানুষ যেইসব উপকরণ তৈরি করেছে, সেইগুলোর সাহায্য নিতে হয়। অর্থাৎ সে একা এ চাহিদা পূরণ করতে পারে না।
মানুষের চাহিদার তালিকা বেশ দীর্ঘ। মানুষের খাদ্য চাই, পানি চাই, ঘর চাই, পোশাক চাই, ঔষধ চাই, শিক্ষা চাই, ভাব প্রকাশের সুযোগ চাই, বাহন চাই, নিরাপত্তা চাই, যুল্মের প্রতিকার চাই। ইত্যাদি। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো বা চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের জীবনকে স্বচ্ছন্দ করার জন্য, মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য এবং মানুষের জীবনকে সমুন্নত করার জন্য আল্লাহ যেইসব নিয়ামাতের ব্যবস্থা করেছেন সেইগুলো সবই মানুষের রিয্ক।উল্লেখ্য যে অন্যান্য সৃষ্টির রিয্কের ব্যবস্থাও আল্লাহই করে থাকেন। রিয্ক তালাশের নির্দেশ
এই পৃথিবীর অংগনে মুমিনদেরকে দুইটি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হয়। একটি হালাল জীবিকা উপার্জনের সংগ্রাম, অপরটি আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম। জীবিকা উপার্জনে উদাসীন হওয়া, সংসার ত্যাগী হওয়া, বৈরাগী হওয়া, সন্ন্যাসী হওয়া এবং আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম বিমুখ হওয়া ইসলাম নির্দেশিত জীবন ব্যবস্থা নয়। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لاَرَهْباَنِيَّةَ فىِ الْاِسْلاَمِ[মুসনাদে আহমাদ]
“ইসলামে রাহবানিয়াত বা বৈরাগ্যবাদ নেই।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَرَهْبَانِيَّةَ نِ ابْتَدَعُوْهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ[সূরা আল হাদীদ : ২৭]
“আর বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে, আমি ওটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেইনি।”
قُلْ مَنْ حَرَّمَ زِيْنَةَ اللهِِِ الَّتِىْ أَخْرَجَ لِعِبَادِه وَالْطَّيِّبَاتِ مِنَ الرِّزْقِ قُلْ هِىَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوْا فِى الْحَيَاةِ الدُّنْيَا خَالِصَةً يَّوْمَ الْقِيَامَةِ[সূরা আল আ‘রাফ : ৩২]
“তাদেরকে বলে দাও ঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যেইসব সাজ-শোভা এবং পবিত্র রিয্ক দান করেছেন, সেইগুলোকে হারাম করলো কে? দুনিয়ার জীবনে এইগুলো তো মুমিনদের জন্যই এবং আখিরাতেও একান্তভাবে তাদের জন্যই হবে।” অর্থাৎ আল্লাহর অনুগত বান্দা হওয়ায় মুমিনরাই এইগুলো ভোগ-ব্যবহারের প্রকৃত হকদার।
وَلَقَدْ مَكَّنَّاكُمْ فِى الأَرْضِ وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ قَلِيْلاً مَّا تَشْكُرُوْنَ [সূরা আল আ‘রাফ ঃ ১০]
“আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এতে তোমাদের জন্য জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছি। তোমরা সামান্যই শুকরিয়া আদায় করে থাকো।”
هُوَ الَّذِىْ خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِى الْأَرْضِ جَمِيْعاً[সূরা আল বাকারা : ২৯]
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন।”
وَآتَاكُمْ مِّنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّواْ نِعْمَتَ اللهِ لاَ تُحْصُوْهَا[সূরা ইবরাহীম : ৩৪]
“এবং তোমরা যা চাও (অর্থাৎ তোমাদের চাহিদা পূরণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন) সবই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামাত গুলো গণনা করতে চাও তা করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
هُوَ الَّذِىْ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ ذَلُولًا فَامْشُوْا فِىْ مَنَاكِبِهَا وَكُلُوْا مِنْ رِّزْقِه وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ[সূরা আল মুলক : ১৫]
“তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর বুকে বিচরণ কর এবং আল্লাহর দেওয়া রিয্ক (আহরণ করে) খাও। আবার জীবিত হয়ে তোমাদেরকে তাঁর দিকেই যেতে হবে।”
ياَ أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِذَا نُوْدِىَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَّومِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ. فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوْا اللهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আল জুমু‘আ : ৯, ১০]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, জুমু‘আর দিন যখন ছালাতের জন্য ডাকা হয় আল্লাহর স্মরণে দৌড়ে আস, বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জান। ছালাত আদায় করে যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাক। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اُطْلُبُوا الرِّزْقَ فِىْ خَباَ ياَ الْاَرْضِ [আয়িশা (রা), মুসনাদু আবী ইয়া‘লা]
“তোমরা মাটির গভীর তলদেশে রিয্ক তালাশ কর।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا[সূরা আল বাকারা : ২৭৫]
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।”
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ[সূরা আল বাকারা : ১৯৮]
“(হাজের সময়ে) তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিয্ক) তালাশ কর এতে কোন দোষ নেই।”
...وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُواْ فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ ...[সূরা বানী ইসরাঈল : ১২]
“এবং আমি দিনকে করেছি আলোকোজ্জ্বল যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ (রিয্ক) তালাশ করতে পার।”
وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا [সূরা আন নাবা : ১১]
“এবং আমি দিনকে জীবিকা উপার্জনের সময় বানিয়েছি।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,ماَ اَكَلَ اَحَدٌ طَعاَماً قَطُّ خَيْرًا مِّنْ اَنْ يَّاْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ.[মিকদাম ইবনু মা‘দী কারাব (রা), সহীহ আল বুখারী]
“কারো জন্য নিজের হাতের উপার্জনের চেয়ে উত্তম খাবার আর নেই।”আল্লাহর রাসূলকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “কোন্ উপার্জন উত্তম?”
তিনি বললেন,عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِه وَكُلُّ بَيْعٍ مَّبْرُوْرٍ.
“ব্যক্তির নিজের হাতের উপার্জন এবং সৎ ব্যবসা।”
[রাফে‘ ইবনু খাদীজ (রা), মিশকাতুল মাছাবীহ]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,اِذَا صَلَّيْتُمُ الْفَجْرَ فَلاَ تَنُوْمُوْا عَنْ طَلْبِ اَرْزَاقِكُمْ.
[আনাস ইবনু মালিক (রা), আলকাউলুল মুসাদ্দাদ]
“তোমরা ছালাতুল ফাজর আদায়ের পর তোমদের রিয্ক তালাশে নিয়োজিত না হয়ে ঘুমিয়ে থেকো না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,طَلَبُ كَسْبِ الْحَلاَلِ فَرِيْضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ.
[আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রা), সুনানু আল বাইহাকী]
“নির্ধারিত ফারযগুলোর পর হালাল জীবিকা তালাশ করাও ফারয।”
আল্লাহই রিয্ক দিয়ে থাকেন
“সৃষ্টির সূচনা থেকে কিয়ামাত পর্যন্ত যতো প্রকারের যতো মাখলুক আল্লাহ সৃষ্টি করবেন তাদের প্রত্যেকের সঠিক চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে খাদ্যের সব সরঞ্জাম হিসাব করে তিনি পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়েছেন। স্থলভাগে ও পানিতে অসংখ্য প্রকারের উদ্ভিদ রয়েছে। যাদের প্রতিটি শ্রেণীর খাদ্য সংক্রান্ত প্রয়োজন অন্য সব শ্রেণী থেকে ভিন্ন। আল্লাহ বায়ুমণ্ডল স্থল ও পানিতে অসংখ্য প্রজাতির জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি প্রজাতির স্বতন্ত্র ধরণের খাদ্য প্রয়োজন। তাছাড়া এইসব প্রজাতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের সৃষ্টি মানুষ। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন শুধু দেহের লালন ও পরিপুষ্টি সাধনের জন্যই নয়, তার রুচির পরিতৃপ্তির জন্যও নানা রকম খাদ্যের প্রয়োজন। আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে কি জানা সম্ভব ছিলো, মাটির তৈরি এই গ্রহটির ওপর জীবনের উৎপত্তি থেকে শুরু করে তার পরিসমাপ্তি পর্যন্ত কোন্ কোন্ শ্রেণীর সৃষ্টিকুল কত সংখ্যক, কোথায় কোথায় এবং কোন্ কোন্ সময় অস্তিত্ব লাভ করবে এবং তাদের প্রতিপালনের জন্য কোন্ প্রকারের খাদ্য কত পরিমাণ দরকার হবে? নিজের সৃষ্টি পরিকল্পনানুসারে যেইভাবে তিনি খাদ্যের মুখাপেক্ষী এইসব মাখলুককে সৃষ্টি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, অনুরূপভাবে তাদের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য সরবরাহেরও পূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন।”
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ‘লা মাওদুদী, ১৪শ খণ্ড, সূরা হামীমুস সাজদার তাফসীরের ১২ নাম্বার টীকা।]
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন, وَكَأَيِّنْ مِّنْ دَابَّةٍ لَّا تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ [সূরা আল আনকাবূত : ৬০]
“অসংখ্য জীব এমন রয়েছে যারা নিজেদের রিয্কের ভাণ্ডার বহন করে বেড়ায় না। আল্লাহই তাদেরকে রিয্ক দেন এবং তোমাদের রিয্কও তিনিই দেন।”
وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِى اْلأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِىْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ [সূরা হূদ : ৬]
“পৃথিবীতে এমন কোন জীব নেই যার রিয্কের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নয়। তিনিই জানেন কার বাস কোথায় এবং তাকে কোথায় রাখা হয়। সব কিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।”
إِنَّ اللهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِيْنُ [সূরা আয্ যারিয়াত : ৫৮]“নিশ্চয়ই আল্লাহই রিয্কদাতা, অটল ক্ষমতার অধিকারী।”
وَاْلأَرْضَ مَدَدْنَاهَا وَأَلْقَيْنَا فِيْهَا رَوَاسِيَ وَأَنْبَتْنَا فِيْهَا مِنْ كُلِّ شَىْءٍ مَّوْزُوْنٍ. وَجَعَلْنَا لَكُمْ فِيْهَا مَعَايِشَ وَمَنْ لَّسْتُمْ لَه بِرَازِقِيْنَ .وَإِنْ مِّنْ شَىْءٍ إِلاَّ عِنْدَنَا خَزَائِنُه وَمَا نُنَزِّلُه إِلاَّ بِقَدَرٍ مَّعْلُوْمٍ [সূরা আল হিজর : ১৯-২১]
“আমি পৃথিবীকে ছড়িয়ে দিয়েছি। এর ওপর পাহাড় গেড়ে দিয়েছি। এর মধ্যে পরিমাণ মত নানা ধরণের গাছ-পালা জন্মিয়েছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তাদের জন্যও যাদের রিয্কদাতা তোমরা নও। এমন কোন জিনিস নেই যার ভাণ্ডার তাঁর হাতে নয়। এবং আমি তা সুনির্দিষ্ট পরিমাণে নাযিল করে থাকি।”
وَجَعَلَ فِيْهَا رَوَاسِىَ مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيْهَا وَقَدَّرَ فِيْهَا أَقْوَاتَهَا فِىْ أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءَ لِّلسَّائِلِيْنَ [সূরা হামীমুস সাজদা : ১০]
“তিনি (পৃথিবীকে অস্তিত্বদানের পর) ওপর থেকে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন। এতে বারাকাত দান করেছেন। আর এতে সকল প্রার্থীর চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পরিমাণে রিয্ক নির্দিষ্ট করেছেন, মাত্র চারদিনে।”
قَدْ جَعَلَ اللهُ لِكُلِّ شَىْءٍ قَدْرًا [সূরা আত্ তালাক : ৩]
“আল্লাহ সবকিছুরই একটি পরিমাণ ঠিক করে রেখেছেন।”
نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَّعِيشَتَهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ
[সূরা আয্ যুখরুফ : ৩২]
“আমি দুনিয়ার জীবনে এদের মধ্যে জীবনোপকরণ বণ্টন করেছি, এদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোককে অন্যদের ওপর বেশি মর্যাদা দিয়েছি যাতে এরা একে অপরের সেবা গ্রহণ করতে পারে। এরা যা জমা করে তার চেয়ে তোমার রবের রাহমাত অনেক বেশি মূল্যবান।”
اللهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِه يَرْزُقُ مَنْ يَّشَاءُ وَهُوَ الْقَوِىُّ العَزِيْزُ [সূরা আশ্ শূরা : ১৯]
“আল্লাহ সূক্ষ্ম বদান্যতাপ্রবণ। যাকে ইচ্ছা রিয্ক দেন। তিনি শক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী।”
قُلْ إِنَّ رَبِّىْ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ مِنْ عِبَادِه وَيَقْدِرُ لَهُ وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِّنْ شَىْءٍ فَهُوَ يُخْلِفُه وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِيْنَ [সূরা সাবা : ৩৯]
“তাদেরকে বলে দাও ঃ আমার রব তাঁর বান্দাদের যাকে ইচ্ছা প্রচুর রিয্ক দেন, আর যাকে ইচ্ছা সংকীর্ণ করে দেন। আর তোমরা যা খরচ কর তার পরিবর্তে তিনি তোমাদেরকে আরো রিয্ক দেবেন। তিনিই তো সর্বোত্তম রিয্কদাতা।”
لَه مَقَالِيْدُ السَّموتِ وَالْأَرْضِ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيْمٌ [সূরা আশ্ শূরা : ১২]
“আসমান ও যমীনের চাবি তাঁরই হাতে। তিনি যাকে চান অঢেল রিয্ক দেন এবং যাকে চান কম দেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর জ্ঞান রাখেন।”
أَوَلَمْ يَعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّ فِىْ ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ [সূরা আয্ যুমার : ৫২]
“তারা কি জানে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে চান অঢেল রিয্ক দেন এবং যাকে চান তার রিয্ক সংকীর্ণ করে দেন। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা ঈমান পোষণ করে।”
قُلْ إِنَّ رَبِّىْ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيَقْدِرُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ
[সূরা সাবা : ৩৬]
“তাদেরকে বলে দাও : নিশ্চয়ই আমার রব যাকে চান প্রশস্ত রিয্ক দেন এবং যাকে চান সংকীর্ণ রিয্ক দেন। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই এর তাৎপর্য জানেনা।”
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْءًا كَبِيْرًا [সূরা বানী ইরাঈল : ৩১]
“এবং তোমরা অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকে রিয্ক দেবো, তোমাদেরকেও দিচ্ছি। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা মস্ত বড় গুনাহ।”
وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُمْ مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ
[সূরা আল আন‘আম : ১৫১]
“এবং অভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করো না। তোমাদেরকে রিয্ক দিচ্ছি, তাদেরকেও দেবো,।”
وَلَوْ بَسَطَ اللهُ الرِّزْقَ لِعِبَادِه لَبَغَوْا فِى الْأَرْضِ وَلكِنْ يُّنَزِّلُ بِقَدَرٍ مَّا يَشَاءُ
[সূরা আশ্ শূরা : ২৭]
“আল্লাহ যদি তাঁর বান্দাদেরকে সীমাহীন রিয্ক দান করতেন, তাহলে তারা পৃথিবীতে বিদ্রোহের তুফান সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি ইচ্ছা মতো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে রিয্ক নাযিল করেন।”
فَابْتَغُوْا عِنْدَ اللهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوْا لَه
[সূরা আল আনকাবূত : ১৭]
“অতএব আল্লাহর কাছেই রিয্ক অনুসন্ধান কর, তাঁরই ইবাদাত কর এবং তাঁরই শুকরিয়া আদায় কর।”
রিয্কের প্রাচুর্য অথবা সংকীর্ণতা দ্বারা
আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ার জীবনে যাকে যা কিছু দিয়েছেন তা পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন।
আল্লাহ অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, প্রভাব-পতিপত্তি ইত্যাদি পরীক্ষার জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে চান, এইগুলো পেয়ে সে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে, না অকৃতজ্ঞ হয়।
আবার আল্লাহ অভাব-অনটন, বিপদ-মুসিবাত ইত্যাদিও পরীক্ষার জন্যই দিয়ে থাকেন। তিনি দেখতে চান অভাব-অনটন ও বিপদ-মুসিবাতে পড়ে মানুষ তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থেকে ধৈর্য ধারণ করে, না নৈতিকতার বাঁধন ছিন্ন করে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
فَأَمَّا الْإِنسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّه فَأَكْرَمَه وَنَعَّمَه فَيَقُوْلُ رَبِّىْ أَكْرَمَنِ .وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ فَيَقُولُ رَبِّىْ أَهَانَنِ [সূরা আলফাজর : ১৫, ১৬]
“কিন্তু মানুষের অবস্থা হচ্ছে ঃ যখন তাঁর রব তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তাকে সম্মান ও নিয়ামাত দান করেন তখন সে বলে ঃ আমার রব আমাকে সম্মানিত করেছেন। আবার তিনি যখন তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রিয্ক সংকীর্ণ করে দেন, তখন সে বলে ঃ আমার রব আমাকে হেয় করেছেন।”
আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কাউকে সুদর্শন এবং কাউকে কুৎসিত রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে সবল-সুঠাম দেহের অধিকারী এবং কাউকে দুর্বল দেহের অধিকারী রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে মেধাবী এবং কাউকে মেধাহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন এবং কাউকে স্মৃতিশক্তিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে সুষ্ঠু প্রত্যংগসহ এবং কাউকে বিকলাংগরূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন এবং কাউকে দৃষ্টিশক্তিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে কর্তৃত্বশীল এবং কাউকে কর্তৃত্বহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
তিনি কাউকে খ্যাতিমান এবং কাউকে খ্যাতিহীন রূপে সৃষ্টি করেন।
এই সকল অবস্থাই মানুষের জন্য পরীক্ষা। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে সদা সচেতন থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য চেষ্টা করা।
আল্লাহর অনুগত ব্যক্তি ও জাতি
সহজে রিয্ক লাভ করে থাকে
দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতের জীবনে মানুষের কল্যাণ কিংবা অকল্যাণ হয় তার কৃত আমলের নিরিখে। কোন ব্যক্তি যদি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল জীবন-যাপন করে আল্লাহ তাকে জীবিকার পেরেশানী দ্বারা পর্যুদস্ত করবেন, এটা স্বাভাবিক নয়।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهُ مَخْرَجًا .وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
[সূরা আত্ তালাক : ২, ৩]
“যেই ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলে আল্লাহ তাকে কঠিন অবস্থা থেকে নি®কৃতি পাওয়ার পথ দেখান এবং এমন উপায়ে তাকে রিয্ক দেন যে উপায়ের কথা সে কখনো কল্পনাও করেনি।”
[তবে ঈমানী দৃঢ়তা পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন যদি কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তি-সমষ্টিকে অভাব-অনটন অথবা অন্য কোন মুসিবাতে ফেলেন, সেটা ভিন্ন কথা। এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَىْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوْعِ وَنَقْصٍ مِّنَ اْلأَمَوَالِ وَاْلأنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِيْنَ [সূরা আল বাকারা : ১৫৫]
“এবং আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, অনাহার এবং অর্থ-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবো। আর ছবর অবলম্ব^নকারীদেরকে সুসংবাদ দাও।”]
وَأَنِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوْبُوْا إِلَيْهِ يُمَتِّعْكُمْ مَّتَاعًا حَسَنًا إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى وَيُؤْتِ كُلَّ ذِىْ فَضْلٍ فَضْلَهُ وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنِّىَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ كَبِيْرٍ
[সূরা হূদ : ৩]
“এবং তোমরা যদি তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে আস, তাহলে তিনি তোমাদেরকে একটি মেয়াদ পর্যন্ত উক্ত জীবিকা দান করবেন এবং তাঁর অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য প্রত্যেককে অনুগ্রহ করবেন। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, আমি তোমাদের জন্য এক ভয়াবহ দিনের আযাবের ভয় করছি।”
وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِّدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلى قُوَّتِكُمْ وَلاَ تَتَوَلَّوْاْ مُجْرِمِيْنَ [সূরা হূদ : ৫২]
“এবং ওহে আমার কাউম, তোমরা তোমাদের রবের নিকট ইস্তিগফার কর, তাঁর দিকে ফিরে আস, তাহলে তিনি তোমাদের জন্য আসমানের দুয়ার খুলে দেবেন এবং বর্তমান শক্তির সাথে আরো শক্তি যুক্ত করে দেবেন। তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে থেকো না।”
وَلَوْ أَنَّهُمْ أَقَامُواْ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِم مِّن رَّبِّهِمْ لِأَكَلُوْا مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ أَرْجُلِهِمْ مِّنْهُمْ أُمَّةٌ مُّقْتَصِدَةٌ وَكَثِيْرٌ مِّنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُوْنَ
[সূরা আল মা-ইদা : ৬৬]
“এবং তারা যদি আত্ তাওরাত, আল ইনজীল এবং তাদের প্রতি তাদের রবের কাছ থেকে যা কিছু নাযিল হয়েছে তা কায়েম করতো, তাহলে তারা ওপর থেকেও রিয্ক পেতো, নিচ থেকেও পেতো। তাদের মধ্যে কিছু লোক অভিপ্রেত পথেই আছে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ লোকই মন্দ কাজ করে চলছে।”
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرى آمَنُواْ وَاتَّقَواْ لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَاْلأَرْضِ وَلَـكِنْ كَذَّبُواْ فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُواْ يَكْسِبُوْنَ[সূরা আল আ‘রাফ : ৯৬]
“আর যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনতো এবং আল্লাহকে ভয় করে চলতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বারাকাতের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা বলেই উড়িয়ে দিলো। তাই আমি তাদের কামাই অনুযায়ী তাদেরকে পাকড়াও করলাম।”
পক্ষান্তরে আল্লাহর অবাধ্য ব্যক্তিকে আল্লাহ পেরেশানীযুক্ত জীবিকা দিয়ে থাকেন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِىْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُه يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمى
[সূরা তা-হা : ১২৪]
“আর যেই ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে, আমার উপদেশনামা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ (পেরেশানীযুক্ত) জীবিকা। আর কিয়ামাতের দিন আমি তাকে ওঠাবো অন্ধ করে।”
আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রাম
সাধারণ অর্থে ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কর্তৃক তাঁর সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত বিধান।
গোটা বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত, প্রাকৃতিক আইন বলে পরিচিত, বিধানগুলো আসলে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান।
বিশেষ অর্থে ইসলাম হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। মানুষের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে এই বিধানে। আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান হওয়ায় ইসলাম নির্ভুল, ভারসাম্যপূর্ণ এবং কল্যাণকর জীবন বিধান।
গোটা বিশ্ব প্রকৃতিতে স্বীয় বিধান কার্যকর করলেও আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন মানব সমাজে তাঁর বিধান কার্যকর করেননি। তাঁর অভিপ্রায় মানুষ স্বেচ্ছায় তাঁর দেওয়া জীবন বিধান কবুল করুক এবং তার ভিত্তিতে তারা সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলে পৃথিবীকে শান্তির নীড়ে পরিণত করুক।
আল্লাহর পক্ষ থেকে পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান কায়েমের জন্যই মানুষের সৃষ্টি। আল্লাহর পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব পালন করার জন্যই মানুষের নিযুক্তি। অর্থাৎ মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষকে সৃষ্টি করার প্রাক্কালে গোটা বিশ্বের ফেরেশতাদেরকে সম্বোধন করে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
إِنِّىْ جَاعِلٌ فِى اْلأَرْضِ خَلِيْفَةً [সূরা আল বাকারা : ৩০]
“আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে যাচ্ছি।”
আবার মানুষ পৃথিবীতে আসার পর তিনি মানুষকে তার পজিশন স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
هُوَ الَّذِىْ جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِى الْأَرْضِ [সূরা ফাতির : ৩৯]
“তিনি সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছেন।”
এই পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আর মানুষের জীবন মিশন হচ্ছে ইকামাতুদ্ দীন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا وَصّى بِه نُوحًا وَالَّذِىْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِه إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسى وَعِيْسى أَنْ أَقِيْمُوْا الدِّيْنَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ
[সূরা আশ্ শূরা : ১৩]
“তিনি (আল্লাহ) তোমাদের জন্য দীনের সেই বিধান নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা এখন আমি তোমার নিকট ওহীর মাধ্যমে পাঠাচ্ছি এবং যার নির্দেশ আমি দিয়েছিলাম ইবরাহীমকে, মূসাকে এবং ঈসাকে, (আর তা হচ্ছেঃ) এই দীন কায়েম কর এবং এতে বিভেদ-বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না।”
উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে নূহ (আ), ইবরাহীম (আ), মূসা (আ) এবং ঈসা (আ)-এর প্রতিও দীন কায়েমের নির্দেশ ছিলো।
এই আয়াতে মানব ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ের কয়েকজন নবীর নাম নেয়া হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে এই কয়জন নবীকে শুধু দীন কায়েমের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। আসলে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বুঝাতে চাচ্ছেন যে সকল নবীরই জীবন মিশন ছিলো ইকামাতুদ্ দীন।
নবীর উম্মাতের জীবন মিশনও ছিলো ইকামাতুদ্ দীন।
এখানে উল্লেখ্য যে দীন অটোমেটিক কায়েম হয় না। আবার জোর-জবরদস্তি করেও দীন কায়েম করা যায় না।
দীন কায়েমের জন্য বিজ্ঞতাপূর্ণ সংগ্রাম প্রয়োজন। নবী-রাসূলগণ দীন কায়েমের পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন একের পর এক বহু সংখ্যক নবী পাঠিয়েছেন মানব সমাজে। তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাঁরা আবির্ভূত হয়েছেন বিভিন্ন কালে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার দীন কায়েমের জন্য তাঁরা সকলেই অবলম্বন করেছেন অভিন্ন কর্ম-কৌশল।
নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ এবং তাঁর দেওয়া জীবন বিধান অনুসরণের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।
যেখানেই মানুষ সেখানেই তাঁরা ছুটে গেছেন। কখনো এক ব্যক্তির কাছে, কখনো ব্যক্তি-সমষ্টির কাছে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তাঁরা পরিশ্রম করেছেন। জীবন ধারণের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যয়িত অংশটুকু ছাড়া তাঁদের সময়, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়োজিত হয়েছে এই সুমহান কাজে। তাঁদের প্রতি যাঁরা ঈমান এনেছিলেন তাঁদেরও কর্মধারা ছিলো অনুরূপ।
যদিও সকল মানুষকে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে তাঁর দীন কায়েমের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, নবীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যাঁরা তাঁদের কাফিলায় শামিল হয়েছেন তাঁরা ছাড়া বাকিরা আল্লাহদ্রোহিতাকে তাদের জীবন মিশন বানিয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এইভাবে তারা পৃথিবীর জীবনে তো অকল্যাণের শিকারে পরিণত হয়েছেই, যেই কর্তব্য সাধনের জন্য তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিলো তা না করার কারণে আখিরাতে তাদেরকে অবশ্যই হতে হবে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন।
সফল জীবনের পরিচয়
পৃথিবীর বেশি সংখ্যক মানুষকেই জীবনের প্রকৃত মিশনের প্রতি উদাসীন থেকে ‘সফলতার’ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বেহুঁশের মতো ছুটতে দেখা যায়।
এই জীবনে টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বিশাল অট্টালিকার মালিক হওয়া, বহু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, বিলাসী জীবন যাপন করতে পারা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে পারাকেই তারা মনে করে সফলতা।
কিন্তু মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের দৃষ্টিতে সফলতার স্বরূপ ভিন্ন। আল কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতে তিনি সফল ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরেছেন যাতে মানুষ ‘সফলতার’ ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে, সঠিক ধারণা লাভ করতে এবং সঠিক কর্ম ধারা অবলম্বন করতে পারে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
أَلاَ إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ الَّذِينَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ لَهُمُ الْبُشْرُى فِى الْحَياةِ الدُّنْيَا وَفِى الْاخِرَةِ لاَ تَبْدِيْلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪]
“জেনে রাখ, যারা আল্লাহর বন্ধু, যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদের কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই। দুনিয়া এবং আখিরাতে- উভয় জীবনেই তাদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহর কথা পরিবর্তিত হবার নয়। এটি বড়ই সফলতা।”
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكّاهَا وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّاهَا [সূরা আশ্ শামস : ৯, ১০]
“অবশ্যই সেই ব্যক্তি সফল যে নিজকে পরিশুদ্ধ করে নিয়েছে। আর সেই ব্যক্তি বিফল যে নিজকে দাবিয়ে দিয়েছে।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالأَنْصَابُ وَالأَزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আল মা-য়িদা : ৯০]
“ওহে যারা ঈমান এনেছো, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নজরানা পেশ করার স্থান এবং ভাগ্য গণনার জন্য শর নিক্ষেপ নাপাক, শাইতানী কাজ। তোমরা এইগুলো পরিহার করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
فَاتِ ذَا الْقُرْبى حَقَّه وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِّلَّذِيْنَ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ وَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ[সূরা আর রূম : ৩৮]
“আত্মীয়দেরকে তাদের হক দাও, মিসকীন ও মুসাফিরদেরকেও। যারা আল্লাহর সন্তোষ প্রত্যাশী তাদের জন্য এটি খুবই উত্তম কাজ। তারাই ঐসব লোক যারা সফল।”
قُلْ لاَ يَسْتَوِى الْخَبِيْثُ وَالطَّيِّبُ وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِيْثِ فَاتَّقُوْا اللهَ يا أُولِى الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আল মা-য়িদা : ১০০]
“বলে দাও ঃ অপবিত্রতার আধিক্য তোমাদেরকে চমৎকৃত করলেও পবিত্র ও অপবিত্র জিনিস সমান নয়। ওহে জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَ تَأْكُلُوْا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً وَاتَّقُواْ اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ[সূরা আলে ইমরান : ১৩০]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। আল্লাহকে ভয় করে চল। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
فَأَمَّا الَّذِيْنَ امَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ فَيُدْخِلُهُمْ رَبُّهُمْ فِى رَحْمَتِه ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْمُبِيْنُ[সূরা আল জাসীয়া : ৩০]
“অতপর যারা ঈমান এনেছে এবং আমালে ছালেহ করেছে তাদের রব তাদেরকে তাঁর রাহমাতের মধ্যে দাখিল করে নেবেন। এটি সুস্পষ্ট সফলতা।”
الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْناهُمْ يُنْفِقُوْنَ. والَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْاخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ أُوْلـئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُوْلـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ[সূরা আল বাকারা : ৩-৫]
“যারা গাইবে বিশ্বাস করে, ছালাত কায়েম করে, আমি যেই রিয্ক তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে দান করে, যারা তোমার প্রতি ও তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান পোষণ করে, আর আখিরাতের প্রতিও যাদের রয়েছে ইয়াকীন, তারাই রয়েছে তাদের রবের নির্দেশিত পথে। আর তারাই সফল।”
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُولِه لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আন্ নূর : ৫১]
“নিশ্চয়ই মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা মেনে নেওয়ার জন্য ডাকা হয় তখন তারা বলে ঃ আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। এবং এরাই সফল।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُولَه فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا
[সূরা আল আহযাব : ৭০, ৭১]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল এবং সোজা সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তোমাদের আমলগুলো সংশোধন করে দেবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। আর যেই ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চলে সে লাভ করেছে বিরাট সফলতা।”
الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَهُمْ بِالْاخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ أُوْلئِكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা লোকমান : ৪, ৫]
“যারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখিরাতের প্রতি ইয়াকীন রাখে, তারাই রয়েছে তাদের রবের নির্দেশিত পথে। আর তারাই সফল।”
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِىْ شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَّأَحْسَنُ تَأْوِيلاً [সূরা আন্ নিসা : ৫৯]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আর আনুগত্য কর উলুল আমরের (আদেশ প্রদানের অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের)। তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও। এটাই সঠিক কর্মনীতি এবং শেষ ফলের দিক দিয়ে এটাই ভালো।”
فَالَّذِيْنَ امَنُوْا بِه وَعَزَّرُوْهُ وَنَصَرُوْهُ وَاتَّبَعُوْا النُّوْرَ الَّذِىْ أُنْزِلَ مَعَهُ أُوْلـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ[সূরা আল আ‘রাফ : ১৫৭]
“অতপর যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সহযোগিতা করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার প্রতি নাযিলকৃত নূরের (আল কুরআনের) অনুসরণ করে, তারাই সফল।”
وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَه أُوْلـئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيْمٌ وَعَدَ اللهُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِى جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা আত্ তাওবা : ৭১, ৭২]
“এবং মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কাজের নির্দেশ দেয়, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, ছালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। আল্লাহ শিগ্গিরই তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞ। এই মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের সাথে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত এবং সেখানে তারা থাকবে চিরদিন। সবুজ বাগানে তাদের জন্য উত্তম বাসস্থান থাকবে। আর সবচে’ বড় কথা, তারা আল্লাহর সন্তোষ হাছিল করবে। আর এটাই তো বড় সফলতা।”
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ .الَّذِيْنَ هُمْ فِىْ صَلَاتِهِمْ خَاشِعُوْنَ .وَالَّذِيْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ .وَالَّذِيْنَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُوْنَ. وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حَافِظُوْنَ إِلَّا عَلى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُوْمِيْنَ فَمَنِ ابْتَغى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْعَادُوْنَ وَالَّذِيْنَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُوْنَ وَالَّذِينَ هُمْ عَلى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُوْنَ أُوْلَئِكَ هُمُ الْوَارِثُوْنَ الَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ[সূরা আল মুমিনূন : ১-১১]
“সফলতা লাভ করলো সেই সব মুমিন যারা তাদের ছালাতে খুশু অবলম্বন করে, যারা বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকে, যারা পবিত্রতা বিধান কাজে তৎপর থাকে, যারা লজ্জাস্থানের হিফাজাত করে নিজেদের স্ত্রী ও দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীন স্ত্রীলোকদের ছাড়া, এই ক্ষেত্রে তারা ভর্ৎসনাযোগ্য নয়, তবে এর বাইরে কিছু চাইলে তারা হবে সীমালংঘনকারী, যারা আমানাত ও ওয়াদা প্রতিশ্র“তি রক্ষা করে, যারা ছালাতের পূর্ণ হিফাজাত করে। তারাই সেই উত্তরাধিকারী যারা উত্তরাধিকার হিসাবে ফিরদাউস পাবে, সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল।”
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ يَغُضُّوْا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكى لَهُمْ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا يَصْنَعُوْنَ وَقُلْ لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلى جُيُوْبِهِنَّ وَلَا يُبْدِيْنَ زِيْنَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ ابَائِهِنَّ أَوْ ابَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ بُعُوْلَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِىْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِىْ أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِيْنَ غَيْرِ أُوْلِى الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِيْنَ لَمْ يَظْهَرُوْا عَلى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِيْنَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوْبُوْا إِلى اللهِ جَمِيْعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
[সূরা আন্ নূর : ৩০, ৩১]
“মুমিন পুরুষদের বল তারা যেনো তাদের চোখ সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ তার খবর রাখেন।
মুমিন মহিলাদেরকে বল তারা যেন তাদের চোখ সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযাত করে।
তারা যেন তাদের সাজ দেখিয়ে না বেড়ায় এটুকু ছাড়া যা আপনাআপনি প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
তারা যেন তাদের বুকের ওপর ওড়নার আঁচল দিয়ে রাখে।
তারা যেন তাদের সাজ প্রকাশ না করে, তবে তাদের সামনে ছাড়া ঃ তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজের ছেলে, নিজের স্বামীর ছেলে, আপন ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, ঘনিষ্ঠ চেনা-জানা মহিলা, নিজেদের দাস, অধীনস্থ এমন পুরুষ যাদের অন্য রকম চাহিদা নেই এবং এমন বালক যারা মেয়েদের গোপন বিষয় জানে না।
তারা যেন তাদের গোপন সাজ সম্পর্কে লোকদেরকে জানাবার উদ্দেশ্যে যমীনে জোরে পা ফেলে না চলে।
হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
وَلْتَكُنْ مِّنْكُمْ أُمَّةٌ يَّدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُوْلـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আলে ইমরান : ১০৪]
“তোমাদের মধ্য হতে এমন একদল লোক থাকতে হবে যারা লোকদেরকে কল্যাণের দিকে ডাকবে, মা‘রূফ কাজের নির্দেশ দেবে এবং মুনকার থেকে বিরত রাখবে। আর এরাই সফল।”
فَاتَّقُوْا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوْا وَأَطِيْعُوْا وَأَنْفِقُوْا خَيْرًا لِّأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আত্ তাগাবুন : ১৬]
“আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করে চল। শুন, আনুগত্য কর এবং ইনফাক কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম। যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে গেছে তারাই সফল।”
لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِيْنَ الَّذِيْنَ أُخْرِجُوْا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُْونَ اللهَ وَرَسُولَه أُوْلئِكَ هُمُ الصَّادِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ تَبَوَّؤُوْا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّوْنَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُوْنَ فِى صُدُوْرِهِمْ حَاجَةً مِّمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُوْنَ عَلى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আল হাশর : ৮, ৯]
“(ঐ মাল) ঐ দরিদ্র মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের বাড়ি-ঘর ও সহায়-সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদকৃত। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তোষ প্রত্যাশী। এরাই সত্যনিষ্ঠ।
(ঐ মাল তাদের জন্যও) যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান এনে বসবাস করছিলো। তারা ঐসব লোকের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে যারা হিজরাত করে তাদের কাছে এসেছে।
এমনকি মুহাজিরদেরকে যা কিছু দেওয়া হয় সেই বিষয়ে তারা নিজের
অন্তরে কোন চাহিদা পর্যন্ত অনুভব করে না।
নিজেদের যতো অভাবই থাকুক না কেন তারা নিজেদের ওপর অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের সংকীর্ণতা থেকে বেঁচে গেছে তারাই সফল।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَابْتَغُوْا إِلَيْهِ الْوَسِيْلَةَ وَجَاهِدُوْا فِى سَبِيْلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ [সূরা আল মা-য়িদা : ৩৫]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করে চল, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধানে লেগে থাক এবং তাঁর পথে জিহাদ কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِىْ التَّوْرَاةِ وَالْإِنجِيْلِ وَالْقُرْانِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِه مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِى بَايَعْتُمْ بِه وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা আত্ তাওবা : ১১১]
“আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, মারে ও মরে। তাদেরকে জান্নাত দেবার মজবুত ওয়াদা আত্ তাওরাত, আল ইনজীল ও আল কুরআনে করা হয়েছে। ওয়াদা পালনে আল্লাহর চেয়ে বেশি যোগ্য আর কে আছে? অতএব তোমরা আল্লাহর সাথে যেই বেচা-কেনা করেছো সেই ব্যাপারে খুশি হয়ে যাও। এটা অতি বড় সফলতা।”
الَّذِيْنَ امَنُوْا وَهَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ وَأُوْلئِكَ هُمُ الْفَائِزُوْنَ[সূরা আত্ তাওবা : ২০]
“আল্লাহর কাছে তো ঐসব লোকের মর্যাদাই বড় যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং আল্লাহর পথে তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে। আর এরাই তো সফল।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلى تِجَارَةٍ تُنْجِيْكُمْ مِّنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُولِه وَتُجَاهِدُوْنَ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِىْ جَنَّاتِ عَدْنٍ ذلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ [সূরা আছ্ ছাফ : ১০-১২]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আমি কি তোমাদেরকে এমন ব্যবসার কথা বলবো যা তোমাদেরকে কষ্টদায়ক আযাব থেকে বাঁচাবে? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং মাল ও জান দিয়ে তাঁর পথে জিহাদ কর। যদি তোমরা জান, এটাই তো তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ তোমাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন, তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। তোমাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাতে উত্তম ঘর দেবেন। এটি অতি বড় সফলতা।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوْا وَاذْكُرُوْا اللهَ كَثِيْرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلحُوْنَ [সূরা আল আনফাল : ৪৫]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, কোন বাহিনীর সাথে তোমাদের মুকাবিলা হলে তোমরা দৃঢ়পদ থাক এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اصْبِرُواْ وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا وَاتَّقُواْ اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
[সূরা আলে ইমরান : ২০০]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, ছবর অবলম্বন কর, বাতিলপন্থীদের মুকাবিলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর, সদা-সর্বদা প্রস্তুত থাক এবং আল্লাহকে ভয় করে চল, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।”
لـكِنِ الرَّسُولُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا مَعَهُ جَاهَدُوْا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ وَأُوْلـئِكَ لَهُمُ الْخَيْرَاتُ وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আত্ তাওবা : ৮৮]
“কিন্তু রাসূল এবং ঐসব লোক যারা তাঁর সাথে ঈমান এনেছে তাদের মাল ও জান দিয়ে জিহাদ করেছে। এদের জন্যই তো সব কল্যাণ। আর এরাই তো সফল।”
لاَ تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاخِرِ يُوَادُّوْنَ مَنْ حَادَّ اللهَ وَرَسُولَه وَلَوْ كَانُوْا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيْرَتَهُمْ أُوْلئِكَ كَتَبَ فِيىْ قُلُوْبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ أُوْلئِكَ حِزْبُ اللهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ [সূরা আল মুজাদালা : ২২]
“তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদেরকে ভালোবাসে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করছে, ঐ লোকেরা চাই তাদের পিতা, পুত্র, ভাই কিংবা গোষ্ঠীর কেউ হোক না কেন। আল্লাহ এইসব লোকের অন্তরে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি রূহ দিয়ে তাদেরকে শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে ঝর্ণা প্রবাহিত থাকবে। তারা সেখানে থাকবে চিরদিন। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট, তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর বাহিনী। জেনে রাখ, আল্লাহর বাহিনীর লোকেরাই সফল।”
এইসব আয়াতে সফল জীবনের যেইসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে সেইগুলোকে আমরা নিুরূপে সাজিয়ে নিতে পারি ঃ
১।আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ক্ষমতা-ইখতিয়ার কিংবা অধিকারে শিরকমুক্ত ঈমানের অধিকারী হওয়া।
২।আখিরাতের জওয়াবদিহিতা, শাস্তি ও পুরস্কারের কথা মনে জাগ্রত রেখে জীবন যাপন করা।
৩।কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা জানার পর বিনা দ্বিধায় মেনে চলা।
৪।একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করতে থাকা।
৫।ছালাত কায়েম করা ও খুশু সহকারে ছালাত আদায় করা।
৬।যাকাত আদায় করা।
৭।আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়গুলোর অনুশীলন করতে থাকা।
৮।আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত থাকা।
৯।ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ করতে থাকা।
১০।মা‘রূফের প্রতিষ্ঠা ও মুনকারের উচ্ছেদে চেষ্টিত থাকা।
১১।সর্বাবস্থায় ছবর অবলম্বন করা।
১২।যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকা।
১৩।আত্মীয়, মিসকীন ও মুসাফিরের হক আদায় করা।
১৪।সুদ থেকে বেঁচে থাকা।
১৫।মদ থেকে বেঁচে থাকা।
১৬।জুয়া থেকে বেঁচে থাকা।
১৭।আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য নজরানা পেশ করা হয় এমন স্থান পরিহার করে চলা।
১৮।তীর নিক্ষেপ করে ভাগ্য গণনা থেকে বেঁচে থাকা।
১৯।নাপাক জিনিস পরিহার করা।
২০।অবৈধ যৌনাচার থেকে বেঁচে থাকা।
২১।পর নারীর সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বেঁচে থাকা।
২২।আমানাতের হিফাযাত করা।
২৩।ওয়াদা-প্রতিশ্র“তি পালন করা।
২৪।বেহুদা কাজ থেকে বেঁচে থাকা।
২৫।কৃপণতা থেকে মুক্ত হওয়া।
২৬।আত্মীয়-স্বজন হলেও যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তাদেরকে ভালো না বাসা।
লক্ষ্য করার বিষয়, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন টাকার পাহাড় গড়তে পারা, বিশাল অট্টালিকার মালিক হওয়া, বহু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া, বিলাসী জীবন যাপন করতে পারা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়াকে কোথাও সফলতার মাপকাঠি বলে উল্লেখ করেন নি।
দুনিয়া প্রীতি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং আত্মীয় স্বজনের প্রতি মানুষের অন্তরে থাকে গভীর অনুরাগ। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সম্পদের প্রতি মানুষ দারুণ আকর্ষণ অনুভব করে। একটি সীমা পর্যন্ত এই অনুরাগ ও আকর্ষণ আপত্তিকর নয়। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলেই ঘটে বিপত্তি।
দুনিয়া-প্রীতি মানুষের জন্য দারুণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আসলে দুনিয়ার জীবন তো খুবই সংক্ষিপ্ত। এক সময় সকল আপনজন এবং সব সম্পদ পেছনে ফেলে আখিরাতে পাড়ি দিতে হয়। দুনিয়া-প্রীতি মানুষকে আখিরাতমুখী হতে দেয় না। আখিরাতের প্রস্তুতি গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে।
সেই জন্যই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দুনিয়ার জীবনের প্রকৃত অবস্থা বারবার মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ দুনিয়ার জীবনের গোলকধাঁধাঁয় পড়ে প্রতারণার শিকারে পরিণত না হয়।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِيْنَ وَالْقَنَاطِيْرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَه حُسْنُ الْمَابِ[সূরা আলে ইমরান : ১৪]
“মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তুপ, সেরা ঘোড়া, গৃহপালিত পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আকর্ষণকে খুবই সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এইগুলো দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী মাত্র। আর আল্লাহর কাছে তো রয়েছে উত্তম আবাস।”
الْمَالُ وَالْبَنُوْنَ زِيْنَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا [সূরা আল্ কাহফ : ৪৬]
“এই অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি তোমাদের দুনিয়ার জীবনের সাময়িক সাজ-সজ্জা মাত্র। আসলে তো টিকে থাকার মতো নেক আমলই তোমার রবের নিকট পরিণামের দিক দিয়ে উত্তম। এবং এই বিষয়েই ভালো কিছু আশা করা যায়।”
إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَاللهُ عِنْدَه أَجْرٌ عَظِيْمٌ [সূরা আত্ তাগাবুন : ১৫]
“অবশ্যই তোমাদের অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি একটি পরীক্ষা। আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে বিরাট প্রতিদান।”
اِعْلَمُوْا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِى الْأَمْوَالِ وَالْاَوْلاَدِ [সূরা আল হাদীদ : ২০]
“জেনে নাও, দুনিয়ার জীবন একটি খেলা, তামাশা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব-অহংকার এবং অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে একে অপরকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ [সূরা আল আনকাবুত: ৬৪]
“আর দুনিয়ার জীবন তো হাসি-তামাশা, খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আখিরাতের ঘরÑ সেটাই তো জীবনÑ যদি ওরা জানতো ঘর।”
“অর্থাৎ এর (দুনিয়ার জীবনের) বাস্তবতা শুধুমাত্র এতটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য নেচে-গেয়ে আমোদ করে এবং যার যার ঘরে চলে যায়। এখানে যে রাজা হয়ে গেছে সে আসলে রাজা হয়ে যায় নি বরং শুধুমাত্র রাজার অভিনয় করছে। এক সময় তার এই খেলা শেষ হয়ে যায়। তখন সে তেমনি দীনহীন অবস্থায় রাজ সিংহাসন থেকে বিদায় নেয় যেইভাবে এই দুনিয়ার বুকে এসেছিলো। অনুরূপভাবে জীবনের কোন একটি আকৃতিও এখানে স্থায়ী ও চিরন্তন নয়। যে যেই অবস্থায়ই আছে সাময়িকভাবে একটি সীমিত সময়ের জন্যই আছে। মাত্র কয়েক দিনের জীবনের সাফল্যের জন্য যারা প্রাণপাত করে এবং এরই জন্য বিবেক ও ঈমান বিকিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু আয়েশ আরামের উপকরণ ও শক্তি প্রতিপত্তির জৌলুস করায়ত্ত করে নেয়, তাদের এই সমস্ত কাজ মন ভুলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এইসব খেলনার সাহায্যে তারা যদি দশ, বিশ বা ষাট, সত্তর বছর মন ভুলানোর কাজ করে থাকে এবং তারপর শূন্য হাতে মৃত্যুর দরোজা অতিক্রম করে এমন জগতে পৌঁছে যায় যেখানকার স্থায়ী ও চিরন্তন জীবনে তাদের এই খেলা এক প্রতিকারহীন রোগে পরিণত হয়, তাহলে এই ছেলে ভুলানোর লাভ কি?”[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়্যেদ আবুল ‘আলা মওদূদী ১১শ খণ্ড, সূরা আল ‘আনকাবূতের তাফসীরের ১০২ নাম্বার টীকা।]
فَمَا أُوْتِيْتُمْ مِّنْ شَىْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ وَّأَبْقى لِلَّذِيْنَ امَنُوْا وَعَلى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ [সূরা আশ্ শূরা : ৩৬]
“তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা দুনিয়ার (ক্ষণস্থায়ী) জীবনের সামগ্রী। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা যেমনি উত্তম তেমনি স্থায়ী। তা সেই সব লোকের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের রবের ওপর তাওয়াক্কুল করেছে।”
وَلَوْلاَ أَنْ يَّكُوْنَ النَّاسُ أُمَّةً وَّاحِدَةً لَّجَعَلْنَا لِمَنْ يَّكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقُفًا مِّنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُوْنَ وَلِبُيُْوتِهِمْ أَبْوَابًا وَسُرُرًا عَلَيْهَا يَتَّكِؤُوْنَ وَزُخْرُفًا وَإِنْ كُلُّ ذلِكَ لَمَّا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُتَّقِيْنَ [সূরা আয্ যুখরুফ : ৩৩-৩৫]
“সকল মানুষ একই পথ ধরার আশংকা না থাকলে আমি কাফিরদের ঘরের ছাদ, যেই সিঁড়ি দিয়ে তারা উপরে ওঠে সেই সিঁড়ি, তাদের ঘরের দরওয়াজাগুলো এবং যেই উচ্চাসনে তারা হেলান দিয়ে বসে রূপা ও সোনা বানিয়ে দিতাম। এইগুলো তো পার্থিব জীবনের (সামান্য) উপকরণ। তোমার রবের নিকট আখিরাত তো কেবল মুত্তাকীদের জন্য নির্ধারিত।”
“অর্থাৎ এই সোনা-রূপা যা কারো লাভ করা তোমাদের দৃষ্টিতে চরম নিয়ামাত প্রাপ্তি এবং সম্মান ও মর্যাদার চরম শিখরে আরোহণ, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে এতই নগণ্য যে যদি সকল মানুষের কুফরের দিকে ঝুঁকে পড়ার আশংকা না থাকতো, তাহলে তিনি প্রত্যেক কাফিরের বাড়ি-ঘর সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি করে দিতেন। এই নিকৃষ্ট বস্তুটি কখন থেকে মানুষের মর্যাদা ও আত্মার পবিত্রতার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই সম্পদ তো এমন সব মানুষের কাছেও আছে যাদের ঘৃণ্য কাজ-কর্মের পংকিলতায় গোটা সমাজ পুঁতিগন্ধময় হয়ে যায়। আর একেই তোমরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড বানিয়ে রেখেছো।”
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়্যেদ আবুল ‘আলা মওদূদী, ১৪শ খণ্ড, সূরা আয্ যুখরুফের তাফসীরের ৩৩ নাম্বার টীকা।]
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا يَتَمَتَّعُوْنَ وَيَأْكُلُوْنَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ
[সূরা মুহাম্মাদ : ১২]
“আর কাফিররা দুনিয়ার ক’দিনের মজা লুটছে। জন্তু-জানোয়ারের মতো পানাহার করছে। ওদের চূড়ান্ত ঠিকানা জাহান্নাম।”
وَلاَ تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلى مَا مَتَّعْنَا بِه أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيْهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَّأَبْقَى [সূরা তা-হা : ১৩১]
“দুনিয়ার জীবনের এই জাঁকজমক যা আমি তাদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়েছি সেই দিকে তুমি চোখ তুলেও তাকাবে না। এইসব তো তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলার জন্য দিয়েছি। আর তোমার রবের রিয্কই উত্তম ও স্থায়ী।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اِنَّ لِكُلِّ اُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةُ اُمَّتِى الْمَالُ.
[কা‘ব ইবনু ইয়াদ (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“অবশ্যই প্রত্যেক উম্মাতের জন্য রয়েছে এক একটি ফিতনা। আমার উম্মাতের ফিতনা হচ্ছেÑ অর্থ-সম্পদ।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلاَ أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِىْ تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفى إِلَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُوْلئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوْا وَهُمْ فِى الْغُرُفَاتِ امِنُوْنَ [সূরা সাবা : ৩৭]
“তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি এমন নয় যে তা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে, তবে যারা ঈমান আনে এবং আমালে ছালেহ করে তারা এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ প্রাসাদে নিরাপদে অবস্থান করবে।”
وَما الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ مَتَاعُ الْغُرُوْرِ [সূরা আলে ইমরান : ১৮৫]
“আর দুনিয়ার জীবন তো ছলনার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।”
يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذلِكَ فَأُوْلئِكَ هُمُ الْخَاسِرُوْنَ [সূরা আল মুনাফিকুন : ৯]
“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না রাখে। যারা এমনটি করবে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
“বিশেষভাবে অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির উল্লেখ করা হয়েছে এই জন্য যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ এইসব স্বার্থের কারণে ঈমানের দাবি পূরণ না করে নিফাক অথবা ঈমানের দুর্বলতা অথবা পাপাচার ও না-ফরমানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।”
[তাফহীমুল কুরআন, সাইয়্যেদ আবুল ‘আলা মওদূদী, ১৭শ খণ্ড, সূরা আল মুনাফিকুনের তাফসীরের ১৮ নাম্বার টীকা।]
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَوْ كَانَتِ الدُّنْيَا تَعْدِلُ عِنْدَ اللهِ جَنَاحَ بَعُوْضَةٍ مَا سَقى كَافِرًا مِنْهَا شِرْبَةَ مَاءٍ[সাহল ইবনু সা‘দ (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“আল্লাহর নিকট দুনিয়াটার মূল্য যদি একটি মশার ডানার মূল্যের সমান হতো, তাহলে তিনি কোন কাফিরকে এর থেকে এক চুমুক পানি পান করতে দিতেন না।”
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
يا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ [সূরা ফাতির : ৫]
“ওহে মানব জাতি, অবশ্যই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকাবাজ (শাইতান) যেন তোমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে।”
فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ [সূরা লোকমান : ৩৩]
“অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। আর ধোঁকাবাজ (শাইতান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলতে না পারে।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ اَحَبَّ دُنْيَاه اَضَرَّبِاخِرَتِه وَمَنْ اَحَبَّ اخِرَتَه اَضَرَّبِدُنْيَاه فَاثِرُوْامَا يَابْقى عَلى مَا يَفْنى
[আবু মূসা আল আশ‘আরী (রা)। আহমাদ, ইবন হিব্বান, আল বাযযার, আল হাকিম, আল বাইহাকী।]
“যেই ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালোবাসে সে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে ব্যক্তি আখিরাতকে ভালোবাসে সে তার দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব যা ধ্বংসশীল তার ওপর যা স্থায়ী তাকে অগ্রাধিকার দাও।”
জাতিগতভাবে দুনিয়া-প্রীতির পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
يُوْشِكُ الاُمَمُ اَنْ تَدَاعى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الاكِلَةُ اِلى قَصْعَتِهَا- فَقَالَ قَائِلٌ وَ مِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ؟ قَالَ بَلْ اَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيْرٌ وَلكِنَّكُمْ غُثَاءً كَغُثَاءِ السَّيْلِ- وَلَيَنْزِعَنَّ اللهُ مِنْ صُدُوْرِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَابَةَ مِنْكُمْ- وَلِيَقْذِفَنَّ فِى قُلُوْبِكُمْ الْوَهْنَ- قاَلَ قاَئِلٌ ياَّ رَسُوْلَ اللهِ وَماَ الْوَهْنُ؟ قاَلَ حُبُّ الدُّنْياَ وَكَرَ اهِيَةِ الْمَوْتِ. [সাওবান (রা), সুনানু আবী দাঊদ]
“অচিরেই তোমাদের ওপর অন্য জাতিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্য সামগ্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন জিজ্ঞেস করলো ঃ ‘তখন কি আমরা সংখ্যায় খুব কম থাকবো?’ আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “না তোমরা বরং সংখ্যায় বেশি হবে, কিন্তু তোমরা বন্যা-স্রোতের ওপরে ভাসমান ফেনার মতো হবে। আল্লাহ শত্র“দের অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দেবেন। তোমাদের অন্তরে দুর্বলতা সৃষ্টি করে দেবেন।” লোকটি জিজ্ঞেস করলো ঃ ‘সেই দুর্বলতা কি?’ আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “দুনিয়া-প্রীতি এবং মৃত্যুর প্রতি অনীহা।”
অর্থাৎ তোমরা দুনিয়ার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়বে এবং জিহাদের কথা শুনলে প্রাণ ভয়ে পিছটান দেবে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِى سَبِيْلِه فَتَرَبَّصُواْ حَتَّى يَأْتِىَ اللهُ بِأَمْرِه وَاللهُ لاَ يَهْدِى الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ [সূরা আত্ তাওবা : ২৪]
“তাদেরকে বল ঃ তোমাদের আব্বা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ, তোমাদের ঐ ব্যবসা যার মন্দার আশংকা তোমরা কর, তোমাদের পছন্দের ঘড়-বাড়ি যদি তোমাদের কাছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ থেকে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ ফাসিকদেরকে সঠিক পথের দিশা দেন না।”
এই আয়াতের দাবি হচ্ছে,
দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে একজন মুমিনের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ প্রিয়তর হতে হবে।
অর্থাৎ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদকে অগ্রাধিকার দিতে পারার ওপরই নির্ভর করে তার আখিরাতের সফলতা।
অনাড়ম্বর জীবন যাপন
হারাম থেকে বেঁচে, হালালের গণ্ডিতে থেকে, কারো কাছে হাত না পেতে এবং ঋণগ্রস্ত না হয়ে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মতো অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করে। জীবন ধারণের প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলেও উত্তরোত্তর অর্থ-সম্পদের পেছনে দৌড়ানোকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করে।
এক শ্রেণীর লোক অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়া, রকমারী বিলাস সামগ্রী সংগ্রহ করা এবং প্রতিপত্তিশালী হওয়ার জন্য অহর্নিশ মেতে থাকে। বিস্ময়ের ব্যাপার, তাদের এই চাওয়ার কোন শেষ নেই। ‘আরো চাই, আরো চাই’- এই যেন তাদের চিন্তা-চেতনার সারকথা। এই মনোভংগিকেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন “আত্ তাকাসুর” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন,
أَلْهكُمُ التَّكَاثُرُ. حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ [সূরা আত্ তাকাছুর : ১, ২]
“আধিক্যের মোহ তোমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে যেই পর্যন্ত না তোমরা কবরে পৌঁছ।”
এই মনোভংগি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَوْ كَانَ لاِبْنِ ادَمَ وَادِياَنِ مِنْ ذَهَبٍ لاَحَبَّ اَنْ يَكُوْنَ لَه ثاَلِتٌ وَلاَ يَمْلَءَ فَاهُ اِلاَّ التُّرَابُ.
[আনাস ইবনু মালিক (রা), সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ।]
“আদম সন্তান যদি দুইটি স্বর্ণ ভরা উপত্যকা লাভ করে, তবুও সে তৃতীয় আরেকটি লাভ করতে চাইবে। মাটি ছাড়া আর কিছুই তার মুখ ভরতে পারে না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَا ذِئْباَنِ جاَئِعاَنِ اُرْسِلاَ فِىْ غَنَمٍ بِاَفْسَدَ لَهاَ مِنْ حَرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْماَلِ وَالشَّرْفِ لِدِيْنِهِ [কা‘ব ইবনু মালিক (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“অর্থ-সম্পদের লোভ এবং অভিজাত হওয়ার লালসা একজন ব্যক্তির দীনদারীর জন্য এত বেশি ক্ষতিকর যে বকরীর পালে পতিত দুইটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘও বকরীর পালের এত বেশি ক্ষতি করতে পারে না।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
لَيْسَ لاِبْنِ ادَمَ حَقٌّ فِىْ سِوى هذِهِ الْخِصاَلِ بَيْتٌ يَسْكُنُهُ وَثَوْبٌ يُّوارِىْ عَوْرَتَهُ وَجِلْفُ الْخُبْزِ وَالْمَاءِ.
[উসমান ইবনু আফফান (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“আদম সন্তানের এই কয়টা বস্তু ছাড়া আর কিছুর অধিকার নেই। বসবাসের জন্য একটি ঘর, লজ্জা নিবারণের জন্য কিছু কাপড় এবং কিছু রুটি ও পানি।” অর্থাৎ এইগুলো মানুষের প্রকৃত মৌলিক প্রয়োজন।
অন্যত্র আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مِنْ سَعاَدَةِ الْمَرْءِ الْمَسْكَنُ الْوَاسِعُ وَالْجَارُ الصَّالِحُ وَالْمَرْكَبُ الْهَنِيْئُ.
[নাফে ইবনু আবদিল হারিস (রা), মুসনাদে আহমাদ]
“কোন ব্যক্তির কতক সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ঃ প্রশস্ত বসত ঘর, নেক প্রতিবেশী এবং আরামপ্রদ বাহন।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
قَدْ اَفْلَحَ مِنْ اَسْلَمَ وَكَانَ رِزْقُهُ كَفَافاً وَقَنَّعَهُ اللهُ بِمَا اتَاهُ.
[আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস (রা), সহীহ মুসলিম]
“সেই ব্যক্তি সফল যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, প্রয়োজন মাফিক রিয্ক পেয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দিয়েছেন।”
আহওয়াছ (রা) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন,
اَتَيْتَ رَسُوْلَ اللهِ (ص) وَ عَلَىَّ ثَوْبٌ دُوْنٌ- فَقَالَ لِىْ اَلَكَ مَالٌ؟ فَقُلْتُ نَعَمْ- قَالَ مِنْ اَىِّ الْمَالِ؟ قُلْتُ مِنْ كُلِّ الْمَالِ- قَدْ اَعَطَانِىْ اللهُ مِنَ الابِلِ وَالْبَقَرِ وَالْغَنَمِ وَالْخَيْلِ وَالرَّقِيْقِ- قَالَ فَاِذَا اتَاكَ مَالاً فَلْيُرَ اَثَرُ نِعْمَةِ اللهِ عَلَيْكَ.[আহওয়াছ (রা), মিশকাতুল মাছাবীহ]
“আমি একবার খুবই নিুমানের পোশাক পরে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি ধন-সম্পদ আছে?” আমি বললাম, “হাঁ, আছে।” তিনি বললেন, “কি কি ধরনের ধন-সম্পদ আছে?” আমি বললাম, “সব রকমের ধন-সম্পদ। উট, গাভী, বকরী, ঘোড়া এবং দাস-দাসী।” তিনি বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তোমার অবয়বে তার নিয়ামাতের প্রকাশ পাওয়া উচিত।”
একজন ব্যক্তিকে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন অর্থ-সম্পদ দান করা সত্ত্বেও সে ফকিরের মতো জীবন-যাপন করবে এটাও অভিপ্রেত নয়।
কিন্তু নিজের অবয়বে আল্লাহর নিয়ামাতের প্রকাশ ঘটানোর অর্থ- বিলাসী জীবন-যাপন নয়। বিলাস-ব্যসন পরিহারকরণ এবং অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের তাকিদ দিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
اِيَّاكَ وَالتَّنَعُّمَ فَاِنَّ عِبَادَ اللهِ لَيْسُوْا بِالْمُتَنَعِّمِيْنِ.
[মুয়ায ইবন জাবাল (রা), মুসনাদে আহমাদ, সুনানু আল বাইহাকী]
“বিলাসিতা থেকে বেঁচে থেকো। অবশ্যই আল্লাহর বান্দারা বিলাসী হয় না।”
বাস্তব জীবনে দেখা যায়, বিলাসিতা থেকে জন্ম নেয় আরামপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা থেকে জন্ম নেয় অলসতা আর অলসতা থেকে জন্ম নেয় পরিশ্রমবিমুখতা।
বিলাসিতামুক্ত জীবন-যাপনের তাকিদ দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلاَ تَسْمَعُوْنَ اَلاَ تَسْمَعُوْنَ اِنَّ الْبَذَاذَةَ مِنْ الايِمَانِ اِنَّ الْبَذَاذَةَ مِنْ الايْمَانِ.
[আবু উমামা ইয়াস (রা), সুনানু আবী দাউদ]
“তোমরা কি শুনছো না। তোমরা কি শুনছো না। নিশ্চয়ই অনাড়ম্বর জীবন ঈমানের পরিচায়ক, নিশ্চয়ই অনাড়ম্বর জীবন ঈমানের পরিচায়ক।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন,
كُنْ فِى الدَّنْيَا كَاَنَّكَ غَرِيْبٌ اَوْ عَابِرِ سَبِيْلٍ.
[আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), সহীহ আল বুখারী]
“তুমি দুনিয়াতে একজন মুসাফির কিংবা একজন পথচারীর মতো হয়ে থাক।”
আমরা জানি একজন মুসাফির কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্যই সফরে যান। তিনি অল্প ক’দিনের জন্য সফরে যান। তিনি সহজে বহনযোগ্য অত্যাবশ্যক বোঝা সাথে নেন।
এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হাসিলের জন্য। এখানে তার অবস্থানও হাতে গোনা ক’টি দিনের জন্য।
ডাক পড়লেই তাকে তৎক্ষণাত এখান থেকে চলে যেতে হয়।
অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান মুসাফিরের মতোই।
অর্থাৎ তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের বোঝা বহন করার প্রয়োজন নেই।
সফরটা মোটামুটি স্বচ্ছন্দ হওয়ার মতো পাথেয় থাকাই যথেষ্ট।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
فَوَ اللهِ مَا الْفَقْرَ اَخْشى عَلَيْكُمْ وَلكِنِّى اَخْشى اَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوْهَا كَمَا تَنَافَسُوْهَا فَتُلْهِكَكُمْ كَمَا اَهْلَكَتْهُمْ.
[আমর ইবনু আওফ আলআনছারী (রা), সহীহ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম]
“আল্লাহর কসম, তোমাদের জন্য আমি দারিদ্রের ভয় করছি না, বরং ভয় করছি যে তোমাদের সামনে পার্থিব প্রাচুর্য প্রসারিত করা হবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য করা হয়েছিলো। অতপর তোমরা পার্থিব প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতায় লেগে যাবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা লেগেছিলো এবং এটি তোমাদেরকে ধ্বংস করবে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করেছিলা।”
উল্লেখ্য যে, কম পাওয়ার বেদনা মানুষকে দারুণভাবে পীড়ন করে। কিন্তু অল্পে তুষ্টি এই বেদনা দূর করে দেয়। মানুষের মাঝে প্রচণ্ড ভোগের আকাংখা বিদ্যমান। এই আকাংখার যেন নিবৃত্তি নেই, শেষ নেই। কিন্তু অল্পে তুষ্টি এই আকাংখা নিয়ন্ত্রণ করে। ভোগবাদ এক মহা আপদ। ভোগবাদের খপ্পরে পড়ে মানুষ উ™£ান্তের মতো ছুটতে থাকে। অল্পে তুষ্টি এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়।
অর্থাৎ অল্পে তুষ্টি এক অসাধারণ গুণ। এই গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব অনাড়ম্বর জীবন-যাপন।
অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের
কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
১। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) :
মানব-শ্রেষ্ঠ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন অনাড়ম্বর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
মাক্কায় অবস্থানকালে নবুওয়াত লাভের পূর্বে ব্যবসায়ে নিয়োজিত হয়ে তিনি সচ্ছলতার অধিকারী হন। তাঁর উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ ব্যয়িত হতো অভাবী ও দুঃখী মানুষের কল্যাণে। নবুওয়াত লাভের পর তিনি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এমতাবস্থায় ব্যবসা চালানো ছিলো সুকঠিন। তদুপরি আদ্দা‘ওয়াতু ইলাল্লাহ এবং নও মুসলিমদের তা‘লীম ও তারবিয়াতে তাঁর বেশিরভাগ সময় ব্যয় হতে থাকে।
ঈসায়ী ৬২২ সনে তিনি ইয়াসরিবে হিজরাত করেন। ইতোমধ্যে সেখানে ইসলামের পক্ষে জনমত গড়ে উঠেছিলো। তাঁর আগমনের পর ইয়াসরিব একটি নগর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর নাম হয় আলমাদীনা। এই নব গঠিত রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি বৈধভাবেই বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
তিনি সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
তিনি বসবাস করতেন ছোট্ট ঘরে। তাঁর ঘরটি ছিলো আসবাবপত্রের বাহুল্য মুক্ত। তিনি ব্যবহার করতেন চামড়ার তৈরি একটি বিছানা। এর ভেতরে ছিলো খেজুর গাছের ছোবড়া।
তিনি ভুরি-ভোজ পছন্দ করতেন না।
ঠেসে ঠেসে পেট ভর্তি করে খাবার খেতেন না। তবে দুধ ও মধু খুব পছন্দ করতেন।
তিনি চোখে সুরমা লাগাতেন।
আতর ব্যবহার করতেন।
তিনি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরতেন না।
কোন কোন সময় ভিন্ন রঙের পোশাক পরলেও সাদা রঙের পোশাকই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।
তাঁর বহু সংখ্যক কাপড়-চোপড় ছিলো না। ফলে এইগুলো ভাঁজ করে ¯তূপ করে রাখার প্রয়োজন পড়তো না।
রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
২। আবু বাকর আছ্ছিদ্দিক (রা) :
আবু বাকর আছ্ছিদ্দিক (রা) ছিলেন মাক্কার সেরা ব্যবসায়ীদের একজন। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর সঞ্চয় ছিলো চল্লিশ হাজার দিরহাম। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগেকার একজন মানুষের হাতে চল্লিশ হাজার দিরহাম থাকাটা কোন ছোট্ট ব্যাপার ছিলো না।
ইসলাম গ্রহণ করার পর বিরোধীদের সৃষ্ট প্রতিকূলতার কারণে তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে ওঠে।
অথচ পরিবার থেকে বিতাড়িত নওমুসলিমদের পুনর্বাসন এবং নির্যাতিত দাস-দাসিদের মুক্তির জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। হিজরাতের সময় দেখা গেলো তাঁর হাতে বাকি আছে আর মাত্র পাঁচ হাজার দিরহাম। আর মাদীনায় এসে তিনি আবার ব্যবসাতে মনোযোগ দেন। তবে ব্যবসালব্ধ অর্থের বেশিরভাগ তিনি আদ্দাওয়াতু ইলাল্লাহ, আল জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ এবং বহুবিধ জনহিতকর খাতে ব্যয় করতেন।
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওফাতের পর তিনি আল মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হন।
রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাবার জন্য ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান।
প্রবীণ ছাহাবীগণ তাঁকে এর থেকে বিরত রাখেন। তাঁরা তাঁর জন্য বাইতুল মাল থেকে একটি ভাতা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন।
তিনি বছরে মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম নিতে রাজি হন।
তিনি খুবই সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
বাইতুল মাল থেকে তিনি বছরে দুই সেট পোশাক পেতেন। এতেই তিনি পরিতৃপ্ত ছিলেন।
মৃত্যুকালে তিনি একজন দাসি এবং দুইটি উটনি ছাড়া আর কোন সম্পদ রেখে যান নি।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ওয়াছিয়াত করে যান, মৃত্যুর পর যেন তাঁর পরনের কাপড়টি ধুয়ে তার সাথে আরো দুই টুকরো কাপড় মিলিয়ে তাঁর কাফন দেয়া হয়।
৩। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) :
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ছিলেন মাক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একজন। আল মাদীনায় হিজরাত করে আসার পর তিনি নতুন ভাবে ব্যবসা শুরু করেন। মুনাফার টাকার বিরাট অংশ আদ্দাওয়াত, আল জিহাদ ও খিদমাতে খালকে ব্যয় করতেন।
আবু বাকর আছ্ছিদ্দিকের (রা) ওফাতের পর তিনি আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। যুগপৎ রাষ্ট্র পরিচালনা ও ব্যবসা চালানো খুবই কঠিন ছিলো। তথাপিও তিনি কয়েক বছর পর্যন্ত বাইতুল মাল থেকে ভাতা নিতে রাজি হননি। রাষ্ট্রীয় কাজের চাপে যখন ব্যবসাতে সময় দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন তিনি ভাতা গ্রহণে রাজি হন। তাও বছরে মাত্র আটশত দিরহাম। হিজরী ১৫ সনে বাইতুল মাল বেশ সমৃদ্ধ হয়। তখন সকলকেই ভালো পরিমাণ ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়। এই সময় তিনি বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নিতে সম্মত হন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবু বাকর আছ্ছিদ্দিকের (রা) মতোই ছিলো তাঁর জীবনধারা।
তিনি সাধারণ খাবার খেতেন।
কম সংখ্যক পোশাক পরতেন।
৪। উসমান ইবনু আফফান (রা) :
উসমান ইবনু আফফান (রা) ছিলেন মাক্কার সফল ব্যবসায়ীদের একজন। ইসলাম গ্রহণ করার পর বিরুদ্ধবাদীদের সন্ত্রাসের কারণে তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
আল মাদীনায় হিজরাতের পর তিনি আবার ব্যবসা সংগঠিত করেন। আল্লাহ তাঁর ব্যবসাতে বারাকাত দিতেন। তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতেন।
তুলনামূলকভাবে তিনি ভালো পোশাক পরতেন এবং ভালো খাবার খেতেন। কিন্তু তিনিও বিলাসী জীবন যাপন করতেন না।
তাঁর উপার্জিত অর্থের বিরাট অংশ আদ্দাওয়াত, আল জিহাদ ও জনহিতকর খাতে ব্যয়িত হতো।
মসজিদে নববী সম্প্রসারণের জন্য পার্শ্ববর্তী জমি কিনে তিনি তা ওয়াক্ফ করে দেন।
তখন আল মাদীনায় পান যোগ্য পানির বড়ো অভাব ছিলো। এক ইয়াহুদীর মালিকানাধীন রুমা কূপের পানি ছিলো পানযোগ্য। সেই ইয়াহুদী বিনা পয়সায় এক গ্লাস পানি কাউকে দিতো না।
উসমান (রা) আঠারো হাজার দিরহামের বিনিময়ে সেই কূপ কিনে নেন এবং জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন।
তাবুক যুদ্ধের ত্রিশ হাজার যোদ্ধার মধ্যে দশ হাজার যোদ্ধার যাবতীয় ব্যয় ভার তিনি বহন করেন।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাহাদাতের পর তিনি আল মাদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হন। বাইতুল মাল থেকে নির্ধারিত ভাতা তিনি গ্রহণ করতেন। কিন্তু নিজে ভোগ না করে অভাবী লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন।
৫। আলী ইবনু আবী তালিব (রা) :
আলী ইবনু আবী তালিব (রা) ব্যবসায়ী পিতার সন্তান ছিলেন। দশ বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করে তিনি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সান্নিধ্যে থাকা অব্যাহত রাখেন। ব্যবসার দিকে তাঁর মন ছিলনা। অংশ অংশ করে আল কুরআন নাযিল হচ্ছিলো। আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে শুনে শুনে তিনি তা মুখস্থ করে নিতে থাকেন। নবী গৃহেই তিনি অবস্থান করতেন।
নবীর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথেই তিনি পানাহার করতেন।
আল মাদীনায় হিজরাত করে আসার পরও আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথেই তিনি বসবাস করতে থাকেন।
বদর যুদ্ধের পর তিনি আল্লাহর রাসূলের (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যা ফতিমাকে (রা) বিয়ে করেন। এবার তাঁকে আলাদা ঘর নিতে হয়। আয়-রোজগারের কথা ভাবতে হয়। টুকটাক কাজ করে তিনি যা কিছু পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন।
কখনো কখনো তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ পেতেন।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে বাইতুল মাল সমৃদ্ধ হলে তাঁর জন্য বার্ষিক পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা নির্ধারিত হয়।
তিনি ছিলেন খুবই দানশীল।
কোন সাহায্যপ্রার্থীকে তিনি খালি হাতে ফেরাতেন না। ফলে কখনো কখনো সপরিবারে অভুক্ত থাকতেন।
উসমান ইবনু আফফানের (রা) শাহাদাতের পর তিনি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার পরও তাঁর জীবনধারায় কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
তিনি কম সংখ্যক পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
কখনো কখনো তাঁর গায়ে তালি দেয়া পোশাক শোভা পেতো।
শাহাদাতকালে তিনি রেখে যান নগদ মাত্র সাতশত দিরহাম।
৬। আয্যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) :
আয্যুবাইর ইবনুল আওয়ামও (রা) মাক্কার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। আলমাদীনায় আসার পর নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন।
ব্যবসা থেকে তিনি প্রচুর মুনাফা অর্জন করতেন। মুনাফার একটি অংশ তিনি পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করতেন। বাকি অংশ লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
তাঁর মালিকানাধীন দাসের সংখ্যা ছিলো এক হাজার।
এরা প্রতিদিন অর্থ উপার্জন করতো এবং তাদের মালিকের হাতে তুলে দিতো। দাসদের উপার্জিত সমুদয় অর্থ তিনি কম বিত্তবান লোকদের মধ্যে বিলি করে দিতেন।
তিনি অনাড়ম্বর পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
৭। তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা) :
তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা) ছিলেন মাক্কার সফল ব্যবসায়ীদের একজন। হিজরাত করে আলমাদীনায় এসে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাতে সফলতাও অর্জন করেন।
ব্যবসালব্ধ অর্থের সামান্য অংশ পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে ব্যয় করতেন। বাকি অংশ দান করে দিতেন।
একদিন সন্ধ্যাবেলা হাজরামাউত থেকে ব্যবসার মুনাফার সত্তর হাজার দিরহাম তাঁর হাতে আসে। রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি ছটফট করতে থাকেন। কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না।
তাঁর স্ত্রী কারণ জানতে চান।
জওয়াবে তিনি বলেন, “সেই সন্ধ্যা থেকে ভাবছি, এতগুলো দিরহাম ঘরে রেখে ঘুমুলে একজন মানুষের তার রবের প্রতি কি ধারণা পোষণ করা হয়।”
স্ত্রী বলেন, “এতো চিন্তিত হওয়ার কি আছে? এতো রাতে আপনি গরীব-মিসকীন পাবেন কোথায়? সকাল হলেই বণ্টন করে দেবেন।”
স্ত্রীর কথায় তিনি শান্ত হন।
স্বচ্ছন্দে রাত কাটান।
ভোর না হতেই অনেকগুলো থলে এনে দিরহামগুলো ভাগ করে গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
তালহা (রা) প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন।
কিন্তু জীবনে বিলাসিতার ছোঁয়া লাগতে দেননি।
৮। সায়ীদ ইবনু আমের আলজুমাহী (রা) :
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) শাসনকালে সায়ীদ ইবনু আমের আলজুমাহী (রা) হিম্স নামক স্থানে গভর্নর নিযুক্ত হন। গভর্নর হয়েও তিনি একটি ছোট্ট ঘরে বসবাস করতেন।
উল্লেখযোগ্য কোন আসবাব ছিলোনা তাঁর ঘরে।
তিনি সাধারণ পোশাক পরতেন।
সাধারণ খাবার খেতেন।
একবার হিম্স থেকে একদল লোক আসে আলমাদীনায়। তাঁরা রাষ্ট্রপ্রধান উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সাথে দেখা করেন। তিনি তাঁদেরকে হিম্সের গরীব মানুষদের একটি তালিকা তৈরি করে দিতে বলেন। তাঁরা পরস্পর আলাপ করে একটি তালিকা তৈরি করে উমারের (রা) হাতে দেন।
তালিকার প্রথম নামটি ছিলো, ‘সায়ীদ ইবনু আমের।’
উমার (রা) জানতে চান, “এ কোন সায়ীদ?”
হিম্সবাসীগণ জানান যে, এই সায়ীদ হচ্ছেন তাঁদের গভর্নর।
তাঁর জীবনযাত্রার বিশদ বিবরণ শুনে তিনি তাঁর জন্য এক হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) বরাদ্দ করেন। অন্যদের জন্যও স্বতন্ত্র বরাদ্দ দেন। হিম্সবাসীগণ ফিরে গিয়ে সকলকে তাদের থলে বুঝিয়ে দিয়ে গভর্নরের কাছে তাঁর জন্য প্রেরিত থলেটি নিয়ে যান। থলে খুলে দীনারগুলো দেখেই তিনি বলে ওঠেন, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
তাঁর মুখে এই কথা শুনে স্ত্রী দরওয়াজার কাছে এসে জানতে চান, “আমীরুল মুমিনীন কি মারা গেছেন?” সায়ীদ বললেন, “না, আমার আখিরাত বরবাদ করার জন্য দুনিয়া আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। আমার ঘরে বিপদ এসে পড়েছে।” স্ত্রী বললেন, “বিপদটা দূর করে দিন।” সায়ীদ বললেন, “এই ব্যাপারে তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?” স্ত্রী বললেন, “অবশ্যই।”
অতপর সায়ীদ দীনারগুলো ভাগ করে কয়েকটি থলেতে ভরে হিম্সের দরিদ্র ব্যক্তিদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ইসলামের সোনালী যুগে অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন বহু সংখ্যক মানুষ। তাঁরা জাঁকজমক পছন্দ করতেন না। বিলাসিতাকে তাঁরা তাঁদের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না।
আখিরাতের জীবনের সফলতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো বলেই তাঁরা দুনিয়ার প্রতি এমন নির্মোহ হতে পেরেছিলেন।
আখিরাতের সফলতাই প্রকৃত সফলতা
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لَتَرْكَبُنَّ طَبَقًا عَن طَبَقٍ [সূরা আল ইনশিকাক : ১৯]
“তোমরা অবধারিতভাবে একটি পর্যায় থেকে আরেকটি পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছো।”
একজন মানুষ জীবনের সূচনার পর থেকে শুরু করে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করে। অবশেষে তাকে দুনিয়ার জীবন শেষ করে কবরে পৌঁছতে হয়। এইভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কবরের বাসিন্দা হতে থাকে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন পৃথিবী ও আসমান ভেংগে দেওয়ার ক্ষণ উপস্থিত হবে। ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়ে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। মহাকাশের সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়বে। সবকিছু ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে।
এরপর আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নির্দেশে নতুন আকারে, নতুন রূপে, নতুন বিন্যাসে পৃথিবী ও আসমান আবার অস্তিত্ব লাভ করবে।
يَوْمَ تُبَدَّلُ الأَرْضُ غَيْرَ الأَرْضِ وَالسَّمواتُ [সূরা ইবরাহীম : ৪৮]
“সেই দিন পৃথিবী ও আসমানকে পরিবর্তিত করে নতুন আকার দেওয়া হবে।”
নতুনভাবে গড়া পৃথিবী হবে আজকের পৃথিবী থেকে অনেক বড়। নতুন পৃথিবীতে কোন সাগর-মহাসাগর থাকবে না। পাহাড়-পর্বত থাকবে না। গাছ-গাছালি থাকবে না। কোন ঘরদোর থাকবে না। গোটা পৃথিবী হবে একটি ধূসর সমতল প্রান্তর।
فَيَذَرُهَا قَاعًا صَفْصَفًا .لَا تَرى فِيْهَا عِوَجًا وَلَا أَمْتًا [সূরা তা-হা : ১০৬, ১০৭]
“অতপর এই পৃথিবীকে এক সমতল ধূসর প্রান্তরে পরিণত করা হবে। তুমি এতে উঁচু নিচু কিছু ও সংকোচন দেখতে পাবে না।”
“আলকাউসার” নামে একটি জলাধার হবে একমাত্র ব্যতিক্রম। নতুন পৃথিবী পৃষ্ঠে “আলকাউসার” ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না।
এই বিশাল ধূসর প্রান্তরে জীবিত করে ওঠানো হবে সকল মানুষকে।
فَإِذَا هُم قِيَامٌ يَنظُرُونَ .وَأَشْرَقَتِ الْأَرْضُ بِنُورِ رَبِّهَا وَوُضِعَ الْكِتَابُ
[সূরা আয্ যুমার : ৬৮, ৬৯]
“অতপর তারা উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে থাকবে। পৃথিবী তার রবের নূরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। আমলনামা (প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে মুতায়েন দুইজন ফেরেশতা কর্তৃক তৈরি ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের বিবরণ) সামনে আনা হবে।”
চারদিকে আল্লাহর নূরের উদ্ভাসন দেখে প্রত্যেকেই বুঝবে, দুনিয়ার জীবনে আখিরাতের যেই আদালতে উপস্থিত হওয়া সম্পর্কে তাদেরকে জ্ঞাত করা হয়েছিলো, তারা সেই আদালতে উপস্থিত হয়ে গেছে।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে ঘোষণা হবে,
اقْرَأْ كتَابَكَ كَفى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْبًا [সূরা বানী ইসরাঈল : ১৪]
“তোমার আমলনামা পড়। তুমিই আজ তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমলনামা পড়বে। আর দেখবে তার কৃত কণা পরিমাণ নেক আমলের বিবরণ সেখানে আছে। আবার কণা পরিমাণ বদ আমলের বিবরণও আছে। “কিরামান কাতিবীন” (সম্মানিত লেখকবৃন্দ) কোন কিছু বাড়িয়েও লেখেন নি, কোন কিছু কমিয়েও লেখেন নি। প্রতিটি কাজের বিবরণ নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
অতপর শুরু হবে জিজ্ঞাসাবাদ। আল্লাহর প্রতিনিধি (খালীফা) ও আল্লাহর বান্দা (আবদ) হিসেবে দুনিয়ার জীবনে তাদের ওপর যেইসব কর্তব্য অর্পিত ছিলো, সেইগুলো সম্পন্ন করা সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
কোন কোন অপরাধী ব্যক্তি ধৃষ্টতা দেখাবে। তারা তাদের অতসব পাপের ফিরিস্তির বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করতে চাইবে। তখন আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন দ্বিতীয় প্রকারের সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করবেন।
আল্লাহর নির্দেশ লাভ করে তাদের প্রত্যংগগুলো তাদের কৃত কাজের বিবরণ পেশ করা শুরু করবে।
وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيْهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ. [সূরা ইয়া-সীন :৬৫]
“এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে। তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।”
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ.
[সূরা আন্ নূর : ২৪]
“সেই দিন তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।”
شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُوْدُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ .
[সূরা হামীমুস্ সাজদা : ২০]
“তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের ত্বক (চামড়া) সাক্ষ্য দেবে তারা কী কী করেছিলো।”
إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُوْلاً
[সূরা বানী ইসরাঈল : ৩৬]
“নিশ্চয়ই তাদের কান, চোখ ও অন্তরকে জওয়াবদিহি করতে হবে।”
وَإِن تُبْدُواْ مَا فِيْ أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوْهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اللهُ.
[সূরা আল বাকারা : ২৮৪]
“আর তোমাদের মনের কথা তোমরা প্রকাশ কর অথবা গোপন কর, আল্লাহ অবশ্যই সেই সম্পর্কে হিসাব নেবেন।”
এই জিজ্ঞাসাবাদ হবে সূক্ষ্ম, দীর্ঘ ও ব্যাপক।
এক পর্যায়ে ব্যক্তির “আমালে ছালেহ” সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। কোন্ আমল কোন্ অভিপ্রায়ে বা নিয়াতে করা হয়েছিলো তা বিশ্লেষণ করা হবে।
উল্লেখ্য যে “ইখলাছুন্নিয়াত” বা নিয়াতের বিশুদ্ধতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। “ইখলাছুন্নিয়াত” সহকারে করা না হলে কোন আমালে ছালেহকে আল্লাহ স্বীকৃতি দেন না।
একদিন এক ব্যক্তি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেসা করলো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা খ্যাতি অর্জনের জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকি। এতে কি আমরা পুরস্কৃত হবো?” আল্লাহর রাসূল বললেন, “না।” লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের নিয়াত যদি আল্লাহর পুরস্কার এবং দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন- দুইটিই হয়?” আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “কোন আমল খালিছভাবে তাঁর জন্য করা না হলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।”
[ইয়াযিদ আর রাকাশী (রা), ইবনু মারদুইয়া]
ইখলাছুন্নিয়াতের অভাবে বড়ো বড়ো ত্যাগ-কুরবাণী আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কবুল করেন না।
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“শেষ বিচারের দিন প্রথম পর্বে এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে যে শহীদ হয়েছে। তাকে আল্লাহ প্রদত্ত সকল নিয়ামাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে এইসব নিয়ামাত প্রাপ্তি ও ভোগের কথা স্বীকার করবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, “এই সব নিয়ামাত পাওয়ার পর তুমি আমার জন্য কী করেছো?” সে বলবে, “আমি আপনার পথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি।” আল্লাহ বলবেন, “তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বীর রূপে আখ্যায়িত হওয়ার জন্য লড়াই করেছো। সেই খ্যাতি তুমি পেয়েছো।” অতপর তার সম্পর্কে ফায়সালা দেওয়া হবে, তাকে উপুড় করে পা ধরে টেনে-হেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।.....
অর্থাৎ আমালে ছালেহ গৃহীত হওয়ার পূর্ব শর্ত হচ্ছে ইখলাছুন্নিয়াত।
আদ্দাওয়াত, আলজিহাদ, আছ্ছালাত, আছ্ছাওম, আয্যাকাত, আলহাজ, ইনফাক, খিদমাতে খালক তথা সবকিছু একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের সন্তোষ অর্জনের জন্যই নিবেদিত হতে হবে।
আল্লাহর আদালতে বিশ্লেষণে যদি প্রমাণিত হয় যে মুমিন সকল আমালে ছালেহ একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্যই সম্পন্ন করেছে, তাহলে তার নাজাতের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে।
আল্লাহর আদালতে বিচার পর্ব শেষ হওয়ার পর কিছু মানুষের ঠিকানা হবে জাহান্নাম, আর কিছু মানুষের ঠিকানা হবে জান্নাত।
জাহান্নাম ঃ
জাহান্নাম কঠিন শাস্তির স্থান।
ভয়ংকর আকৃতির ফেরেশতারা সেখানে নিযুক্ত রয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা পাপীদের গলায় বেড়ি লাগিয়ে দেহে লোহার শিকল পেঁচিয়ে টেনে- হেঁচড়ে নিয়ে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
জাহান্নামের আগুনের তেজ দুনিয়ার আগুনের তেজের চেয়ে সত্তর গুণ বেশি।
জাহান্নামে ঘন শ্বাসরুদ্ধকর ঝাঁঝালো ধোঁয়া আবর্তিত হচ্ছে।
জাহান্নামের নানাস্থানে বিশাল আকৃতির ভয়ংকর বিষধর সাপ রয়েছে।
জাহান্নামীদের দেহ হবে বিশাল আকৃতির। ফেরেশতারা ভারি গুর্জ দিয়ে আঘাত হেনে জাহান্নামীদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকবে। জাহান্নামীরা ভীষণ চিৎকার করতে থাকবে।
আগুনের উত্তাপে ও পিপাসায় তারা হাঁপাতে থাকবে।
তাদেরকে ভীষণ গরম পানি ও রক্ত-পুঁজ পান করতে দেওয়া হবে।
কাঁটাযুক্ত, তিক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত যাক্কুম গাছ গিলতে বাধ্য করা হবে।
আরো বহুবিধ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে জাহান্নামে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
“জাহান্নামের সবচে’ কম শাস্তি হবে তার যাকে আগুনের ফিতাযুক্ত একজোড়া জুতা পরানো হবে। এতেই তার মাথার মগজ জ্বলন্ত চুলার ওপর হাঁড়ির পানির মতো টগবগ করে ফুটতে থাকবে।” [সহীহ মুসলিম]
জান্নাত ঃ
জান্নাত অনাবিল সুখ-শান্তির স্থান।
ফেরেশতারা জান্নাতীদেরকে খোশ আমদেদ জানিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবেন।
জান্নাতের বাগানগুলো নয়নাভিরাম।
বাগানগুলো পাখ-পাখালিতে পূর্ণ।
চারদিকে ফুলের সমারোহ।
জান্নাতে প্রবাহিত হচ্ছে সুপেয় পনির ঝর্ণা, সুস্বাদু দুধের ঝর্ণা, স্বচ্ছ মধুর ঝর্ণা এবং উন্নতমানের পানীয়র ঝর্ণা।
জান্নাতে রয়েছে সুস্বাদু মাছ, গোশত, রকমারি খাদ্য এবং ফলের প্রাচুর্য।
জান্নাতে রয়েছে অনুপম উপাদানে তৈরি সারি সারি প্রাসাদ।
জান্নাতীদের জন্য আরামদায়ক পোশাক, শয্যা ও সুউচ্চ আসনের ব্যবস্থা রয়েছে।
জান্নাত আলো ঝলমল।
জান্নাতে রয়েছে অগণিত সৌন্দর্য-শোভার উপকরণ।
জান্নাতের প্রতিটি বস্তুতে রয়েছে তুলনাহীন সুঘ্রাণ।
জান্নাত উত্তাপ ও শীতের প্রকোপমুক্ত।
জান্নাতীদের দৈর্ঘ্য হবে ষাট হাত।
সকল জান্নাতী হবেন যুবক ও যুবতী।
তারা লাভ করবেন চিরস্থায়ী যৌবন।
জান্নাতে কারো অসুখ হবেনা।
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে অসাধারণ দৈহিক সৌন্দর্য দান করবেন।
তাদের দেহে থাকবে অনন্য সাধারণ সুঘ্রাণ।
জান্নাত মানুষের অনন্ত জীবন লাভ এবং বিশাল সম্পদ-সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার আকাংখা পূরণের স্থান।
প্রত্যেক জান্নতীকে জান্নাতের সুবিশাল অংশের মালিক বানিয়ে দেওয়া হবে।
আল্লাহ সবচে’ কম মর্যাদাবান জান্নাতীকেও বর্তমান পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ বেশি স্থান দেবেন।
وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيْمًا وَمُلْكًا كَبِيْرًا [সূরা আদ্ দাহর : ২০]
“এবং তুমি যেই দিকেই তাকাবে নিয়ামাত আর নিয়ামাতই দেখতে পাবে। আর দেখতে পাবে এক বিশাল সাম্রাজ্য।”
আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষমতা সীমাহীন।
তিনি নতুন নতুন নিয়ামাত সৃষ্টি করে জান্নাতীদেরকে উপহার দিতে থাকবেন।
لَهُمْ مَّا يَشَاؤُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ [সূরা কা-ফ : ৩৫]
“জান্নাতে তারা যা চাইবে, তা-ই পাবে। আর আমার পক্ষ থেকে আরো অনেক কিছু রয়েছে তাদের জন্য।
فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ [সূরা আস্ সাজদা : ১৭]
“তাদের চোখ জুড়াবার জন্য আমি যেইসব জিনিস গোপন করে রেখেছি তা তাদের কারোরই জানা নেই।”
اَعْدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّا لِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأتُ وَلاَ اُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلى قَلْبِ بَشَرٍ.[সহীহ আল বুখারী]
“(আল্লাহ বলেন,) আমি আমার ছালেহ বান্দাদের জন্য এমন এমন নিয়ামাত মওজুত করে রেখেছি যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, যার কথা কোন কান কখনো শুনেনি এবং যার ধারণা কোন হৃদয়ে কখনো উদিত হয়নি।”
আল্লাহ জান্নাতীদেরকে তাঁর দর্শন দান করে ধন্য করবেন।
যাঁর প্রতিনিধি (খালীফা) এবং বান্দা (আবদ) রূপে পৃথিবীতে কর্তব্য পালন করে তারা জান্নাতে স্থান পেলো, সেই আল্লাহকে দেখে তারা পরিতৃপ্ত হবে।
জান্নাতীদের কাছে সবচে’ বেশি আনন্দের বিষয় হবে আল্লাহর দর্শন।
জাহান্নামীরা জাহান্নামে এবং জান্নাতীরা জান্নাতে অবস্থান গ্রহণের পর মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে একজন ফেরেশতা ঘোষণা করবেন, ‘ওহে জান্নামীরা, আর মৃত্যু নেই। ওহে জান্নাতীরা, আর মৃত্যু নেই। সামনে তোমাদের অনন্ত জীবন।”
আখিরাতের মৃত্যুহীন জীবন সম্পর্কে আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لاَ يَذُوْقُوْنَ فِيْهَا الْمَوْتَ إِلاَّ الْمَوْتَةَ الْأُولى [সূরা আদ্ দুখান : ৫৬]
“প্রথম মৃত্যুর পর ওখানে তারা আর মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে না।”
আখিরাতের অনন্ত জীবনের ব্যর্থতাই প্রকৃত ব্যর্থতা। আবার, সেই অনন্ত জীবনের সফলতাই প্রকৃত সফলতা।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
لاَ يَسْتَوِيْ أَصْحَابُ النَّارِ وَأَصْحَابُ الْجَنَّةِ. أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمُ الْفَائِزُوْنَ
[সূরা আল হাশর : ২০]
“জাহান্নামের অধিবাসীরা এবং জান্নাতের অধিবাসীরা কখনো সমান হতে পারে না। জান্নাতের অধিবাসীরাই সফল।”
আখিরাতের অনন্ত জীবনের সফলতাকে সামনে রেখে দুনিয়ার জীবনের সঠিক ভূমিকা পালনের তাকিদ দিয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন,
وَسَارِعُواْ إِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّموَاتُ وَالأَرْضُ
[সূরা আলে ইমরান : ১৩৩]
“এবং তোমরা দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে যার বি¯তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বি¯তৃতির সমান।”
سَابِقُوْا إِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ
[সূরা আল হাদীদ : ২১]
“তোমরা প্রতিযোগিতা করে দ্রুত এগিয়ে চল তোমাদের রবের মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে যার বি¯তৃতি আসমান ও পৃথিবীর বি¯তৃতির সমান।”
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
اَلْكَيَّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَه وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ اَتْبَعَ نَفْسَه هَوَاهُ وَتَمَنَّى عَلَى اللهِ.[শাদ্দাদ ইবনু আউস (রা), জামে আত্ তিরমিযী]
“সেই ব্যক্তি বুদ্ধিমান যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের দিকে লক্ষ্য রেখে আমল করেছে। সেই ব্যক্তি নির্বোধ যে নিজকে নফসের হাতে সঁপে দিয়েছে, আবার আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশাও করছে।”
= সমাপ্ত =
লেখকঃ এ.কে.এম. নাজির আহমদ
March 19, 2025
প্রত্যেক মুসলমানই একথা ভালো করে জানে যে, দুনিয়ায় ইসলাম আল্লাহ তাআলার একটি সবচেয়ে বড় নিয়ামত। আল্লাহ তাআলা তাকে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত করে সৃষ্টি করেছেন এবং ইসলামের ন্যায় এত বড় একটা নিয়ামত তাকে দান করেছেন বলে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর শোকর আদায় করে থাকে। এমন কি, স্বয়ং আল্লাহ তাআলাও ইসলামকে মানুষের প্রতি সবচেয়ে বড় ও উৎকৃষ্ট নিয়ামত বলে ঘোষণা করেছেন। বলেছেন: “আজ আমি তোমাদের আনুগত্যের বিধান (জীবন বিধান) পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়েদা: ৩)
ক. মুসলমান হবার জন্য জ্ঞানের আবশ্যকতা
খ. মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য
গ. ভাববার বিষয়
ঘ. কালেমায়ে তাইয়্যেবার অর্থ
ঙ. পাক কালেমা ও নাপাক কালেমা
চ. কালেমায়ে তাইয়্যেবার প্রতি ঈমান আনার উদ্দেশ্য
•প্রত্যেক মুসলমানই একথা ভালো করে জানে যে, দুনিয়ায় ইসলাম আল্লাহ তাআলার একটি সবচেয়ে বড় নিয়ামত। আল্লাহ তাআলা তাকে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত করে সৃষ্টি করেছেন এবং ইসলামের ন্যায় এত বড় একটা নিয়ামত তাকে দান করেছেন বলে প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহর শোকর আদায় করে থাকে। এমন কি, স্বয়ং আল্লাহ তাআলাও ইসলামকে মানুষের প্রতি সবচেয়ে বড় ও উৎকৃষ্ট নিয়ামত বলে ঘোষণা করেছেন। বলেছেন: “আজ আমি তোমাদের আনুগত্যের বিধান (জীবন বিধান) পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়েদা: ৩)
•আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের প্রতি এই যে, অনুগ্রহ করেছেন, এর হক আদায় করা তাদের পক্ষে একান্ত কর্তব্য। কারণ যে ব্যক্তি অপরের অনুগ্রহের হক আদায় করে না, সে বড়ই অকৃতজ্ঞ। আর সবচেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা হচ্ছে মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার এ বিরাট অনুগ্রহের কথা ভুলে যাওয়া। এখন আপনারা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের হক কিভাবে আদায় করা যেতে পারে? তাহলে আমি তার উত্তরে বলব যে, আল্লাহ তাআলা যখন আপনাকে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাত করে সৃষ্টি করেছেন, তখন পূর্ণরূপে ও খাঁটিভাবে তার অনুগামী হতে পারলেই আল্লাহ তাআলার এ অনুগ্রহের হক আদায় হবে। আপনাকে যখন আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন, তখন তার এ অনুগ্রহ ও দয়ার হক আদায় করতে হলে আপনাকে খাঁটি মুসলমান হতে হবে। এছাড়া আপনি অন্য কোনো প্রকারে এবং কোনো উপায়েই তার এ মহান উপকারের “হক” আদায় করতে পারেন না। আর আপনি যদি এই “হক” আদায় করতে না পারেন বা না-করেন, তাহলে আপনি এ অকৃতজ্ঞতার জন্য মহা অপরাধী হবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকেই এ মহাপাপ হতে রক্ষা করুণ। আমীন।
•অতপর আপনারা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, পূর্ণ মুসলমান কিভাবে হওয়া যায়? তবে তার উত্তর খুবই বিস্তৃত ও লম্বা হবে। এ পুস্তকে আমি ক্রমশ এর এক একটি অংশ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে থাকবো। সর্বপ্রথম আমি এমন একটি বিষয় বলবো, মুসলমান হতে হলে যায় প্রয়োজন সকলের আগে এবং যাকে বলা যায় মুসলমান হওয়ার পথের প্রথম ধাপ।
একটু ধীরভাবে চিন্তা করে দেখুন যে, আপনারা সদা সর্বদা যে “মুসলিম” শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, এর অর্থ কি? মানুষ কি মায়ের গর্ভ হতেই ইসলাম ধর্ম সাথে করে নিয়ে আসে? মুসলিম ব্যক্তির পুত্র অথবা মুসলিম ব্যক্তির পৌত্র হলেই কি মসুলমান হওয়া যায়? ব্রাহ্মণের পুত্র হলেই যেমন ব্রাহ্মণ, চৌধুরীর পুত্র হলেই যেমন চৌধুরী এবং শুদ্রের পুত্র হলেই যেমন শুদ্র হওয়া যায়, তেমনি রূপে মুসলমান নামধারী ব্যক্তির পুত্র হলেই কি মুসলমান হতে পারে? “মুসলমান” কি কোনো বংশ বা কোনো শ্রেণীর নাম? ইংরেজ জাতির মধ্যে জন্ম হলেই ইংরেজ, চৌধুরী বংশে জন্মালেই চৌধুরী হয়, তেমনি মুসলমানরাও কি “মুসলমান” নামক একটি জাতির বংশে জন্মলাভ করেছে বলেই “মুসলমান” নামে অভিহিত হবে? আমার এসব প্রশ্নের উত্তরে আপনারা কি এটাই বলবেন না যে, “না”, “মুসলমান” তাকে বলে না। মায়ের গর্ভ হতেই মুসলমান হয়ে কেউ জন্মে না, বরং ইসলাম গ্রহণ করলেই মুসলমান হওয়া যায় এবং ইসলাম ত্যাগ করলেই মানুষ আর মুসলমান থাকে না-মুসলিম সমাজ হতে একেবারে খারিজ হয়ে যায়। যে কোনো লোক-যে ব্রাক্ষণ হোক কিংবা পাঠান হোক, ইংরেজ হোক অথবা আমেরিকান, বাঙ্গালী হোক অথবা হাবশী -সে যখন ইসলাম গ্রহণ করবে তখনই সে মুসলমান হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ব্যাক্তি “মুসলমান” সমাজে জন্মগ্রহণ করেও ইসলামের নিয়ম-কানুন ও বিধি বিধান পালন করে চলে না, সে মুসলমান রূপে গণ্য হতে পারে না; সে সৈয়দের পুত্রই হোক আর পাঠানের পুত্রই হোক তাতে কিছু আসে যায় না।
•আমার পূর্বোক্ত প্রশ্নগুলোর এ জবাব হতেই জানা গেল যে, আল্লাহ তাআলার বড় নিয়ামত মুসলমান হওয়ার নিয়ামত যা আপনি লাভ করেছেন, ওটা জন্মগত জিনিস নয়, তাকে আপনি মায়ের গর্ভ হতে জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই লাভ করতে পারেন না এবং আজীবন এর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করুন আর না-ই করুন তা আপনার সাথে নিজে নিজেই সর্বদা লেগে থাকবে- এমন জিনিসও তা নয়। এটা একটা চেষ্টালভ্য নিয়ামত; তা লাভ করতে হলে আপনাকে রীতিমত চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা-সাধনা করে যদি আপনি তা লাভ করেন, তবেই তাকে আপনি পেতে পারেন। -আর এর প্রতি যদি মোটেই খেয়াল না করেন, তবে এর সৌন্দর্য হতে বঞ্চিত হবেন (নাউযুবিল্লাহ)।
•অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ইসলাম গ্রহণ করলেই মানুষ মুসলমান হয়। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ কি? মুখে মুখে যে ব্যক্তি “আমি মুসলমান” বা “আমি মুসলমান হয়েছি” বলে চীৎকার করবে, তাকেই কি মুসলমান মনে করতে হবে? অথবা পূজারী ব্রাক্ষণেরা যেমন না বুঝে কতকগুলো সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করে, তেমনিভাবে আরবী ভাষায় কয়েকটি শব্দ না বুঝে মুখে উচ্চারণ করলেই কি মুসলমান হওয়া যাবে? ইসলাম গ্রহণ করার তাৎপর্য কি এটাই? উক্ত প্রশ্নের জবাবে আপনারা কি এটাই বলবেন না যে, ইসলাম গ্রহণের অর্থ এটা নয়। ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদত্ত শিক্ষা-দীক্ষা ও ব্যবস্থাকে বুঝে আন্তরিকতার সাথে সত্য বলে বিশ্বাস করা, জীবনের একমাত্র ব্রত ও আদর্শ হিসেবেই এটাকে গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী কাজ করা; ইসলাম গ্রহন করার তাৎপর্য এটাই। কাজেই যিনি এরূপ না করবেন তিনি মুসলমান হতে পারবেন না। আপনাদের এ জবাব হতে এটাই প্রকাশ পেল যে, প্রথমত ইসলাম জেনে ও বুঝে নেয়া এবং বুঝে নেয়ার পর তাকে কাজে পরিণত করার নাম ইসলাম গ্রহণ।
•কেউ কিছু না জেনেও ব্রাহ্মন হতে পারে, কারণ সে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছে, অতএব সে ব্রাহ্মণ থাকবে, কেউ কিছু না জেনেও চৌধুরী হতে পারে, যেহেতু সে চৌধুরীর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছে- চৌধুরীই সে থাকবে। কিন্তু ইসলামকে না জেনে কেউ মুসলমান হতে পারে না; কারণ মুসলমান ব্যক্তির ঔরসে জন্ম হলেই মুসলিম হওয়া যায় না- ইসলামকে জেনে-বুঝে বিশ্বাস করে কাজ করলেই তবে মুসলমান হওয়া যায়। চিন্তা করে দেখুন, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ও জীবনব্যবস্থা না জেনে তাকে বিশ্বাস করা ও তদনুযায়ী কাজ করা কিরূপে সম্ভব হতে পারে? আর না জেনে, না বুঝে এবং বিশ্বাস না করেই বা মানুষ মুসলমান হতে পারে কিরূপে? অতএব, বুঝা যাচ্ছে যে, মূর্খতা নিয়ে মুসলমান হওয়া ও মুসলমান থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। যারা মুসলমানের ঘরে জন্মলাভ করেছে, মুসলমান নামে যারা নিজেদের পরিচয় দেয় ও মুসলমান বলে দাবী করে তারা সকলেই প্রকৃতপক্ষে মুসলমান নয়। যিনি ইসলাম কি তা জানেন এবং বুঝে-শুনে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তিনিই মুসলমান। কাফের ও মুসলমানদের মধ্যে নামের পার্থক্য নয়। অতএব, একজনের নাম রামপ্রসাদ, এজন্য সে হিন্দু এবং আর একজনের নাম আবদুল্লাহ, অতএব সে মুসলমান-তা হতে পারে না। পরন্তু কাফের ও মুসলমানের মধ্যে শুধু পোশাকের পার্থক্যই আসল পার্থক্য নয়। কাজেই একজন ধূতি পরে বলে সে হিন্দু এবং অন্যজন পায়জামা বা লুঙ্গী পরে বলে সে মুসলমান বিবেচিত হতে পারে না। বরং মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে আসল পার্থক্য হচ্ছে উভয়ের ইলম বা জ্ঞানের পার্থক্য।
•এক ব্যক্তি কাফের এই জন্য যে, সে জানে না তার সৃষ্টিকর্তার সাথে তার কি সম্পর্ক এবং তার বিধান অনুসারে জীবন-যাপনের প্রকৃত পথ কোনটি? কিন্তু একটি মুসলমান সন্তানের অবস্থাও যদি এরূপ হয়, তবে তার ও কাফের ব্যক্তির মধ্যে কোন দিক দিয়ে পার্থক্য করা যাবে? এবং এ দু’জনের মধ্যে পার্থক্য করে আপনি একজনকে কাফের ও অপরজনকে মুসলমান বলবেন কেমন করে? কথাগুলো বিশেষ মনোযোগ সহকারে এবং ধীরভাবে ভেবে দেখা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলার যে মহান নিয়ামতের জন্য আপনারা শোকর আদায় করছেন, একে লাভ করা এবং রক্ষা করা এ দু’টি কাজই সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ইলম বা জ্ঞানের ওপর। ইলম বা জ্ঞান না থাকলে মানুষ তা পেতে পারে না- সামান্য পেলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা বড়ই কঠিন ব্যাপার। সবসময়ই তাকে হারিয়ে ফেলার আশংকা ও খুঁতখুঁতে ভাব মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে থাকে। মুসলমান না হয়েও এক শ্রেণীর লোক নিজেদের মুসলমান মনে করে, এর একমাত্র কারণ তাদের মূর্খতা। যে ব্যক্তি একেবারেই জানে না যে, ইসলাম ও কুফরের মধ্যে এবং ইসলাম ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য কি, সে তো অন্ধকারাচ্ছন্ন পথের পথিকের মত; সরল রেখার ওপর দিয়ে চলতে চলতে আপনা আপনি তার পা দু’খানা কখন যে পিছলিয়ে যাবে বা অন্য পথে ঘুরে যাবে, তা সে জানতেই পারবে না। জীবনের পথে চলতে চলতে সে সরল পথ হতে কখন যে সরে গিয়েছে, তা সে টেরও পাবে না। এমনও হতে পারে যে, পথিমধ্যে কোনো ধোঁকাবাজ শয়তান এসে তাকে বলবে- “মিয়া তুমি তো অন্ধকারে পথ ভুলে গিয়েছ, আমার সাথে চল, আমি তোমাকে তোমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেব।” বেচারা অন্ধকারের যাত্রী নিজের চোখে যখন সরল-সঠিক পথ দেখতে পায় না, তখন মূর্খতার দরুণই নিজের হাত কোনো দাজ্জালের হাতে সঁপে দিয়ে তার অনুসরণ করতে আরম্ভ করবে এবং সে তাকে পথভ্রষ্ট করে কোথা হতে কোথা নিয়ে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকবে না। তার নিজের তাতে আলো নেই এবং সে নিজে পথের রেখা দেখতে ও চিনে চলতে পারে না বলেই তো সে এতবড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তার কাছে যদি আলো থাকে, তবে সে পথও ভুলবে না, আর অন্য কেউও তাকে গোমরাহ করে বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না।
•এ কারণেই ধারণা করে নিতে পারেন যে, ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ হওয়া এবং পবিত্র কুরআনের উপস্থাপিত বিধান ও হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদত্ত শিক্ষা ভাল করে না জানা মুসলমান ব্যক্তির পক্ষে কতবড় বিপদের কথা! এ অজ্ঞতার কারণে সে নিজেও পথভ্রষ্ট হতে পারে এবং অপর কোনো দাজ্জালও তাকে বিপদগামী করতে পারে। কিন্তু যদি তার কাছে জ্ঞানের আলো থাকে তবে যে জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এবং প্রতি ধাপে ইসলামের সরল পথ দেখতে পাবে। প্রতি পদেই কুফরি, গোমরাহী, পাপ, জ্বেনা, হারামী প্রভৃতি যেসব বাঁকা পথ ও হারাম কাজ সামনে আসবে, তা চিনতে এবং তা হতে বেঁচে থাকতে পারবে। আর যদি কোনো পথভ্রষ্টকারী তার কাছে আসে তবে তার দু’চারটি কথা শুনেই তাকে চিনতে পারবে। এবং এ লোকটি যে পথভ্রষ্টকারী ও এর অনুসরণ করা যে কিছুতেই উচিত নয়, তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে।
•আমি যে ইলম বা জ্ঞানের কথা উল্লেখ করলাম, এর ওপরই আপনাদের ও আপনাদের সন্তান-সন্ততির মুসলমান হওয়া ও মুসলমান থাকা একান্তভাবে নির্ভর করে। এটা সাধারণ বস্তু নয়, একে অবহেলাও করা যায় না। কৃষক তার ক্ষেতখামারের কাজে অলসতা করে না, ক্ষেতে পানি দিতে এবং ফসলের হেফাজত করতে গাফলতি করে না, গরু-বাছুরগুলোকে ঘাস-কাটা দিতে অবহেলা করে না। কারণ এসব ব্যাপারে অলসতা করলে তার না খেয়ে মরার ও প্রাণ হারাবারও আশংকা রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হওয়া ও মুসলমান থাকা যে জ্ঞানের ওপর নির্ভর করছে, তা লাভ করতে মানুষ কেন এত অবহেলা করছে? এতে কি ঈমানের মত অতি প্রিয় ও মূল্যবান নিয়ামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় নেই? ঈমান কি প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় নয়? মুসলমানগণ প্রাণ রক্ষার ব্যাপারে যতটা সময় ব্যয় ও পরিশ্রম করে, এর দশ ভাগের এক ভাগও কি ঈমান রক্ষার কাজে ব্যয় করতে পারে না?
আপনারা প্রত্যেকে এক একজন মৌলভী হবেন, বড় বড় কিতাব পড়ে এবং জীবনের দশ বারোটি বছর কেবল পড়াশুনার কাজে ব্যয় করে মস্তবড় একজন আল্লামা হবেন, এমন কথা আমি বলছি না।
•মুসলমান হওয়ার জন্য এত কিছু পড়ার বা বড় কোনো ডিগ্রী লাভ করার কোনো আবশ্যকতা নেই। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আপনারা রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মাত্র এক ঘন্টা সময় দীনি এলম (ইসলামী বিদ্যা) শিখার কাজে ব্যয় করুন। অন্ততপক্ষে প্রত্যেক মুসলমান বালক, যুবক, বৃদ্ধ সকলেরই এতটুকু ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা দরকার, যা হতে তারা পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার উদ্দেশ্য জানতে পারবে, তা ভাল রূপে বুঝতে পারবে, তা ভালরূপে বুঝতে ও হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। আর হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব অন্যায় কুসংস্কার দূর করতে এবং সেই স্থানে যা স্থাপন করতে এসেছিলেন, তাও উত্তমরূপে জানতে পারবে এবং আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবন যাপনের জন্য যে বিশেষ নিয়মবিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তার সাথে তারা ভাল করে পরিচিত হতে পারবে। এটুকু ইলম হাসিল করার জন্য খুব বেশী সময়ের দরকার পরে না, আর ঈমান যদি বাস্তবিকই কারো প্রিয় বস্তু হয়, তবে এ কাজে একটা ঘন্টা মাত্র ব্যয় করা তার পক্ষে এতটুকুও কঠিন কাজ নয়।
•প্রত্যেক মুসলমান নিশ্চয়ই একথা জানে যে, মুসলমান ব্যক্তি মর্যাদা ও সম্মান কাফের ব্যক্তিদের অপেক্ষা অনেক উচ্চে। আল্লাহ তাআলা মুসলমানকে পছন্দ করেন এবং কাফেরকে অপছন্দ করেন। মুসলমানের গোনাহ ক্ষমা করা হবে কাফেরের অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। মুসলমান জান্নাতে যাবে এবং কাফের জাহান্নামে। কিন্তু মুসলমান এবং কাফেরের মধ্যে এতখানি পার্থক্য কেন হলো, সেই সম্বন্ধে একটু গভীরভাবে চিন্তা করা আবশ্যক।
•কাফের ব্যক্তিরা যেমন হযরত আদম আলাইহিস সালামের সন্তান, মুসলমানরাও তেমনি তাঁর সন্তান। মুসলমান যেমন মানুষ, কাফেররাও তেমনি মানুষ। মুসলমানদের মত তাদেরও হাত-পা, চোখ-কান সবই আছে। তারাও এ পৃথিবীর বায়ুতেই শ্বাস গ্রহণ করে, এ জমিনের উপর বাস করে এবং খাদ্য খায়। তাদের জন্ম এবং মৃত্যু মুসলমানদের মতোই হয়। যে আল্লাহ মুসলমানদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদেরকেও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তাহলে মুসলমানদের স্থান উচ্চে এবং তাদের স্থান নীচে হবে কেন? মুসলামান কেন জান্নাতে যাবে আর তারা কেন জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে? একথাটি বিশেষভাবে চিন্তা করে দেখা আবশ্যক। মুসলমাদের এক একজনের নাম রাখা হয়েছে আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান বা তদনুরূপ অন্য কোনো নাম, অতএব তারা মুসলমান। আর কিছু লোকের নাম রাখা হয়েছে দীননাথ, তারা সিং, রবার্টসন প্রভৃতি, কাজেই তারা কাফের ; কিংবা মুসলমানগণ খাৎনা করায়, আর তারা তা করায় না, মুসলমান গরুর গোশত খায়, তারা তা খায় না-শুধু এটুকু কথার জন্যই মানুষে মানুষে এতবড় পার্থক্য হতে পারে না। আল্লাহ তাআলাই যখন সমস্ত মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলকেই তিনি লালন-পালন করেন –তিনি এতবড় অন্যায় কখনও করতে পারেন না। কাজেই তিনি এ রকম সামান্য বিষয়ের কারণে মানুষে মানুষে এতবড় পার্থক্য করবেন এবং তাঁরই সৃষ্টি এক শ্রেণীর মানুষকে অকারণে দোযখে নিক্ষেপ করবেন-তা কিছুতেই হতে পারে না।
•বাস্তবিকই যদি তা না হয়, তবে উভয়ের মধ্যে আসল পার্থক্য কোথায় তা চিন্তা করে দেখতে হবে। বস্তুত উভয়ের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য কেবল মাত্র কুফরি ও ইসলামের । ইসলামের অর্থ-আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা এবং কুফরীর অর্থ আল্লাহকে অস্বীকার করা অমান্য করা ও আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হওয়া। মুসলমান ও কাফের উভয়ই মানুষ, উভয়ই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি জীব, তাঁরই আজ্ঞাবহ দাস। কিন্তু তাদের একজন অন্যজন অপেক্ষা এজন্য শ্রেষ্ঠ যে, একজন নিজের প্রকৃত মনিবকে চিনতে পারে, তাঁর আদেশ পালন করে এবং তাঁর অবাধ্য হওয়ার দুঃখময় পরিণামকে ভয় করে। কিন্তু অন্যজন নিজ মনিবকে চিনে না এবং তাঁর অবাধ্য হওয়ার দুঃখময় পরিণামকে ভয় করে না এবং তাঁর আদেশ পালন করে না, এজন্যই সে অধপাতে চলে যায়। এ কারণেই মুসলমানদের প্রতি অসন্তুষ্ট, মুসলমানকে জান্নাতে দেয়ার ওয়াদা করেছেন এবং কাফেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার ভয় দেখিয়েছেন।
•এর দ্বারা বুঝা গেল যে, মুসলমানকে কাফের হতে পৃথক করা যায় মাত্র দু’টি জিনিসের ভিত্তিতে: প্রথম, ইলম বা জ্ঞান; দ্বিতীয়, আমল বা কাজ। অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমাকে প্রথমেই জানতে হবে যে, তার প্রকৃত মালিক কে? কিসে তিনি সন্তুষ্ট হন আর কিসে তিনি অসন্তুষ্ট হন-এসব বিস্তৃতভাবে জেনে নেয়ার পর নিজেকে প্রকৃত মালিকের একান্ত অনুগত বানিয়ে দেবে, তাঁর মর্জিমত চলবে, নিজের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করবে। তার মন যদি “মালিকের” ইচ্ছার বিপরীত কোনো কামনা করে তবে সে নিজের মনের কথা না শুনে “মালিকের” কথা শুনবে। কোনো কাজ যদি নিজের কাছে ভালো মনে হয়, কিন্তু মালিক সে কাজটিকে ভালো না বলেন, তবে তাকে মন্দই মনে করবে।
•আবার কোনো কাজ যদি নিজের মনে খুব মন্দ বলে ধারণা হয়, কিন্তু “মালিক” তাকে ভালো মনে করেন এবং কোনো কাজ যদি নিজের পক্ষে ক্ষতিকর বলে মনে হয় অথচ “মালিক” যদি তা করার হুকুম দেন, তবে তার জান ও মালের যতই ক্ষতি হোক না কেন, তা সে অবশ্যই করবে। আবার কোনো কাজে যদি নিজের জন্য লাভজনক মনে করে, আর “মালিক” তা করতে নিষেধ করেন তবে তাতে দুনিয়ার সমস্ত ধন-সম্পত্তি লাভ করতে পারলেও তা সে কখনই করবে না। ঠিক এ ইলম ও এরূপ আমলের জন্যই মুসলমান আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাহ। তার উপর আল্লাহ তাআলার রহমত বর্ষিত হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে সম্মান দান করেন। কিন্তু উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে কাফের কিছুই জানে না এবং জ্ঞান না থাকার দরুনই তার কার্যকলাপও তদনুরূপ হয় না এ জন্য যে, সে আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ এবং তার অবাধ্য বান্দা । ফলত সে আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হবে।
•এ আলোচনার শেষকথা এই যে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, অথচ কাফেরের মতোই জাহেল বা অজ্ঞ এবং আল্লাহ তাআলার অবাধ্য এমতাবস্থায় কেবল নাম, পোশাক ও খানা-পিনার পার্থক্যের কারণে সে কাফের অপেক্ষা কোনোভাবেই শ্রেষ্ঠ হতে পারে না, আর কোনো কারণেই সে ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ তাআলার রহমতের হকদার হবে পারে না।
•ইসলাম কোনো জাতি, বংশ বা সম্প্রদায়ের নাম নয়। কাজেই বাপ হতে পুত্র এবং পুত্র হতে পৌত্র আপনা-আপনিই তা লাভ করতে পারে না। ব্রাহ্মণের পুত্র মূর্খ এবং চরিত্রহীন হলেও কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের পুত্র বলেই সে ব্রাহ্মণের মর্যাদা পেয়ে থাকে এবং উচ্চ বংশ বলে পরিগণিত হয়। আর চামারের পুত্র জ্ঞানী ও গুণী হয়েও নীচ ও হীন থেকে যায়। কারণ সে চামারের মত নীচ জাতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু ইসলামে এসব বংশ বা গোত্রীয় মর্যাদার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। এখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন: “তোমাদের মধ্যে যে লোক আল্লাহ তাআলাকে বেশী ভয় করে এবং সকলের অধিক তাঁর আদেশ পালন করে চলে সে-ই তাঁর কাছে অধিক সম্মানিত।” হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম একজন মূর্তি-পূজারীর ঘরে জন্ম লাভ করেছিলেন; কিন্তু তিনি আল্লাহ তাআলাকে চিনতে পেরে তাঁর আদেশ পালন করলেন; এ জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমস্ত জগতের নেতা বা ইমাম করে দিয়েছিল। হযরত নূহ আলাইহিস সালামের পুত্র একজন নবীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল; কিন্তু সে আল্লাহ তাআলাকে চিনতে পারল না বলে তার অবাধ্য হয়ে গেল।
•এজন্য তার বংশমর্যাদার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হলো না। উপরন্তু যে শাস্তি দেয়া হলো, সমস্ত দুনিয়া তা হতে শিক্ষা লাভ করতে পারে। অতএব বুঝে দেখুন, আল্লাহ তাআলার কাছে মানুষে মানুষে যা কিছু পার্থক্য হয়ে থাকে, তা কেবল ইলম ও আমলের জন্য মাত্র। দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর অনুগ্রহ কেবল তারাই পেতে পারে, যারা তাঁকে প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী চিনে এবং তার অনুসরণ করে।
•কিন্তু যাদের মধ্যে এ গুণ নেই, তাদের নাম আবদুল্লাহই হোক, আর আবদুর রহমান হোক, দীননাথই হোক, আর তারাসিং-ই হোক, আল্লাহ তাআলার কাছে এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই-এরা কেউই আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ পাবার অধিকার পেতে পারে না।
•মুসলমানগণ নিজেদের মুসলমান বলে মনে করে এবং মুসলমানের উপর আল্লাহ তাআলার রহমত বর্ষিত হয় বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু একটু চোখ খুলে চেয়ে দেখূন, আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ কি তাদের ওপর সত্যই নাযিল হচ্ছে? পরকালের কথা পরের জন্যই রইল, এই দুনিয়ায় মুসলমানদের যে দুরাবস্থা হচ্ছে তা-ই একবার খেয়াল করে দেখা আবশ্যক।
মুসলমান বাস্তবিকই যদি আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দাহ হতো তাহলে আল্লাহর সেই প্রিয়জনেরা দুনিয়ায় নানাভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে কেন? আল্লাহ কি যালেম (নাউযুবিল্লাহ)? মুসলমান যদি আল্লাহ তাআলার “হক” জানতো, তার আদেশ পালন করতো, তাহলে তিনি তার অবাধ্য বান্দাদেরকে মুসলমানদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করে দেবেন কেন? আর তাদেরকে তার আনুগত্যের বিনিময়ে শাস্তিইবা দেবেন কোন্ কারণে? আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই যালেম নন এবং তাঁর আনুগত্য করা বিনিময় অপমান ও শাস্তি নয়।
•একথা যদি একান্তভাবে বিশ্বাস করা হয় তবে স্বীকার করতেই হবে যে, মুসলমানদের মুসলমান হওয়ার দাবীতে কিছুটা গলদ আছে। তাদের নাম সরকারী দফতরে নিশ্চয়ই মুসলমান হিসেবে লিখিত আছে; কিন্তু সেই সরকারী দফতরের সার্টিফিকেট অনুসারে আল্লাহ তাআলার দরবারে বিচার হবে না। আল্লাহ তাআলার নিজস্ব দফতর রয়েছে এবং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই তাঁর দফতরে মুসলমানদের নাম তাঁর অনুগত লোকদের তালিকায় লিখিত আছে, না অবাধ্য লোকদের তালিকায় লিখিত হয়েছে তা খোঁজ করে দেখা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের কাছে কিতাব পাঠিয়েছেন, তা পড়ে মুসলমানগণ প্রকৃত “মালিক”-কে চিনতে পারে; কিন্তু ঐ কিতাবে যা লিখিত আছে, তা জানার জন্য মুসলমাগণ একটুও চেষ্টা করেছে কি? আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি নবী পাঠিয়েছেন, তিনি মুসলিম হওয়ার উপায় ও নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর নবী দুনিয়ায় এসে কি শিক্ষা দিয়েছেন, তা জনার জন্য তারা কখনও যত্নবান হয়েছে কি? আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে ইজ্জত লাভ করার পথের সন্ধান বলে দিয়েছেন, কিন্তু তারা সেই পথে চলছে কি? যেসব কাজ মানুষকে দুনিয়া ও আখেরাতে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে, আল্লাহ তাআলা তা এক এক করে বলে দিয়েছেন, কিন্তু মুসলমান কি সেসব কাজ ত্যাগ করেছে? এ প্রশ্নগুলোর কি উত্তর হতে পারে? যদি স্বীকার করা হয় যে, আল্লাহ তাআলার কিতার হতে মুসলমানগণ যেমন কোনো জ্ঞান লাভ করতে চেষ্টা করেনি, তেমনি তাঁর প্রদর্শিত পথেও তারা একটুও চলেনি, তাহলে তারা মুসলমান হলো কিরূপে এবং তারা পুরষ্কারই বা কিরূপে চাচ্ছে। তারা যে ধরনের মুসলমানীর দাবী করছে, ফলও তেমনি পাচ্ছে, আর তেমনি পুরস্কার তারা পরকালেও পাবে।
•আমি প্রথমেই বলেছি যে, মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে ইলম ও আমল-জ্ঞান ও কাজ ছাড়া আর কোনই প্রভেদ নেই। কারো ইলম ও আমল যদি কাফেরের ইলম ও আমলের মত হয়, আর তবুও যে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয় তাহলে বুঝতে হবে যে, তার মতো মিথ্যাবাদী আর কেউই নয়। কাফের পবিত্র কুরআন পড়ে না এবং তাতে কি লিখিত আছে তা সে জান না। কিন্তু মুসলমানের অবস্থা যদি এ রকমই হয় তাহলে সে নিজেকে মুসলমান বলবে কোন অধিকারে? নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ার মানুষকে যে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন এবং আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করার জন্য যে সরল পথ দেখিয়েছেন, কাফেরগণ তা কিছুই জানে না। এখন মুসলমানও যদি সেই রকমই অজ্ঞ হয় তাহলে তাকে “মুসলমান” কেমন করে বলা যায়? কাফের আল্লাহর মর্জি মতো চলে না, চলে নিজ ইচ্ছামত; মুসলমানও যদি সেরূপ স্বেচ্ছাচারিতার বশবর্তী হয়, সেরূপই আল্লাহর প্রতি উদাসীন ও বেপরোয়া হয় এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুগত দাস হয়, তবে তার নিজেকে “মুসলমান” অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ পালনকারী” বলার কি অধিকার আছে?
•কাফের হালাল-হারামের মধ্যে পার্থক্য করে না। যে কাজে সে লাভ ও আনন্দ দেখতে পায়- তা আল্লাহ তাআলার কাছে হালাল হোক কি হারাম হোক অসংকোচে সে তাই করে যায়। মুসলমানও যদি এ নীতি গ্রহণ করে তবে তার ও কাফের ব্যক্তির পার্থক্য রইল কোথায়? মোটকথা, কাফেরের ন্যায় মুসলমান ও যদি ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ হয় এবং কাফের ও মুসলমানের কাজ-কর্ম যদি একই রকম হয়, তাহলে দুনিয়ায় কাফেরের পরিবর্তে কেবল মুসলমানরাই সম্মান লাভ করবে কেন? কাফেরের ন্যায় মুসলমানরাও পরকালে শাস্তি ভোগ করবে না কিসের জন্য? এটা এমন একটি গুরুতর বিষয় যে, এ সম্বন্ধে আমাদের ধীরভাবে চিন্তা করা আবশ্যক।
•একথা মনে করার কারণ নেই যে, আমি মুসলমানকে কাফেরের মধ্যে গণ্য করছি, কারণ তা কখনও উচিত নয়। আমি নিজেও এ সম্বন্ধে যারপর নাই চিন্তা করি এবং আমি চাই যে, আমারদের সমাজের প্রত্যেকেই এ সম্বন্ধে চিন্তা করুক। আমরা আল্লাহ তাআলার রহমত হতে বঞ্চিত হচ্ছি কেন, চারিদিক হতে আমাদের ওপর কেন এ বিপদরাশি এসে পড়ছে? যাদেরকে আমরা “কাফের” অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্য বান্দাহ মনে করি, তারা আমাদের ওপর সকল ক্ষেত্রে বিজয়ী কেন? আর আমরা যারা আল্লাহর আদেশ পালনকারী বলে দাবী করি, তারাই বা সব জায়গায় পরাজিত কেন? এর কারণ সম্বন্ধে আমি যতই চিন্তা করি, ততই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, আমাদের ও কাফেরদের প্রতি বর্তমানে শুধু নামেই পার্থক্য রয়েছে গিয়েছে। কার্যত আমরা আল্লাহ তাআলার প্রতি অবহেলা, ভয়হীনতা এবং অবাধ্যতা দেখাতে কাফেরদের অপেক্ষা কিছুমাত্র পিছনে নেই। তাদের ও আমাদের মধ্যে সামান্য কিছু প্রভেদ অবশ্যই আছে, কিন্তু তার জন্য আমরা কোনোরূপ প্রতিদান বা পুরস্কারের আশা করতে পারি না, বরং সে জন্য আমরা অধিক শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কেননা আমরা জানি যে, কুরআন আল্লাহ তাআলার কিতাব, অথচ আমরা এর সাথে কাফেরের ন্যায়ই ব্যবহার করছি। আমরা জানি, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকৃত, শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী, অথচ তাঁর অনুসরণ করা আমরা কাফেরদের মতই ত্যাগ করেছি। আমরা জানি যে, মিথ্যাবাদীর প্রতি আল্লাহ তাআলা লানত করেছেন এবং ঘুষখোরদের ও ঘুষদাতা উভয়ই নিশ্চিতরূপে দোযখে যাবে বলে ঘোষণা করেছেন, সুদখোর ও সুদদাতাকে জঘন্য পাপী বলে অভিহিত করেছেন।চোগলখুরী ও গীবতকারীকে আপন ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন, অশ্লীলতা ও লজ্জাহীনতার জন্য কঠিন শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। কিন্তু এ সমস্ত কথা জানার পরও আমরা কাফেরদের মতোই বেপরোয়াভাবে এসব কাজ করে যাচ্ছি। মনে হয়, যেন আমাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় মাত্রই নেই। এজন্য কাফেরদের তুলনায় আমরা কিছুটা “মুসলমান” হয়ে থাকলেও আমাদের জীবনে তার কোনো প্রতিফলন আমরা পাচ্ছি না; বরং কেবল শাস্তি পাচ্ছি-নানাভাবে এবং নানাদিক দিয়ে। আমাদের ওপর কাফেরদের জয়লাভ এবং সর্বদা আমাদের পরাজয় এ অপরাধেরই শাস্তি। ইসলাম রূপ এক মহান নেয়ামত আমাদেরকে দেয়া হয়েছে, অথচ আমরা তার বিন্দুমাত্র কদর করিনি, এটা অপেক্ষা বড় অপরাধ আর কি হতে পারে?
•ওপরে যা কিছু বলেছি, তা কাউকে ভৎসনা করার উদ্দেশ্যে বলিনি, ভৎসনা করার উদ্দেশ্যে কলমও ধরিনি। আসলে উদ্দেশ্য এই যে, আমরা যা কিছু হারিয়ে ফেলেছি, তা ফিরে পাবার জন্য চেষ্টা করা হোক। হারানো জিনিস পুণরায় পাওয়ার চিন্তা মানুষের ঠিক তখনই হয়, যখন সে নিশ্চিতরূপে জানতে ও বুঝতে পারে যে, তার কি জিনিস এবং কত মূল্যবান জিনিস হারিয়েছে। এজন্যই আমি মুসলমানদেরকে সতর্ক করার চেষ্টা করছি, যদি তাদের জ্ঞান ফিরে আসে এবং তারা যে প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলেছে তা যদি বুঝতে পারে, তবে তা পুণরায় পেতে চেষ্টা করবে।
•আমি প্রথম প্রবন্ধে বলেছি যে, মুসলমানের প্রকৃত মুসলমান হবার জন্য সর্বপ্রথম একান্ত দরকার হচ্ছে খাঁটি ইসলামী শিক্ষা ও ইসলাম সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান। পবিত্র কুরআনের শিক্ষা কি? রাসুল পাকের প্রদর্শিত পথ কি? এসব কথা প্রত্যেক মুসলমানেরই সুস্পষ্টরূপে জেনে নেয়া আবশ্যক। এ জ্ঞান না থাকলে কোনো ব্যক্তিই মুসলমান হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা সেই ইলম অর্জন করতে কোনই চেষ্টা করে না। এটা হতে বুঝা যায় যে, তারা যে কত বড় নেয়ামত ও রহমত হতে বঞ্চিত, সে কথা এখন পর্যন্ত তারা বুঝতে পারেনি। শিশু কেঁদে না ওঠলে মা-ও তাকে দুধ দেয় না, পিপাসু ব্যক্তি পিপাসা বোধ করলেই নিজেই পানির তালাশ করে, আল্লাহ-ও তাকে পানি মিলিয়ে দেন। মুসলমানদের নিজেদেরই যদি পিপাসা না থাকে, তবে পানি ভরা কূপ তাদের মুখের কাছে আসলেও তাতে কোন লাভ নেই।
•ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা কত বড় এবং কত ভীষণ ক্ষতি তা তাদের নিদেরই অনুধাবন করা উচিত। আল্লাহ তাআলার কিতাব তাদেরই কাছে মওজুদ আছে, অথচ নামাযে তারা আল্লাহ তাআলার কাছে কি প্রার্থনা করে, তা তারা জানে না, এটা অপেক্ষা দুর্ভাগ্যের কথা আর কি হতে পারে? যে ‘কালেমা’ পাঠ করে তারা ইসলামে প্রবেশ করে, এর অর্থ পর্যন্ত তারা জানে না। এ কালেমা পাঠ করার সাথে সাথে তাঁদের ওপর কি কি দায়িত্ব এসে পড়ে তাও জানে না। বস্তুত একজন মুসলমানের পক্ষে এতদপেক্ষা ক্ষতি ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। ক্ষেত-খামার নষ্ট হওয়ার পরিণাম যে কি, তা সকলেই জানে। ফসল নষ্ট হলে না খেয়ে মরতে হবে তাতে কারো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার পরিণাম যে কত ভীষণ ও ভয়াবহ, সেই কথা তারা অনুভব করতে পারে না। কিন্তু এ ক্ষতির কথা যখন তার অনুভব করতে পারবে, তখন তারা নিজেরাই এ ভীষণ ক্ষতির কবল হতে বাঁচতে সচেষ্ট হবে, তখন ইনশাআল্লাহ তাদেরকে এ ক্ষতি হতে বাঁচাবার ব্যবস্থাও করা হবে।
•বর্তমান দুনিয়ায় একমাত্র মুসলমানদের কাছেই আল্লাহ তাআলার কালাম সম্পূর্ণ অবিকৃত ও অপরিবর্তিত অবস্থায় বর্তমান আছে। কুরআনের যে শব্দ আল্লাহর নবীর প্রতি নাজিল হয়েছিল, আজ পর্যন্ত অবিকল তা-ই আছে। এ দিক দিয়ে দুনিয়ার মুসলমানগণ ভাগ্যবান জাতি, তাতে সন্দেহ নেই। আবার দুনিয়ার এ মুসলমানই একমাত্র হতভাগ্য; যাদের কাছে আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালাম এর আসল অবস্থায় বর্তমান থাকা সত্ত্বেও এর বরকত ও অফুরন্ত নিয়ামত হতে তারা বঞ্চিত। কুরআন শরীফ তাদের ওপর এজন্য নাজিল হয়েছিল যে, তারা এটা পড়বে, বুঝবে, তদনুযায়ী কাজ করবে। এটা এসেছিল তাদেরকে শক্তি এবং সম্মান দান করার জন্য। এটা তাদেরকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রকৃত ‘খলিফা’ বানাতে এসেছিল। আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যতদিন তারা কুরআনের হেদায়াত অনুযায়ী চলেছে, ততদিন এটা তাদেরকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নেতা বানিয়ে রেখেছে।
•কিন্তু আজকাল তারা কুরআন দ্বারা জ্বিন-ভুত তাড়ান ছাড়া আর কোনো কাজই করছে না। এর আয়াত লিখে তারা গলায় বাঁধে, তা লিখে ও গুলে পানি খায়, আর শুধু পূণ্য সঞ্চয় করার উদ্দেশ্যে না বুঝে পাঠ করে, তারা আজ এর কাছে হিদায়াত চায় না। তাদের ধর্ম বিশ্বাস কি রকম হবে, তা তারা কুরআনের কাছে জিজ্ঞেস করে না। তাদের কাজ-কর্ম কিরূপ হওয়া উচিত, তাদের চরিত্র কিরূপ হওয়া দরকার, তারা এ দুনিয়ায় কিরূপে জীবন যাপন করবে, লেন-দেন কিভাবে করবে, কোন্ নিয়ম অনুসারে তারা মানুয়ের সাথে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা করবে, আল্লাহর অন্যান্য বান্দাদের প্রতি এবং তাদের নিজেদের প্রতি তাদের কর্তব্য কি, আর তা বিভাবেই বা পালন করবে, দুনিয়ায় কার হুকুম মানবে আর কার হুকুম অমান্য করবে, কার সাথে সম্বন্ধ রাখা উচিত, কার সাথে নয়, তাদের মিত্র কে আর শত্রুই বা কে, কিসে তাদের সম্মান ও সফলতা হবে, কোন্ কাজে ধন-দৌলত লাভ হবে, তাদের ব্যর্থতা এবং ক্ষতিই বা কিসে হতে পারে-কুরআনের নিকট এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব চাওয়া মুসলমানগণ এখন ছেড়ে দিয়েছে।
•এখন তারা কাফের, মুশরিক, গোমরাহ ও স্বার্থপর লোকদের কাছে এবং নফসরূপ শয়তানের কাছে এ সমস্ত বিষয়ে পরামর্শ চায়, আর এদের পরামর্শ অনুযায়ীই তারা কাজ করে। কাজেই আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের হুকুম অনুসারে কাজ করার যে পরিণাম হতে পারে, তাই হয়েছে। আর সেই ফলই তারা আজ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও এক এক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাড়ে হাড়ে ভোগ করছে।কুরআন শরীফ সমস্ত মঙ্গলের উৎস, লোকেরা যে রকমের এবং যে পরিমানের মঙ্গল এক কাছে চাবে, কুরআন তাই এবং ততটুকুই দান করবে। জ্বিন-ভূত তাড়ান, সর্দি-কাশির চিকিৎসা, মামলা-মোকদ্দমায় জয়লাভ, চাকুরী লাভ আর এ ধরনের সব ছোট ছোট ও নিকৃষ্ট জিনিস যদি তারা এর কাছে চায়, তবে তাই দান করবে। আর যদি দুনিয়ার বাদশাহী এবং সারাজাহানের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব পেতে চায়, তবে তাও তাদেরকে দেবে। এমন কি, যদি আল্লাহর আরশের কাছে পৌছতে চায়, তবে কুরআন তাদেরকে সেখান পর্যন্ত পৌছিয়ে দেবে। মূলত তা তার পাত্রের যোগ্যতার ওপরই নির্ভর করে। তারা আজ মহাসমুদ্রের কাছে হতে মাত্র দু'ফোটা পানি নিচ্ছে, অথচ সমুদ্র তাদেরকে বড় নদী দান করতে পারে।
•আমাদের মুসলমান ভাইগণ আল্লাহর পাক কিতাবের সাথে যে ধরনের অসংগত ব্যবহার করে থাকে, তা এতই হাস্যকর ব্যাপার যে, এরা নিজেরা যদি দুনিয়ার কোনো কাজে অন্য কোনো লোককে সে ধরনের ব্যবহার করতে দেখতো তবে তারা বিদ্রূপ করতে ত্রুটি করতো না, বরং তারা তাকে পাগল মনে করতো। কোনো ব্যক্তি যদি ডাক্তারের কাছ হতে ওযুধের তালিকা লিখে এনে কাপড়ে জড়িয়ে গলায় বেঁধে রাখে, কিংবা পানিতে ধুয়ে তা পান করে, তবে আপনারা তাকে কি বলবেন? আপনারা কি তার কাজ দেখে হাসবেন না এবং তাকে নিতান্ত আহাম্মক মনে করবেন না? কিন্তু সবচেয়ে বড় ডাক্তার আপনাদের রোগের চিকিৎসা ও আপনাদেরকে নিরাময় করার উদ্দেশ্যে যে অতুলনীয় তালিকা লিখে দিয়েছেন, তার সাথে দিন-রাত আপনাদের চোখের সামনেই এ ধরনের ব্যবহার হচ্ছে। অথচ সেই জন্য কারো এতটুকু হাসির উদ্রেক হয় না। একথা কেউই ভেবে দেখেন না যে, ওষুধের তালিকা গলায় বাঁধার বা ধুয়ে খাবার জিনিস নয়, এর বিধান অনুযায়ী ওষুধ বানিয়ে ব্যবহার করার জন্যই তা লিখিত হয়েছে।
•কোনো রুগ্ন ব্যক্তি যদি একখানা ডাক্তারী কিংবা হেকিমী বই নিয়ে পড়তে শুরু করে আর মনে করে যে, এ বইখানা পড়লে সব রোগ আপনা আপনি দূর হয়ে যাবে। তবে আপনারা তাকে কি বলবেন? আপনারা কি বলবেন না যে, তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাকে পাগলখানায় পাঠিয়ে দাও? কিন্তু হায়! একমাত্র মহা চিকিৎসক আল্লাহ তাআলা আপনাদের রোগের চিকিৎসার জন্য যে মহান কিতাব পাঠিয়েছেন, তার সাথে আপনাদের ব্যবহার ঠিক একই রকম হচ্ছে। আপনারা তা পড়েন আর মনে করেন যে, এটা পড়লেই সব রোগ দূর হয়ে যাবে-এর বিধান মতো কাজ করার কোনোই দরকার নেই। আর এ কিতাব যেসব জিনিসকে ক্ষতিকর মনে করে বর্জন করতে বলে তা বর্জন করারও কোনো দরকার মনে করেন না। তাহলে রোগ দূর করা জন্য যে ব্যক্তি শুধু বই পড়াই যথেষ্ট মনে করে, তার সম্পর্কে আপনারা যে মত প্রকাশ করে থাকেন, আপনাদের নিজেদের সম্পর্কে সেরূপ মত প্রকাশ করেন না কেন?
•আপনি জানেন না এমন কোনো ভাষায় যদি আপনার কাছ কোনো চিঠি আসে তবে আপনি অমনি এর অর্থ জানার জন্য ঐ ভাষা যে ব্যক্তি জানে তার কাছে দৌড়ে যান। এর অর্থ যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি জানতে না পারেন, ততক্ষণ আপনার বিন্দুমাত্র শান্তি থাকে না। সাধারণ কায়-কারবারের চিঠি নিয়ে আপনি এই প্রকার অস্থির হয়ে পড়েন; এতে আপনার হয়ত দু’চার পয়সারই উপকার হতে পারে, তার বেশী নয়। কিন্তু সারাজাহানের মালিক আল্লাহর কাছ হতে যে, আপনার কাছে এসেছে, আর যার মধ্যে আপনার ইহকাল ও পরকালের সমস্ত মঙ্গল নিহিত আছে তাকে আপনি অবহেলা করে ফেলে রাখেন, এর অর্থ জানার কোনো আগ্রহ বা অস্থিরতাই আপনার মধ্যে জাগে না। এটা কি বাস্তবিকই আশ্চর্যের ব্যাপার নয়?এসব কথা আমি হাসি-তামাশার জন্য বলছি না। আপনারা যদি একথা চিন্তা করে দেখেন তবে আপনাদের অন্তরই বলে দেবে যে, দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় অবিচার হচ্ছে আল্লাহর এ মহান কিতাবের প্রতি।
•আর এ অবিচার শুধু তারাই করছে, যারা এ কিতাবের প্রতি ঈমান রাখে বলে দাবী করে এবং এর জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত বলে প্রচার করে। আর আল্লাহর কালামের প্রতি যুলুম করার ফল তো সকলেরই জানা আছে। খুব ভাল করে বুঝে নিন, আল্লাহর কালাম মানুষের কাছে এ জন্য আসেনি যে, এটা পেয়েও সে দুর্ভাগ্য ও দুঃখ-মুসিবতের মধ্যে পড়ে থাকবে। পবিত্র কুরআন তো সৌভাগ্য ও সার্থকতা লাভ করার একমাত্র উৎস; এটা দুর্ভাগ্য ও হীনতা লাভের কোনো কারণ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলে দিয়েছেন:
•“ত্ব-হা--হে নবী! তোমার প্রতি কুরআন এ জন্য নাযিল করিনি যে, এটা সত্ত্বেও তুমি হতভাগ্য হয়ে থাকবে।” (সূরা ত্ব-হা: ১-২)
•এরা দ্বারা মানুষের ভাগ্য খারাপ হওয়ার এবং সকলের অপেক্ষা নিকৃষ্ট হওয়ার কোনোই আশংকা নেই। কোনো জাতির কাছে আল্লাহর কালাম বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তার লজ্জিত ও লাঞ্চিত হওয়া, পরের অধীন হওয়া, অপমানিত ও পদদলিত হওয়া, গোলামীর নাগপাশে বন্দী হওয়া, তার সমস্ত কর্তৃত্ব অপরের হাতে ন্যস্ত হওয়া এবং পরের দ্বারা জন্তু-জানোয়ারের মত বিতাড়িত ও নির্যাতিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। এমন দুঃখপূর্ণ অবস্থা সেই জাতির ঠিক তখনই হতে পারে যখন তারা আল্লাহর কালামের ওপর যুলুম করতে শুরু করে। বনী ইসরাঈলের অবস্থা আপনাদের অজানা নয়। তাদের প্রতি তাওরাত ও ইনজীল নাযিল করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল:
•“তাওরাত, ইনজীল এবং অন্যান্য যেসব কিতাব তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছিল, তারা যদি তা অনুসরণ করে চলতো, তবে তাদের প্রতি আকাশ হতে রিজিক বর্ষিত হতো এবং যমীন হতে খাদ্যদ্রব্য ফুটে বের হতো।” (মায়েদা: ৬৬)
•কিন্তু তারা আল্লাহ তাআলার এসব কালামের প্রতি যুলুম করেছিল, আর তার ফলে: “লাঞ্ছনা এবং পরমুখাপেক্ষিতা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং আল্লাহর গযবে তারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিল। এর কারণ এই যে, তারা আল্লাহর বাণীকে অমান্য করতে শুরু করেছিল, আর পয়গাম্বরগণকে অকারণে হত্যা করেছিল। তাছাড়া আরও কারণ এই যে, তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল এবং তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা যে সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, তা তারা অতিক্রম করে গিয়েছিল।” (সূরা বাকারা: ৬১)
•অতএব, যে জাতি আল্লাহর কিতাব ধারণ করে থাকা সত্ত্বেও দুনিয়ায় লাঞ্ছিত, পদদলিত এবং পরের অধীন ও পরের তুলনায় শক্তিহীন হয়, নিঃসন্দেহে মনে করবেন যে, তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর কালামের ওপর যুলুম করছে। আর তাদের ওপর এই যে, দুঃখ-বিপদের তুফান আসছে, তার মূল কারণই হচ্ছে এছাড়া আর কোনো উপায় থাকতে পারে না। তারা আল্লাহর কালামের প্রতি যুলুম করা ত্যাগ করবে এবং এর ষোলআনা ‘হক’ আদায় করতে চেষ্টা করবে। আপনারা যদি এ মহাপাপ হতে ফিরে না থাকেন, আপনাদের এ হীন অবস্থার কিছুতেই পরিবর্তন হবে না। (তা আপনারা গ্রামে গ্রামে কলেজ-ই খুলুন, আপনাদের প্রত্যেকটি সন্তান গ্রাজুয়েট হোক, আর ইহুদীদের মত সুদী কারবার করে কোটিপতিই হোক না কেন, তার ফল প্রকৃতপক্ষে কিছুই নয়)।
•মুসলমান কাকে বলে এবং মুসলিম শব্দের অর্থ কি, একথা প্রত্যেক মুসলমানকে সর্বপ্রথমেই জেনে নিতে হবে। কারণ মনুষ্যত্ব কাকে বলে এবং মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য কি, তা যদি মানুষের জানা না থাকে, তবে সে জানোয়ারের মতো কাজ করতে শুরু করবে- সে তার মনুষ্যত্বের মূল্য বুঝতে পারবে না। অন্যরূপভাবে যদি কেউ একথা জানতে না পারে যে, মুসলমান হওয়ার অর্থ কি এবং মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে কেমন করে পার্থক্য করা যায়, তবে সে তো অমুসলমানের মতো কাজ-কর্ম করতে শুরু করবে এবং তার মুসলমানীর কোনো সম্মানই সে রক্ষা করতে পারবে না। অতএব, প্রত্যেক মুসলমানকে এবং মুসলমানের প্রত্যেকটি সন্তানকেই ভালো করে জেনে নিতে হবে যে, সে যে নিজেকে নিজে মুসলমান মনে করে এ মুসলমান হওয়ার অর্থ কি? মুসলমান হওয়ার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে কি পরিবর্তন ও পার্থক্য হয়ে যায়? তার ওপর কি কর্তব্য ও দায়িত্ব এসে পড়ে? ইসলামের কোন সীমার মধ্যে থাকলে মানুষ মুসলমান থাকতে পারে এবং কোন্ সীমা অতিক্রম করলেই বা সে মুসলমানী হতে খারিজ হয়ে যায়? এসব কথা না জানলে মুখ দিয়ে সে মুসলমানীর যতই দাবী করুক না কেন, তার মুসলমান থাকা সম্ভব নয়।
•ইসলাম অর্থ আল্লাহর আনুগত্য করা ও হুকুম পালন করে চলা। নিজেকে আল্লাহ তাআলার কাছে সোপর্দ করে দেয়ার নাম হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহর সম্মুখে নিজের আযাদী ও স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করার নাম ইসলাম। আল্লাহর বাদশাহী এবং আনুগত্যকে মাথানত করে স্বীকার করে নেয়ার নাম ইসলাম। যে ব্যক্তি নিজের সমস্ত কাজ-কারবারকে আল্লাহর হাতে সঁপে দেয়, সেই ব্যক্তি মুসলমান। আর যে ব্যক্তি নিজের সব ব্যাপারে নিজের ইচ্ছামত সম্পন্ন করে কিংবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও হাতে তা সোপর্দ করে সে মুসলমান নয়। আল্লাহর হাতে সঁপে দেয়ার তাৎপর্য এই যে, তিনি তাঁর কিতাব এবং তাঁর নবীর মারফত যে হেদায়াত ও সৎপথের বিধান পাঠিয়েছেন, মানুষ তাকে পুরোপুরি কবুল করবে এবং তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করতে পারবে না। জীবনের প্রত্যেকটি ব্যাপারে এবং কাজে শুধু পবিত্র কুরআন হাদীসের নিয়ম অনুসরণ করে চলবে।
•যে ব্যক্তি নিজের বুদ্ধি, দুনিয়ার প্রথা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সকলকেই-সবকিছু পশ্চাতে ফেলে রেখে এবং প্রত্যেক ব্যাপারেই কেবল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীসের কাছে পথের সন্ধান জানতে চায়-জিজ্ঞেস করে যে, আমার কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়, আর সেখান হতে যে নিয়মই পাওয়া যাক না কেন বিনা আপত্তিতে তা মেনে নেয়, তার বিপরীত যা তা সবই সে অস্বীকার করে শুধু সেই ব্যক্তি মুসলমান। কারণ সে তো নিজেকে আল্লাহর কাছে একবারে সঁপে দিয়েছে। আর এভাবে আল্লাহর হাতে নিজেকে সঁপে দিলেই মানুষ মুসলমান হতে পারে। এর বিপরীত- সে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ওপর মোটেই নির্ভর করে না, বরং নিজের মন যা বলে তাই করে, কিংবা বাপ-দাদা হতে চলে আসা নিয়ম-কানুনের অনুসরণ করে চলে, কিংবা দুনিয়ায় যা কিছু হচ্ছে সে-ও তাই করে, নিজের কোনো ব্যাপারেই সে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের বিধান জেনে সে বলে ওঠে যে, আমার বুদ্ধি তা গ্রহণ করতে চায় না, তাই আমি তা মানি না, অথবা বাপ-দাদার কাল হতে তার উল্টা নিয়ম চলে আসছে কাজেই তার অনুসরণ করব না; কিংবা দুনিয়ার নিয়ম তার বিপরীত, তাই আমি সেই নিয়ম অনুসারেই চলবো-তবে সেই ব্যক্তি কিছুতেই মুসলমান নয়। যদি সে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তবে সে মিথ্যাবাদী সন্দেহ নেই।
•আপনি যখন কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলল্লাহ’ পড়েন এবং মুসলমান হওয়ার কথা স্বীকার করেন, তখন আপনি তার মধ্য দিয়ে একথাও স্বীকার করে থাকেন যে, আপনার আল্লাহর আইন আপনার জন্য একমাত্র আইন; আল্লাহ তাআলাই আপনার প্রভূ ও আদেশ কর্তা। তখন আপনার শুধু আল্লাহরই আনুগত্য করতে হবে। আপনার কাছে শুধু সেই বিধানই সত্য বিধানরূপে স্বীকৃতি পাবে যা আল্লাহর কিতাব এবং তার রাসূলের সাহায্যে পাওয়া যায়। এর অর্থ এই যে, আপনি মুসলমান হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর সামনে নিজের আযাদী বিসর্জন দিয়েছেন।
•অতপর আপনার নিজের স্বতন্ত্র মত বলতে কিছুই থাকতে পারে না, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রথা বা পারিবারিক নিয়মরীতিরও কোনোও গুরুত্ব থাকতে পারে না অথবা অমুক হযরত এবং অমুক বুজর্গ সাহেব কি বলেছেন, আল্লাহর কালাম এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাতের মোকাবিলায় এ ধরনের কোনো কথাই আপনি এখন পেশ করতে পারেন না। আপনার প্রত্যকটি বিষয়ই পবিত্র কুরআন ও হাদীসের সামনে পেশ করাই এখন আপনার একমাত্র কাজ। যা তার অনুরূপ হবে না আপনি তা উঠিয়ে দূরে নিক্ষেপ করবেন- তা যারই প্রথা হোক না কেন। নিজেকে মুসলমান বলা এবং তারপর পবিত্র কুরআন ও হাদীসকে বাদ দিয়ে নিজের মত, দুনিয়ার প্রথা কিংবা মানুষের কোনো কথা বা কাজের অনুসরণ করা সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। কোনো অন্ধ ব্যক্তি যেমন নিজেকে চোখওয়ালা বলতে পারে না, কোনো নাকহীন ব্যক্তি যেমন নিজেকে নাকওয়ালা বলতে পারে না, ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি নিজের সমস্ত কাজ-কর্ম পবিত্র কুরআন হাদীস অনুসারে সমাধা করে না, বরং তা পরিত্যাগ করে নিজের বুদ্ধি বা দুনিয়ার প্রথা অথবা কোনো ব্যক্তি বিশেষের কথা বা কাজের অনুসরণ করে চলে- সে কিছুতেই নিজেকে মুসলমান বলতে পারে না।
•কেউ যদি নিজে মুসলমান থাকতে না চায়, তবে তার মুসলমান থাকার জন্য তার ওপর জোর-জবরদস্তি করতে পারে না। যে কোনো ধর্ম গ্রহণ করা এবং যে কোনো নাম ধারণ করার স্বাধীনতা প্রত্যকটি মানষেরই রয়েছে। কিন্তু কোনো মানুষ যখন নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তখন তার একথা খুব ভালো করেই বুঝে নেয়া উচিৎ যে, সে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান থাকতে পারে, যতক্ষণ সে ইসলামের সীমার মধ্যে থাকবে। আল্লাহর কালাম এবং তাঁর রাসূলের হাদীসকে সত্য ও মঙ্গলের একমাত্র মাপকাঠিরূপে গ্রহণ করা এবং তার এর বিরোধী প্রত্যেকটি জিনিসকে বাতিল ও মিথ্যা মনে করাই হচ্ছে ইসলামের সীমা। এ সীমার মধ্যে যে থাকবে সে মুসলমান; এটা যে লংঘন করবে সে ইসলাম হতে বিচ্যূত-বহির্ভূত হয়ে পড়বে। তারপরও সে যদি নিজেকেও ধোঁকা দিচ্ছে আর দুনিয়াকেও ধোঁকা দিচ্ছে সন্দেহ নেই।
•“যে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করে না সে কাফের।” -(সূরা আল মায়েদা: ৪৪)
•আপনারা জানেন, মানুষ একটি কালেমা পাঠ করে ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। সেই কালেমাটি খুব লম্বা-চওড়া কিছু নয় কয়েকটি শব্দ মাত্র। لا اله الإ الله محمد الرسول الله -এ কয়টি শব্দ মুখে উচ্চারণ করলেই মানুষ একেবারে বদলে যায়। একজন কাফের যদি এটা পড়ে, তবে সে মুসলমান হয়ে যায়। ফলে পূর্বে সে নাপাক ছিল, এখন সে পাক হয়ে গেল। পূর্বে তার ওপর আল্লাহর গজব আসতে পারতো, কিন্তু এখন সে আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হয়ে গেল। প্রথমে সে জাহান্নামে যাবার যোগ্য ছিল, এখন জান্নাতের দুয়ার তার জন্য খুলে গেল।
•শুধু এটুকুই নয়, এ ‘কালেমা’র দরুন মানুষে মানুষে ও বড় পার্থক্য হয়ে পড়ে। এ ‘কালেমা’ যারা পড়ে তারা এক উম্মাত আর যারা এটা অস্বীকার করে তারা হয় আলাদা এক জাতি। পিতা যদি ‘কালেমা’ পড়ে আর পুত্র যদি তা অস্বীকার করে তবে পিতা আর পিতা থাকবে না, পুত্র আর পুত্র বলে গণ্য হবে না, পিতার সম্পত্তি হতে সেই পুত্র কোনো অংশই পাবে না, তার মা ও বোন পর্যন্ত তাকে দেখা দিতে ঘৃণা করবে। পক্ষান্তরে একজন বিধর্মী যদি কালেমা পড়ে, আর ঐ ঘরের মেয়ে বিয়ে করে, তবে সে এবং তার সন্তান শুধু এ কালেমাকে অস্বীকার করার করণেই একেবারে পর হয়ে যাবে। এটা দ্বারা বুঝতে পারা যায় যে, এ কালেমা এমন জিনিস যা পর লোককে আপন করে একত্রে মিলিয়ে দেয়। আর আপন লোককে পর করে পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন করে।
•একটু ভেবে দেখুন মানুষে মানুষে এতবড় পার্থক্য হওয়ার প্রকৃত কারণ কি? ‘কালেমা’তে কয়েকটা অক্ষর ছাড়া আর কি-ইবা রয়েছে? কাফ, লাম, মীম, আলিফ, সীন আর এ রকমেরই কয়েকটা অক্ষর ছাড়া আর তো কিছুই নয়। এ অক্ষরগুলো যুক্ত করে মুখে উচ্চারণ করলেই কোন যাদুর স্পর্শে মানুষ এতখানি বদলে যায়! শুধু এতটুকু কথা দ্বারা কি মানুষের পরস্পরের মাধ্যে এত আকাশ-পাতাল পার্থক্য হতে পারে? একটু চিন্তা করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন- আপনাদের বিবেক-বুদ্ধি বলে ওঠবে যে, কয়েকটা অক্ষর মিলিয়ে মুখে উচ্চারণ করলেই এতবড় ক্রিয়া কিছুতেই হতে পারে না। মূর্তিপূজক মুশরিকগণ অবশ্য মনে করে যে, একটা মন্ত্র পড়লেই পাহাড় টলে যাবে। জমীন ফেটে যাবে এবং তা হতে পানি উথলে ওঠবে! মন্ত্রের কোনো অর্থ কেউ অবগত হোক বা না-ই হোক, তাতে কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। কারণ অক্ষরের মধ্যেই যাবতীয় শক্তি নিহিত আছে বলে তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। কাজেই তা মুখে উচ্চারিত হলেই সকল রহস্যের দুয়ার খুলে যাবে। কিন্তু ইসলামে এরূপ ধারণার কোনোই মূল্য নেই। এখানে আসল জিনিস হচ্ছে অর্থ; শব্দের কোনো অর্থ না হলে, তা মনের মূলের সাথে গেঁথে না গেলে এবং তার ফলে মানুষের চিন্তাধারা, বিশ্বাস, চরিত্র ও তার কাজ-কর্মে পরিবর্তন না ঘটলে, শুধু শব্দের উচ্চারণ করলেই কোনো লাভ নেই।
•একথাটি সহজ উদাহরণ দ্বারা আপনাদেরকে বুঝাতে চাই। মনে করুন, আপনার ভয়ানক শীত লাগছে। এখন আপনি যদি মুখে ‘লেপ-তোষক’ ‘লেপ-তোষক’ করে চিৎকার করতে শুরু করেন, তবে শীত লাগা কিছুমাত্র কমবে না। সারা রাত বসে ‘লেপ-তোষক’ বলে হাজার তাসবীহ পড়লেও কোনো ফল ফলবে না। অবশ্য আপনি লেপ-তোষক যোগাড় করে যদি গায়ে দিতে পারেন তবে শীত লাগা নিশ্চয় বন্ধ হয়ে যাবে। এরূপে মনে করুন, আপনার তৃষ্ণা লেগেছে। এখন যদি আপনি সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘পানি’ ‘পানি’ করে চিৎকার করতে থাকেন, তবে তাতে পিপাসা মিটবে না। কিন্তু এক গ্লাস পানি নিয়ে যদি পান করেন, তবে আপনার কলিজা অবশ্যই ঠান্ডা হবে। মনে করুন, আপনার অসুখ হয়েছে, এখন যদি আপনি ‘ওষুধ’ ‘ওষুধ’ করে তাসবীহ পাঠ শুরু করেন, আপনার রোগ তাতে দূর হবে না। হাঁ যদি ঠিক ওষুধ খরিদ করে তা সেবন করেন, তবে আপনার রোগ সেরে যাবে। কালেমার অবস্থাও ঠিক এটাই।
•শুধু ছয়-সাতটি শব্দ মুখে বলে দিলেই এত বড় পার্থক্য হতে পারে না, যে মানুষ কাফের ছিল সে এর দরুন একেবারে মুসলমান হয়ে যাবে, নাপাক হতে পাক হবে, দুশমন লোক একেবারে বন্ধু হয়ে যাবে, জাহান্নামী ব্যক্তি একেবারে জান্নাতী হয়ে যাবে। মানুষে মানুষে এরূপ পার্থক্য হয়ে যাওয়ার একটি মাত্র উপায় আছে। তা এই যে, প্রথমে এ শব্দগুলোর অর্থ বুঝে নিতে হবে, সেই অর্থ যাতে মানুষের মনের মূলে শিকড় গড়তে পারে, সেজন্য চেষ্টা করতে হবে। এভাবে অর্থ জেনে ও বুঝে যখন এটা মুখে উচ্চারণ করবেন, তখনই আপনারা বুঝতে পারবেন যে, এ ‘কালেমা’ পড়ে আপনারা আপনাদের আল্লাহর সামনে কত বড় কথা স্বীকার করেছেন, আর এর দরুন আপনাদের ওপর কত বড় দায়িত্ব এসে পড়েছে। এসব কথা বুঝে শুনে যখন আপনারা ‘কালেমা’ পড়বেন, তখন আপনাদের চিন্তা এবং আপনার সমস্ত জীবনের ওপর এ ‘কালেমা’র পূর্ণ আধিপত্য স্থাপিত হবে। এরপর এ ‘কালেমা’র বিরোধী কোনো কথা আপনাদের মন ও মগজে একটুও স্থান পেতে পারে না। চিরকালের তরে আপনাদের একথাই মনে করতে হবে যে, এ ‘কালেমা’র বিপরীত যা তা মিথ্যা-এ কালেমাই একমাত্র সত্য। আপনাদের জীবনের সমস্ত কাজ-কারবারে এ ‘কালেমা’ই হবে একমাত্র হুকুমদাতা।
•এ ‘কালেমা’ পড়ার পরে কাফেরদের মতো স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না। এখন এ ‘কালেমা’রই হুকুম পালন করে চলতে হবে, এটা যে কাজ করতে বলবে তাই করতে হবে এবং যে কাজের নিষেধ করবে তা হতে ফিরে থাকতে হবে। এভাবে ‘কালেমা’ পড়লেই মানুষে মানুষে পূর্বোল্লিখিতরূপে পার্থক্য হতে পারে।
•এখন ‘কালেমা’র অর্থ কি, তা পড়ে মানুষ কি কথা স্বীকার করে, আর তা স্বীকার করলেই মানুষ কোন্ বিধান মত চলতে বাধ্য হয় প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করবো।
•কালেমার অর্থ: ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআলার রাসূল বা প্রেরিত পুরুষ’। কালেমার মধ্যে যে ‘ইলাহ’ শব্দটি রয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে মালিক, সৃষ্টিকর্তা, মানুষের জন্য বিধান রচনাকারী, মানুষের দোয়া যিনি শোনেন এবং গ্রহন করেন- তিনিই উপাসনা পাবার একমাত্র উপযুক্ত। এখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়লে তার অর্থ এই হবে যে, আপনি প্রথম স্বীকার করলেন: এ দুনিয়া আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টি হতে পারেনি, এর সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই বর্তমান আছেন, আর সেই সৃষ্টিকর্তা বহু নয়-মাত্র একজন। তিনি ছাড়া আর কারো খোদায়ী বা প্রভুত্ব কোথাও নেই; দ্বিতীয়ত ‘কালেমা’ পড়ে আপনি স্বীকার করলেন যে, সেই এক আল্লাহ-ই মানুষের ও সারা জাহানের মালিক। আপনি ও আপনার প্রত্যেকটি জিনিস এবং দুনিয়ার প্রতিকটি বস্তুই তাঁর ।
•সৃষ্টিকর্তা তিনি, রিযিকদাতা তিনি, জীবন ও মৃত্যু তাঁরই হুকুম মত হয়ে থাকে। সুখ ও বিপদ তাঁরই তরফ হতে আসে। মানুষ যা কিছু পায়, তাঁরই কাছ হতে পায়-সকল কিছুর দাতা প্রকৃত পক্ষে তিনি। আর মানুষ যা হারায়, তা প্রকৃতপক্ষে তিনিই কেড়ে নেন। শুধু তাঁকেই ভয় করা উচিত, তাঁরই সামনে মাথা নত করা উচিত। কেবলমাত্র তারই ইবাদাত ও বন্দেগী করা কর্তব্য। তিনি ছাড়া আমাদের মনিব, মালিক ও আইন রচনাকারী আর কেউই নেই। একমাত্র তাঁরই হুকুম মেনে চলা এবং কেবল তাঁরই আইন অনুসারে কাজ করা আমাদের আসল ও একমাত্র কর্তব্য।
•‘কালেমা’ পড়ে আপনি আল্লাহর কাছে এ ওয়াদা-ই করে থাকেন, আর সারা দুনিয়া এ মৌলিক অঙ্গীকারের সাক্ষী হয়ে থাকে। এর বিপরীত কাজ করলে আপনার জিহ্বা, আপনার হাত-পা, আপনার প্রতিটি পশম এবং আকাশ ও পৃথিবীর এক একটি অণু-পরমাণু যাদের সামনে আপনি এ ওয়াদা করেছিলেন আপনার বিরূদ্ধে আল্লাহর আদালতে সাক্ষ্য দেবে। আপনি সেখানে একেবারে অসহায় হয়ে পড়বেন। আপনার সাফাই প্রমাণ করার জন্য একটি সাক্ষী কোথাও পাবেন না। কোনো উকিল কিংবা ব্যারিষ্টার আপনার পক্ষ সমর্থন করার জন্য সেখানে থাকবে না। বরং স্বয়ং উকিল সাহেব কিংবা ব্যারিষ্টার সাহেব দুনিয়ার আদালতে যারা আইনের মারপ্যাঁচ খেলে থাকে, তারা সকলেই সেখানে আপনারই মতো নিতান্ত অসহায় অবস্থায় পড়ে যাবে। সেই আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে, জাল দলিল দেখিয়ে এবং উকিলের দ্বারা মিথ্যা ওকালতী করিয়ে আপনারা রক্ষা পেতে পারবেন না। দুনিয়ার পুলিশের চোখ হতে আপনারা নিজেদের অপরাধ লুকাতে পারেন, কিন্তু আল্লাহর পুলিশের চোখ হতে তা গোপন করা সম্ভব নয়। দুনিয়ার পুলিশ ঘুষ খেতে পারে, আল্লাহর সাক্ষী সকলেই সত্যবাদী-তারা মিথ্যা বলে না। দুনিয়ার বিচারকেরা অবিচার করতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা অবিচারক নন। তারপর আল্লাহ যে জেলখানায় পাপীদেরকে বন্দী করবেন, সেখান হতে পলায়ন করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। কাজেই আল্লাহর সাথে মিথ্যা ওয়াদা করা বড় আহাম্মকি এবং সবচেয়ে বেওকুফী সন্দেহ নেই। যখন আল্লাহর সামনে ওয়াদা করছেন, তখন খুব ভালো করে বুঝে শুনে করুন এবং তা পালন করার চেষ্টা করুন, নতুবা শুধু মুখে ওয়াদা করতে আপনাকে কেউ জবরদস্তি করছে না। কারণ মুখে শুধু স্বীকার করার কোনো মূল্যই নেই।
•‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলার পর বলতে হয়ে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’’। এর অর্থ এই যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যস্থতায়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর আইন মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন- একথা আপনারা স্বীকার করছেন। আল্লাহকে নিজেদের মনিব, মালিক ও বাদশাহ স্বীকার করার পর একথা অবগত হওয়ার একান্ত দরকার ছিল যে, সেই বাদশাহে দো-আলমের আইন ও হুকুম কি? আমরা কোন কাজ করলে তিনি খুশী হবেন, আর কোন কাজ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন? কোন আইন অনুসরণ করলে তিনি আমাদের ক্ষমা করবেন, আর কোন আইন অনুসরণ করলে তিনি আমাদেরকে শাস্তি দেবেন? এসব জানার জন্য আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর দূত নির্দিষ্ট করেছেন। তাঁর মধ্যস্থতায় তিনি আমাদের প্রতি তাঁর কিতাব পাঠিয়েছেন এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আল্লাহর হুকুম মতো কিরূপে জীবন যাপন করতে হয় তা বাস্তব ক্ষেত্রে দেখিয়ে গেছেন।
•কাজেই আপনারা যখন বলেন, ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ তখন এর দ্বারা আপনারা একথাই স্বীকার করে থাকেন যে, যে আইন এবং যে নিয়ম হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আপনারা তা অনুসরণ করে চলবেন। আর যে আইন এর বিপরীত হবে তাকে পদদলিত করবেন । এ ওয়াদা করার পর যদি আপনারা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রচার আইনকেই ছেড়ে দেন, আর দুনিয়ার আইন অনুসরণ করে চলেন তবে আপনাদের চেয়ে বড় মিথ্যাবাদী ও বেঈমান আর কেউ নেই। কারণ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রচারিত আইনকে একমাত্র সত্য আইন মেনে এবং তার অনুসরণ করে চলার অঙ্গীকার করেই আপনারা ইসলামের সীমার মধ্যে এসেছেন। একথা স্বীকার করেই আপনারা মুসলমানদের ভাই হয়েছেন। এরই কারণে আপনাদের সন্তান ন্যায়ত সন্তান হতে পেরেছে। এরই দরুন মুসলমানগণ আপনাদেরকে সাহায্য করেছে, আপনাদেরকে যাকাত দিয়েছে, আপনাদের জান-মাল ও মান-সম্মানের হেফাযত করার দায়িত্ব নিয়েছে। এতসব হওয়া সত্ত্বেও যদি আপনারা নিজেদের ওয়াদা ভঙ্গ করেন, তবে এটা অপেক্ষা বড় বেঈমানী দুনিয়ায় আর কি হতে পারে? আপনারা যদি لا اله الإ الله محمد الرسول الله এর অর্থ জানেন এবং জেনেবুঝেই এটা স্বীকার করেন, তাহলে সকল অবস্থাতেই আল্লাহর আইন মেনে চলা আপনাদের কর্তব্য। আল্লাহর আইন জারি হয়ে না থাকলেও আপনাদের এটা জারি করা উচিত। যে ব্যক্তি মনে করে যে, আল্লাহর পুলিশ, সৈন্য, আদালত এবং জেলখানা কোথাও মওজুদ নেই, কাজেই তাঁর আইন লংঘন করা সহজ, আর গভর্মেন্টের পুলিশ, ফৌজ, আদালত এবং জেলখানা চারদিকে বর্তমান আছে, কাজেই তার আইন ভঙ্গ করা বড়ই মুশকিল -তবে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আমি পরিস্কার ভাষায়ই বলে দিচ্ছি যে, لا اله الإ الله محمد الرسول الله কালেমা সে মিথ্যাই পড়েছে। সে এটা দ্বারা তার আল্লাহকে, সারা জাহানকে, সমস্ত মুসলমানকে এবং স্বয়ং নিজের মনকে ধোঁকা দিচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
•ইতিপূর্বে কালেমায়ে তাইয়্যেবার অর্থ আমি বলেছি। এখন সে বিষয়ে অন্য আর একদিক দিয়ে ভেবে দেখতে বলছি।
আল্লাহ তাআলা আপনাদের এবং প্রত্যেক জিনিসেরই মালিক একথা আপনারা স্বীকার করছেন। কিন্তু এর অর্থ কি? এর অর্থ এই যে, আপনাদের জান-মাল আপনাদের নিজের দেহ আল্লাহর। আপনাদের হাত, কান এবং আপনাদের দেহের কোনো একটা অঙ্গও আপনাদের নিজের নয়। যে জমি আপনারা চাষাবাদ করেন, যেসব পশু দ্বারা আপনারা কাজ করান, যেসব জিনিস-পত্র আপনারা সবসময় ব্যবহার করছেন, এদের কোনোটাই আপনাদের নিজের নয় সবকিছুই আল্লাহ তাআলার মালিকানা এবং আল্লাহর দান হিসেবেই এগুলো আপনারা পেয়েছেন। একথা স্বীকার করার পর আপনাদের একথা বলার কি অধিকার থাকতে পারে যে, জান-প্রাণ আমার, শরীর আমার, মাল আমার, অমুক জিনিস আমার, আর অমুক জিনিসটি আমার। অন্য একজনকে কোনো জিনিসের মালিক বলে ঘোষণা করার পর তার জিনিসকে আবার নিজের বলে দাবী করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। যদি বাস্তবিকই আল্লাহকে দুনিয়ার সমস্ত জিনিসের মালিক মনে করেন, তবে তা হতে আপনা আপনি দু’টি জিনিস আপনাদের ওপর এসে পড়ে।
•প্রথম এই যে, আল্লাহ-ই যখন মালিক আর তিনি তাঁর মালিকানার জিনিস আমানত স্বরূপ আপনাদেরকে দিয়েছেন, তখন সেই মালিকের হুকুম মতোই আপনাদের সে জিনিসগুলো ব্যবহার করতে হবে। তাঁর মর্জির উল্টা কাজ যদি এর দ্বারা করেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনারা আমানতের খেয়ানত করছেন। আপনাদের হাত-পা পর্যন্ত সেই মালিকের মর্জির বিপরীত কাজে ব্যবহার করার কোনো অধিকার আপনাদের নেই। আপনাদের চোখ দ্বারাও তার নিষিদ্ধ জিনিস দেখতে পারেন না, যা তাঁর মর্জির বিপরীত। আপনাদের এ জমি-জায়গাকে মালিকের বিধানের বিরুদ্ধে ব্যবহারে আপনাদের কোনোই অধিকার নেই। আপনাদের যে স্ত্রী এবং সন্তানকে নিজেদের বলে দাবী করেন, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে দান করেছেন বলেই তারা আপনাদের আপন হয়েছে, কাজেই তাদের সাথে আপনাদের ইচ্ছামত নয়-মালিকেরই হুকুম মত ব্যবহার করা কর্তব্য। তার মতের উল্টা যদি ব্যবহার করেন, তবে আপনারা ডাকাত নামে অভিহিত হবার যোগ্য। পরের জিনিস হরণ করলে, পরের জায়গা শক্তির বলে দখল করলে আপনারা তাকে বলেন, বেঈমান; সেরূপ আল্লাহর দেয়া জিনিসকে নিজের মনে করে নিজের ইচ্ছা কিংবা আল্লাহর ছাড়া অন্য কারোও মর্জিমত যদি ব্যবহার করেন, তবে সেই বেঈমানীর অপরাধে আপনারাও অপরাধী হবেন। মালিকের মর্জি অনুসারে কাজ করলে যদিও আপনাদের কোনো ক্ষতি হয় হোক, জান চলে যায় যাক, হাত-পা ভেংগে যায় যাক, সন্তানের লোকসান হয় হোক, মাল ও জমি-জায়গা বরবাদ হয়ে যায় যাক, আপনারা সেই জন্য কোনো পরোয়া করবেন না। জিনিসের মালিকই যদি এর ক্ষয় বা ক্ষতি পছন্দ করেন, তবে তা করার তাঁর অধিকার আছে। তবে হাঁ, মালিকের মর্জির খেলাফ যদি আপনারা করেন, আর তাতে যদি কোনো জিনিসের ক্ষতি হয়ে পড়ে, তবে সে জন্য আপনারাই অপরাধী হবেন, সন্দেহ নেই। কারণ পরের জিনিস আপনারা নষ্ট করেছেন। আপনারা আপনাদের জানকে পর্যন্ত নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারেন না। মালিকের মর্জি অনুসারে জান কুরবান করলে মালিকেরই হক আদায় হবে, তাঁর মতের উল্টা কাজে প্রাণ দিলে মস্তবড় বেঈমানী করা হবে।
•দ্বিতীয় কথা এই যে, মালিক যে জিনিসই আপনাকে দান করেছেন, তা যদি সেই মালিকের কাজেই ব্যবহার করেন, তবে তার দ্বারা কারোও প্রতি কোনো অনুগ্রহ হতে পারে না-মালিকের প্রতিও নয়। এ পথে যদি আপনার কিছু দান করলেন, কোনো খেদমত করলেন, কিংবা আপনাদের প্রিয়বস্তু-প্রাণকে কুরবান করলেন, তবে তা কারোও প্রতি আপনাদের একবিন্দু অনুগ্রহ নয়। আপনাদের প্রতি মালিকের যে, ‘হক’ ছিল এর দ্বারা শুধু তাই আদায় করলেন মাত্র। এতে গৌরব বা অহংকার করার মত কিংবা তারীফ বা প্রশংসা পাবার মত কিছু নেই। মনে রাখবেন, মুসলমান ব্যক্তি মালিকের পথে কিছু খরচ করে কিংবা তার কিছু কাজে কিছুমাত্র গৌরব বোধ করে না, বরং সে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে, গৌরব বা অহংকার ভাল কাজকে বরবাদ করে দেয়। যে ব্যক্তি প্রশংসা পাবার আশা করে এবং শুধু সে উদ্দেশ্যেই ভাল কাজ করে কারণ সে তার কাজের প্রতিফল এ দুনিয়াতেই পেতে চাচ্ছে, আর তাই সে পেয়েছে। নিখিল দুনিয়ার মালিক আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ দেখুন, তিনি তাঁর নিজের জিনিস আমাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন, আর বলেন যে, এ জিনিস তোমাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেন, আর বলেন যে, এ জিনিস তোমাদের কাছ থেকে আমি ক্রয় করলাম এবং তার মূল্যও তোমাদেরকে দেব। আল্লাহু আকবার। আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের কি কোনো সীমা-পরিসীমা আছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে: “আল্লাহ তাআলা ঈমানদার ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করেছেন এবং তার বিনিময়ে তাদের জন্য জান্নাত নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।” (সূরা আত তাওবা: ১১১)
•আপনাদের সাথে মালিকের এরূপ ব্যবহার! কিন্তু আপনি তার সাথে কিরূপ ব্যবহার করছেন, তা একবার বিচার করে দেখুন। মালিক যে বস্তু আপনাদেরকে দিয়েছেন, তারপর সেই মালিক সে জিনিস মূল্য দিয়ে আপনাদের কাছ থেকে ক্রয় করেছেন, সে জিনিসকে আপনারা অন্যের কাছে বিক্রি করছেন, আর খুবই সামান্য ও নিকৃষ্ট মূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করছেন। যার কাছে বিক্রি করছেন সে মালিকের মর্জির উল্টা কাজে আপনাদের সেসব জিনিসকে ব্যবহার করে, আর আপনারা তাদেরকে আপনাদের রিযিকদাতা মনে করেই তাদের কাজ করে থাকেন। মূলত আপনাদের দেহের শক্তিগুলো এমনভাবে বিক্রি করার কোনো অধিকার আপনাদের নেই। আল্লাহদ্রোহী শক্তি যা কিছু কিনতে চায়, আপনারা তাই তাদের কাছে বিক্রি করেন, তা অপেক্ষা বড় দুর্নীতি আর কি হতে পারে? একবার বিক্রি করা জিনিসকে পূণরায় অন্যের কাছে বিক্রি করা আইনত এবং নীতিগতভাবে অপরাধ। দুনিয়ায় এজন্য আপনার বিরুদ্ধে প্রবঞ্চনার মামলা চলতে পারে। আপনারা কি মনে করেন আল্লাহর আদালতে এ বিষয়ে মামলা চলবে না?
•কালেমায়ে তাইয়্যেবার অর্থ ইতিপূর্বে বলেছি ; এখানে সেই সম্পর্কেই আর একটু ব্যাখ্যা করে আপনাদেরকে বুঝাতে চাই। কারণ এ কালেমাই ইসলামের মূল ভিত্তি, এরই সাহায্যে মানুষ ইসলামে দাখিল হয়, আর এ কালেমাকেই ভালো করে না বুঝে এবং সে অনুসারে নিজের জীবনকে গঠন না করে কোনো মানুষ মুসলমান থাকতে পারে না। আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে এ কালেমার পরিচয় এভাবে দিয়েছেন :
•“কালেমায়ে তাইয়্যেবার উদাহরণ যেমন কোনো ভাল জাতের গাছ, এর শিকড় মাটির নীচে মজবুত হয়ে গেঁথে রয়েছে। এর শাখা-প্রশাখাগুলো আকাশের শূন্যলোকে বিস্তৃত-আল্লাহর হুকুমে তা অনবরত ফলের পর ফলদান করছে। আল্লাহ এরূপ দৃষ্টান্ত মানুষের উপদেশ গ্রহণের জন্য দিয়েছেন। এর বিপরীতে হচ্ছে কালেমায় খাবিসাহ অর্থাৎ খারাপ আকিদা ও মিথ্যা কথা। এর উদাহরণ যেমন বন-জঙ্গলের ছোট ছোট আগাছা-পরগাছা। মাটির একেবারে উপরিভাগে তা জন্মে, সামান্য এক টানেই তা উৎপাটিত হয়ে যায়; কারণ এর শিকড় মাটিতে খুব মজবুত হয়ে গাঁথতে পারে না। আল্লাহ সেই পাকা কথার দরুন মু’মিনদেরকে ইহকালে ও পরকালে সুদৃঢ় রাখেন এবং যালেমদেরকে বিভ্রান্ত করে থাকেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।”-সূরা ইব্রাহীম : ২৪-২৭
•আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা এমন একটা অতুলনীয় উদাহরণ দিয়েছেন যে, আপনারা একট চিন্তা করলেই এটা হতে খুব বড় শিক্ষা পেতে পারেন। দেখুন একটি আম গাছের শিকড় মাটির কত নীচে গেঁথে রয়েছে, ওপরের দিকে কতখানি উচ্চ হয়ে ওঠেছে, তার কত ডাল-পালা চারদিকে বিস্তৃত হয়েছে, আর তাতে প্রতি বছর কত ভাল ভাল ফল ফলছে। কিন্তু এটা কেমন করে হলো? এর বীজ খুব শক্তিশালী ছিল বলেই এত বড় একটা গাছ হবার তার পূর্ণ ‘হক’ ছিল। আর সেই ‘হক’ এত সত্য ছিল যে, যখন এটা নিজের ‘হক’ এর দাবী করলো, তখন মাটি, পানি, বায়ু, দিনের গরম, রাতের ঠান্ডা সব জিনিসই তার দাবী মেনে নিয়েছে। পরে সে মিষ্টি মিষ্টি ফল দিয়ে একথা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বাস্তবিকই এমন একটা গাছ হওয়ার তার অধিকার ছিল। আকাশ ও পৃথিবীর সকল শক্তি একত্র হয়েও যদি তার সাহায্য করে থাকে, তবে তা কিছুমাত্র অন্যায় করেনি, বরং এদের এরূপ করাই উচিত ছিল। কারণ জমি, পানি, বায়ু এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জিনিসের মধ্যে গাছপালার খোরাক যোগাবার ও এদের বড় করে তোলার শক্তি এজন্য নিহিত আছে যে, তা দ্বারা ভাল জাতের গাছগুলোর অন্য উপকার হবে।
•এছাড়া বন-জঙ্গলে ছোট ছোট এমন কত গাছ আছে-যা নিজে নিজেই হয়েছে। এদের মধ্যে কি শক্তি আছে? ছোট একটু শিকড় একটা ছোট ছেলে তা টেনে উপড়ে ফেলতে পারে। কিংবা তা এতই নরম ও দুর্বল যে, একটু দমকা হাওয়া লাগলেই তা নত হয়ে পড়ে। তা কাঁটায় ভরা, স্পর্শ করলেই কাঁটা বিদ্ধ হয়। তা মুখে দিলে মুখ নষ্ট করে দেয়। রোজ রোজ কত জন্ম হয়, কত যে উপড়িয়ে ফেলা হয়, তার হিসেব আল্লাহই জানেন। এগুলোর এরূপ অবস্থা কেন? কারণ এগুলোর মধ্যে আম গাছের মত অতখানি জোর নেই। জমিতে যখন ভাল জাতের গাছ হয় না, তখন জমি বেকার পড়ে থেকে একেবারে হতাশ হয়ে যায়। কাজেই সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব আগাছা পরগাছাকে তার বুকে স্থান দেয়। পানি কিছু সাহায্য করে, বায়ু তার কিছু শক্তি দান করে; কিন্তু আকাশ ও পৃথিবীর কোনো জিনিসই এসব পরগাছার কোনো স্বত্ব স্বীকার করতে চায় না। এজন্য জমি তার বুকের মধ্যে এদের শিকড় বিস্তৃত হতে দেয় না, পানি ওর খুব বেশী সাহায্য করে না। আর বায়ুও ওকে প্রাণ খুলে বাতাস দান করে না। এভাবে টানাটানির পর যখন এটা একটু মাথা জাগায়, তখন তা এত তিক্ত ও বিষাক্ত হয়ে ওঠে যাতে প্রমাণ হয়ে যায় যে, আকাশ ও পৃথিবীর শক্তিসমূহ মূলত এ আগাছা জন্মাবার জন্য নয়। আগাছাগুলো প্রকৃতির বুক হতে সামান্য কিছু শক্তি যে পেয়েছে এদের পক্ষে এটাই মস্ত ভাগ্যের কথা।
•এ দু’টি উদাহরণ সামনে রাখুন, তারপর কালেমায়ে তাইয়্যেবা ও কালেমায়ে খাবীসার পার্থক্য সম্পর্কে ভাল করে চিন্তা করুন।
কালেমায়ে তাইয়্যেবা কী?-একটা সত্য কথা ; এমন সত্য কথা যে, এ দুনিয়ায় তা অপেক্ষা অধিক সত্য কথা আর একটিও নেই। এক আল্লাহই সারে জাহানের ইলাহ, আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসই একথার সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছে।মানুষ, জানোয়ার, গাছ, পাথর, বালুকণা, প্রবাহমান ঝর্ণা, উজ্জ্বল সূর্য চারদিকে বিস্তৃত এ সমস্ত জিনিস-এর কোনটাকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেন নি? আল্লাহ ছাড়া আর কেউ কি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন ? তাঁর দয়া ও মেহেরবানী ছাড়া অন্য কারোও অনুগ্রহে কি এগুলো বেঁচে আছে ? এদের মধ্যে কোনো একটিকেও কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জীবন বা মৃত্যু দান করতে পারে ? এ সারে জাহান যখন আল্লাহ তাআলারই সৃষ্টি। তাঁরই দয়ায় যখন এসবকিছু বর্তমান আছে এবং তিনিই যখন এসবের একমাত্র মালিক ও হুকুমদাতা, তখন যে সময়েই আপনি বলবেন এ পৃথিবীতে সে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোও প্রভুত্ব বা খোদায়ী নেই, তৎক্ষণাৎই আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিসই বলে ওঠবে : তুমি সত্য কথাই বলেছো, আমরা সকলেই তোমার কথার সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছি। সেই আল্লাহর সামনে যখন আপনি মাথা নত করবেন, বিশ্বভুবনের প্রত্যেকটি জিনিসই আপনার সাথে তারই সামনে ঝুঁকে পড়বে। কারণ,-এ সমস্ত জিনিসও একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করে। আপনি যখন তাঁর পথে চলতে শুরু করবেন, তখন আপনি একাকী হবেন না, এ নিখিল জাহানের অগণিত ‘সৈন্য’ আপনার সাথে চলতে আরম্ভ করবে। কারণ, আকাশের সূর্য হতে শুরু করে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম বস্তুকণা ওপর নির্ভর করবেন, তখন সামান্য শক্তির ওপর নির্ভর করা হবে না-আপনার শক্তি ও ধন-সম্পদের একমাত্র মালিক। মোটকথা, এ নিগূঢ় তত্ত্ব যদিও আপনি কালেমায়ে তাইয়্যেবার প্রতি ঈমান এনে যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে সেই আদর্শ অনুসারে গঠন করে নেবে, আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় শক্তিই তার সাহায্য কাজে নিযুক্ত হবে। দুনিয়ার জীবন হতে পরকাল পর্যন্ত সে কেবল উন্নতিই করতে থাকবে। তার কোনো চেষ্টাই ব্যর্থ হবে না, কোনো উদ্দেশ্যই অপূর্ণ থাকতে পারবে না। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা একথাই বলেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন : ‘এই কালেমা এমন একটা গাছ, যার শিকড় গভীর মাটির তলে মজবুত হয়ে গেঁথে রয়েছে এবং শাখা প্রশাখা আকাশের মহাশূন্যে বিস্তৃত হয়ে আছে। আর সবসময়ই তারা আল্লাহর হুকমে ফলদান করে থাকে।’
•‘কালেমায়ে খাবীসাহ’ এর সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদ উপস্থিত করে। কালেমায়ে খাবীসাহ অর্থ : এ দুনিয়ার ইলাহ বা সৃষ্টিকর্তা কেউ নেই, কিংবা এ দুনিয়ায় একাধিক ইলাহ রয়েছে। একটু চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, তা অপেক্ষা বড় মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন কথা আর কিছুই হতে পারে না। আকাশ ও পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই বলে ওঠে, তুমি মিথ্যাবাদী, নিশ্চয়ই আল্লাহ আছেন। আমাদেরকে আর তোমাদেরকে সেই আল্লাহই তো সৃষ্টি করেছেন। আর সে আল্লাহই তোমাদেরকে ঐ জিহ্বা দিয়েছেন যার দ্বারা তুমি এতবড় একটা মিথ্যা কথা বলছো। মুশরিক বলে যে, আল্লাহ এক নয়, তাঁর সাথে আরও অনেক দেবদেবী রয়েছে। তারাও রিযিক দেয়, তারাও তোমাদের মালিক, তারাও তোমাদের ভাগ্য গড়তে ও ভাংগতে পারে। উপকার করা কিংবা ক্ষতি করার ক্ষমতা তাদেরও আছে। আমাদের দোয়া তারাও শুনতে পারে। তারাও আমাদেও মকসুদ পূর্ণ করতে পারে, তাদেরকে ভয় করে চলা উচিত। তাদের ওপর ভরসা করা যেতে পারে। দুনিয়া পরিচালনার ব্যাপারে তাদেরও হুকুম চলে। আল্লাহ ছাড়া তাদেরও হুকুম পালন করে চলা কর্তব্য। এসবই কালেমায়ে খাবীসাহ। এসব কথার উত্তরে আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিস বলে ওঠে : ‘তুমি মিথ্যাবাদী, তোমার প্রত্যেকটা কথাই সত্যের বিলকুল খেলাফ।’ এখন ভেবে দেখুন, এ কালেমা যে ব্যক্তি কবুল করবে এবং সে অনুসারে নিজের জীবনকে গঠন করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে সে কেমন করে উন্নতি লাভ করতে পারে ? আল্লাহ অনুগ্রহ করে এসব লোকেকে অবসর ও অবকাশ দিয়ে রেখেছেন এবং রিযিক দেবারও ওয়াদা করেছেন। কাজেই আকাশ ও পৃথিবীর শক্তিগুলো কিছু না কিছু পরিমাণে তাদেরকে প্রতিপালন করবে--যেমন বন-জঙ্গলে আগাছা-পরগাছাগুলোকে করছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো একটা জিনিসও আগ্রহ করে তাদেরকে সাহায্য করবে না এবং পূর্ণশক্তি দিয়ে তাদের সহায়তা করবে না। তারা ঠিক জঙ্গলের মতই কিছুদিন মাত্র বেঁচে থাকতে পারবে-তার বেশী নয়।
উক্তরূপ পার্থক্য এ কালেমাদ্বয়ের পরিণাম ফলের ব্যাপারেও বর্তমান রয়েছে। ‘কালেমায়ে তাইয়্যেবা’ যখন ফল দান করবে, তখন তা খুবই মিষ্ট ও সুস্বাদুই হবে। দুনিয়ার বুকে তা দ্বারা শান্তি স্থাপিত হবে। চারদিকে সত্য ও পূর্ণ সুবিচার কায়েম হবে। নিখিল দুনিয়ার মানুষ তা দ্বারা অসাধারণ উপকার লাভ করতে পারবে। কিন্তু কালেমায়ে খাবীসাহ যতই বৃদ্ধি পাবে, কেবল কাঁটায় ভরা ডাল-পালাই তা হতে বের হবে। তিক্ত ও বিষাক্ত ফল তাতে ফলাবে। এর শিরায় শিরায় বিষ ভরা থাকবে।
•নিজেদের চোখ দিয়েই আপনারা তা দেখে নিতে পারেন। দুনিয়ার যেখানেই কুফরি, শিরক এবং নাস্তিকতার জোর বেশী, সেখানে কী হচ্ছে ? সেখানে মানুষ মানুষের রক্ত পান করছে। দেশের পর দেশ গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করার আয়োজন খুব জোরের সাথেই চলছে। বিষাক্ত গ্যাস তৈরী হচ্ছে। এক জাতি অন্য জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য ওঠেপড়ে লেগেছে। শক্তিমান দুর্বল ব্যক্তিগণকে নিজের গোলাম বানিয়ে রেখেছে-তার ভাগের রুটি কেড়ে নেবার জন্য শুধু দুর্বল মানুষকে সেখানে সৈন্য, পুলিশ, জেল ও ফাঁসির ভয় দেখিয়ে অবদমিত করে রাখার এবং শক্তিশালী জাতির যুলুম নীরবে সহ্য করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। এছাড়া এসব জাতির ভিতরের অবস্থা আরও ভয়ানক খারাপ । তাদের নৈতিক চরিত্র এতই কদর্য যে, স্বয়ং শয়তানও তা দেখে লজ্জা পায়। মানুষ সেখানে জন্তু-জানোয়ার অপেক্ষাও হীনতর কাজ করছে। মায়েরা সেখানে নিজেদের হাতেই নিজেদেও সন্তানকে হত্যা করছে-যেন এ সন্তান তাদের সুখ-সম্ভোগের পথে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে না পারে। স্বামীরা সেখানে নিজেদের স্ত্রীদেরকে অন্যের কোলে ঠেলে দিচ্ছে শুধু পরের স্ত্রীকে নিজের বুজে পাবার উদ্দেশ্যে। উলংগদের ক্লাব ঘর তৈরী করা হয়েছে, সেখানে নারী-পুরুষ পশুর মতো উলংগ হয়ে চলাফেরা করছে। ধনী ব্যক্তি সুদ গ্রহণ করে গরীবদের প্রতি কেনা গোলামের ন্যায় ব্যবহার করছে। মনে হয়, কেবল তাদেরই খেদমত করার জন্য দুনিয়ায় এদের জন্ম হয়েছে। মোটকথা, এ ‘কালেমায়ে খাবীসা’র দরুন সেখানে কাঁটায় চারদিকে ভরে গেছে; আর যে ফলই তাতে ফলছে তা হয়েছে ভয়ানক তিক্ত ও বিষাক্ত।
•আল্লাহ তাআলা এ দুটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করার পর বলেছেন, ‘কালেমায়ে তাইয়্যেবা’র প্রতি যারা ঈমান আনবে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে একটি মজবুত বাণীর সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন-তারা অটল ও অক্ষয় হবে। আর তার মোকাবিলায় ‘কালেমায়ে খাবীসা'কে যারা বিশ্বাস করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের সকল আয়োজন ও চেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দেবেন। তারা কখনই কোনো সহজ কাজ করতে পারবে না। তা দ্বারা দুনিয়া কিংবা আখেরাতে তাদের কিছুমাত্র কল্যাণও সাধিত হতে পারে না।
•‘কালেমায়ে তাইয়্যেবা’ ও ‘কালেমায়ে খাবীসা’র পার্থক্য ও উভয়ের ফলাফল আপনারা শুনলেন। এখন আপনারা অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে পারেন যে, আমরাও ‘কালেমায়ে তাইয়্যেবা’কে মানি ; কিন্তু তবু কোন্ কারণে আমাদের উন্নতি হয় না ? আর যে কাফেরগণ কালেমায়ে খাবীসাকে বিশ্বাস করে তারাই বা কোন কারণে এত শক্তিমান ও উন্নত হচ্ছে?
এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার ভার আমার ওপর। আমি এর জবাব দেব, কিন্তু পূর্বেই বলেছি, আমার জবাব শুনে কেউ রাগ করতে পারবেন না। আমার জবাব ঠিক কি না আপনার শুধু তাই বিচার করে দেখবেন।
•আপনারা কালেমায়ে তাইয়্যেবার প্রতি ঈমান এনেছেন বলে দাবী করেন এবং তবুও আপনাদের উন্নতি হচ্ছে না, প্রথমত এ কথাটাই মিথ্যা। কারণ কেবল মুখে মুখে কালেমায়ে তাইয়্যেবা পড়লেই কোনো কাজ হয় না, তা মন দিয়ে পড়তে হবে। মন দিয়ে পড়ার অর্থ বিশ্বাস ও মতবাদের পরিবর্তন করা। এর বিরোধী কোনো বাদ বা মতবাদ যেন কালেমা বিশ্বাসী ব্যক্তির মনে স্থান না পায় এবং কালেমার নির্দেশের বিপরীত কোনো কাজও যেন সে কখনও না করে। কিন্তু বলুন, আপনাদের প্রকৃত অবস্থা কি এরূপ ? আপনাদের মধ্যে কি কালেমায়ে তাইয়্যেবার বিপরীত হাজারও কুফরি ও মুশরিকী ধারণা বর্তমান নেই ?
•মুসলমানের মাথা কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোও সামনে নত হয় না ? মুসলমান আল্লাহ ছাড়া অন্য লোককে কি ভয় করে না ? অন্যের সাহায্যের ওপর কি ভরসা করে না ? আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও কি তারা রিযিকদাতা বলে বিশ্বাস করে না ? আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও কি তারা রিযিকদাতা বলে বিশ্বাস করে না ? আল্লাহর আইনকে ছেড়ে দিয়ে তারা খুশী হয়েই কি অন্যের আইন অনুসরণ করে চলে না ? মুসলমান হবার দাবীদার লোকেরা আদালতে গিয়ে পরিস্কারভাবে বলে না যে, আমরা শরীয়তের বিচার চাই না? আমরা দেশের প্রচলিত প্রথা মত বিচার চাই। আপনাদের মধ্যে এমন কোনো লোক কি নেই, যারা দুনিয়ার সামান্য স্বার্থ লাভের জন্য আল্লাহর আইন লংঘন করতে একটুও পরোয়া করে না ? আপনাদের মধ্যে এমন লোক কি নেই, যারা কাফেরদের ক্রোধের ভয়ে ভীত ; কিন্তু আল্লাহর গযবকে মোটেই ভয় করে না ? এমন লোক কি আপনাদের মধ্যে নেই, যারা কাফেরদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করার জন্য কিছুই করতে রাজী নয় ? এমন লোকও কি নেই, যারা কাফেরদের রাজত্বকে ‘রাজত্ব’ বলে মনে করে, কিন্তু আল্লাহর রাজত্ব যে কোথাও বর্তমান আছে, সেই কথা তাদের একেবারেই মনে পড়ে না ? সত্য করে বলুন, এসব কথা কি সত্য নয় ? যদি বাস্তবিকই সত্য হয়ে থাকে, তবে আপনারা কালেমায়ে তাইয়্যেবাকে স্বীকার করেন এবং তা সত্ত্বেও আপনারদের উন্নতি হয় না একথা কোন মুখে বলতে পারেন ? প্রথমে খাঁটি মনে ঈমান আনুন এবং কালেমায়ে তাইয়্যেবা অনুসারে জীবনকে গঠন করুন। তারপর যদি গভীর মাটির তলে মজবুত শিকড় ও শূন্য আকাশে বিস্তৃত শাখার সেই মহান গাছের জন্ম না হয়, তখন বলতে পারবেন যে, আল্লাহ মিথ্যা ওয়াদা করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। পরন্তু কালেমায়ে খাবীসাহ বিশ্বাসী লোক দুনিয়ায় খুবই উন্নতি লাভ করছে বলে মনে করাও সম্পূর্ণরূপে ভুল। কারণ কালেমায়ে খাবীসাকে যারা মানবে তারা উন্নতি লাভ করতে পারে না ; অতীতে কখনও পারেনি আর এখনও পারছে না।
•তাদের ধন-দৌলত, সুখ-শান্তি ও ফুর্তির জীবন, বিলাসিতা ও আনন্দের সাজ-সরঞ্জাম এবং বাহ্যিক শান-শওকত দেখে আপনারা হয়ত মনে করেছেন যে, তারা আসলে বুঝি খুবই উন্নতি করছে। কিন্তু আপনারা তাদের মনের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাদের মধ্যে কতজন লোক বাস্তবিকই শান্তিতে আছে? বিলাসিতা ও সুখের সরঞ্জাম তারেদ প্রচুর আছে ; কিন্তু মনের মধ্যে আগুনের উল্কাপিন্ড সবসময় দাউ দাউ করে জ্বলছে। এজন্যই তারা এক আল্লাহকে পেতে পারে না। আল্লাহর আইন অমান্য করার কারণে তাদের প্রত্যেকটি পরিবার জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে পরিণত হচ্ছে। খবরের কাগজ খুজে দেখুন, ইউরোপ ও আমেরিকায় আত্মহত্যার হিড়িক পড়ে গেছে। কত অসংখ্য তালাক দিন-রাত সংঘটিত হচ্ছে। সেই দেশের সন্তান কিভাবে নষ্ট করা হচ্ছে এবং ওষুধ ব্যবহার করে জন্মের হার কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। নানা প্রকার দূষিত রোগে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কিভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে খাদ্য নিয়ে কিভাবে টানাটানি ও কাড়াকাড়ি চলছে। হিংসা-দ্বেষ এবং শত্রুতা এক জাতীয় মানুষের মধ্যে কিভাবে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। বিলাসিতার লোভ মানুষের জীবনকে কতখানি তিক্ত করে দিয়েছে। দুনিয়ার এসব বড় বড় চাকচিক্যময় শহরে দূর হতে দেখে যাকে আপনার স্বর্গের সমান মনে করেন লক্ষ লক্ষ লোক কি দুঃখের জীবন যাপন করছে, তা ভাবলেও শরীর শিউরে ওঠে! --এটাকে কি কখনও উন্নতি বলে মনে করা যায়? এ ‘স্বর্গ’ পাবার জন্যই কি আপনার লালায়িত ?
•মনে রাখবেন, আল্লাহর বাণী কখনও মিথ্যে হতে পারে না। বাস্তবিকই কালেমায়ে তাইয়্যেবা ছাড়া আর কোনো ‘কালেমা’ এমন নেই, যা অনুসরণ করে মানুষ দুনিয়ায় সুখ এবং পরকালে মহাশান্তি লাভ করতে পারে। যে দিকে ইচ্ছে আপনারা চোখ খুলে চেয়ে দেখুন, এ সত্যের বিপরীত আপনারা কোথাও দেখতে পাবেন না।
•পূর্বেই দু’টি প্রবন্ধে কালেমায়ে তাইয়্যেবার বিশদ অর্থ আপনাদের সামনে ব্যক্ত করেছি ; বর্তমান প্রবন্ধে আমি কালেমায়ে তাইয়্যেবার প্রতি ঈমান আনার আবশ্যকতা এবং তার উপকারিতা ব্যক্ত করতে চেষ্টা করবো।
•আপনারা সকলে জানেন যে, মানুষ দুনিয়ায় যে কাজই করুক না কেন, তার মূলে একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই বর্তমান থাকে এবং কিছু না কিছু উপকার পাবার জন্যই মানুষ সে কাজ করে থাকে। বিনা উদ্দেশ্যে, বিনা গরজে এবং বিনা উপকারিতায় কোনো কাজ কেউই করে না। আপনারা পানি পান করেন কেন ? পান করেন এ জন্য যে, তাতে আপনাদের পিপাসা না মিটতো তবে আপনারা কিছুতেই পানি পান করতেন না। কারণ, এ পানি পান করায় কোনো ফল নেই। আপনারা খাদ্যদ্রব্য কেন আহার করেন ? এ উদ্দেশ্যে যে, তাতে আপনাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হবে এবং আপনাদের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আহার ও অনাহার উভয়েরই ফল যদি একরূপ হয়, তবে খাদ্য ভক্ষণের কাজটাকে আপনারা একটা বাজে কাজ বলে মনে করতেন। রোগ হলে আপনারা ওষুধ সেবন করেন এ জন্য যে, তাতে রোগ দূর হয়ে যাবে এবং আপনারা পূর্ণ স্বাস্থ্যবান হবেন ; কিন্তু ওষুধ সেবন করার পরও যদি রোগ দূর না হয়, বরং পূর্বের মতোই অবস্থা বর্তমান থাকে তাহলে আপনি অবশ্যই বলবেন, এ ওষুধ সেবন করা সম্পূর্ণ নিষ্ফল। কৃষি কাজে আপনারা এত পরিশ্রম করেন কেন ? করেন এ জন্য যে, আপনারা এর দ্বারা শস্য, ফল ও নানারকমের তরিতরকারী পেতে পারেন। কিন্তু বীজবপন করার পরও যদি জমিতে কোনো শস্য না হয় তবে আপনারা হাল-চাষ, বীজ বোনা এবং তাতে পানি দেয়ার জন্য এতদূর কষ্ট কিছুতেই স্বীকার করতেন না। মোটকথা দুনিয়ায় আপনারা যে কাজই করেন না কেন, তাতে উদ্দেশ্য সফল হলে কাজ ঠিকমত হয়েছে বলে মনে করা হয়। আর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলে আপনারা বলেন যে, কাজ ঠিকমত করা হয়নি।
•এ নিগূঢ় কথাটি মনে রাখুন তারপর আপনারা আমার এক একটা প্রশ্নের জবাব দিতে থাকুন। প্রথম প্রশ্ন এই যে, কালেমা পড়া হয় কেন ? এ প্রশ্নের জবাবে আপনি এছাড়া আর কিছুই বলতে পারেন না যে, কালেমা পড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এর দ্বারা কাফের ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা । কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে, কাফের ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য করার অর্থ কি ? এর অর্থ কি এই যে, কাফেরের দু’টি চোখ, কাজেই মুসলমান কালেমা পড়লে তার চারটি চোখ হবে ? অথবা কাফেরের মাথা একটি কাজেই মুসলমানের মাথা দু’টি হবে ? –আপনি নিশ্চয়ই বলবেন যে, না এখানে দৈহিক পার্থক্যের কথা বলা হচ্ছে না। পার্থক্য হওয়ার আসল অর্থ এই যে, কাফেরের পরিণাম ও মুসলমানের পরিণাম পার্থক্য হবে। কাফেরের পরিণাম এই যে, পরকালে সে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হবে এবং তার জীবনের উদ্দেশ্য বিফল হয়ে যাবে। আর মুসলমানের পরিণাম এই যে, সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবে এবং পরকালে সে সফল হবে-মহাসুখে কালযাপন করবে।
•আপনাদের এ জবাব শুনে আমি বলবো যে, আপনারা ঠিক জবাবই দিয়েছেন। কিন্তু আপনারা আমাকে বলুন : পরকাল কাকে বলে ? পরকাল বিফল ও সার্থক হওয়ার অর্থ কি ? আর সেখানে সফলতা ও কামিয়াবী লাভের তাৎপর্যইবা কি ? একথাগুলো ভাল করে বুঝে নিতে না পারলে পরবর্তী আলোচনা শুরু করা যায় না।
•এ প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতে হবে না। পূর্বেই এর জবাব দেয়া হয়েছে । বলা হয়েছে : “ইহকাল পরকালের কৃষি ক্ষেত।”
দুনিয়া ও আখেরাত দু’টি ভিন্ন জিনিস নয়। উভয়ই মানুষের একই পথের দু’টি মনজিল। দুনিয়া এ পথের প্রথম মনজিল, আর আখেরাত সর্বশেষ মনজিল। জমি চাষ করা এবং তা হতে ফসল পাওয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক এ দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে ঠিক সে সম্পর্কই বিদ্যমান। আপনারা জমিতে হাল চাষ করেন, তার পরে বীজ বপন করেন, দরকার হলে তাতে পানি দেন, তার পরে আপনারা ফসল পেতে পারেন। সেই ফসল ঘরে এনে তা আপনারা সারা বছর নিশ্চিত হয়ে খেতে থাকেন। আপনি জমিতে যে জমিতে যে জিনিসেরই চাষ করবেন, ফলও তারই পাবেন। ধান বপন করলে ধান পাবেন, পাট বপন করলে পাট পাবেন, গম বপন করলে গমেরই ফসল পাবেন, কাঁটার গাছ যদি বপন না করেন, তবে আপনার ক্ষেতে কিছুই জন্মাবে না। তারপর হাল-চাষ করতে, বীজ বপন করতে, তাতে দরকার মত পানি দিতে এবং ক্ষেতের দেখাশুনা করতে যে ভুল-ত্রুটি আপনার দ্বারা হয় তার মন্দ ফল আপনার ফসল কাঁটার সময়ই জানতে পারেন। আর এসব কাজ যদি আপনি খুব ভালভাবে করে থাকেন, তবে ফসল কাঁটার সময়ই আপনি এর বাস্তব ফল দেখতে পাবেন। দুনিয়া ও আখেরাতের অবস্থাও ঠিক এরূপ। দুনিয়াকে মনে করেন একটা ক্ষেত। এখানে নিজের পরিশ্রম ও চেষ্টার দ্বারা নিজের জন্য ফসল উৎপন্ন করার উদ্দেশ্যে মানুষকে পাঠান হয়েছে। জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে এ কাজের জন্য সময় দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে মানুষ যে ফসলেরই চাষ করে, সেই ফসলই সে মৃত্যুর পর পরকালের জীবনে পেতে পারবে, আর সে ফসলই সেখানে পাবে তার পরকালীন জীবন একমাত্র তারই ওপর নির্ভর করবে। যদি কেউ দুনিয়ায় জীবন ভর ভাল ফসলের চাষ করে, তাতে দরকার মত পানি দেয় এবং তার দেখাশুনাও যদি খুব ভালভাবে করে, তবে পরকালের জীবনে সে যখনই পা রাখবে, তখনই তার পরিশ্রমের ফলস্বরূপ একটি ফলে-ফুলে ভরা শ্যামল বাগিচা দেখতে পাবে। তাকে এ পরকালের জীবনে আর কোনো পরিশ্রম করতে হবে না, বরং দুনিয়ায় জীবন ভর শ্রম করে বাগান সে তৈরী করেছে, সেই বাগানের অফুরন্ত ফলেই তার জীবন সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত হবে। এ জিনিসেরই নাম হচ্ছে জান্নাত। এটা লাভ করতে পারলেই বুঝতে হবে যে, পরকালে সে সফল ও কামিয়াব হয়েছে।
কিন্তু যে ব্যক্তি তার দুনিয়ার জীবনে কেবল কাঁটা, তিক্ত ও বিষাক্ত ফলের বীজ বপন করে, পরকালের জীবনে শুধু তারই ফসল পাবে। সেখানে খারাপ ফসল নষ্ট করে দিয়ে ভাল ফসল তৈরী করার এবং নিজের এ নির্বুদ্ধিতার পরিবর্তে বুদ্ধিমানের মত কাজ করার কোনো সুযোগ বা সময় সে আর পাবে না। সেই খারাপ ফসলের দ্বারাই পরকালের সমস্ত জীবন কাটাতে হবে, কারণ দুনিয়ায় সে শুধু এরই চাষ করেছে। যে কাঁটা সে রোপন করেছিল, পরকালে তাকে সেই কাঁটার শয্যায়ই শায়িত করা হবে। আর যে তিক্ত ও বিষাক্ত ফলের চাষ করেছিল, সেখানে তাঁকে তাই ভোগ করতে হবে। পরকালে ব্যর্থ ও বিফল হওয়ার অর্থ এটাই।
•আখেরাতের ব্যাখ্যা এইমাত্র আমি করলাম, কুরআন ও হাদীস হতেও এটাই প্রমাণিত হয়। এ ব্যাখ্যা হতে নিঃসন্দেহে জানা গেল যে, পরকালের জীবনে মানুষের বিফল কিংবা সফল হওয়া এবং তার পরিণাম ভাল কিংবা মন্দ হওয়া প্রকৃতপক্ষে তার এ দুনিয়ার জীবনের ইলম ও আমল, জ্ঞান ও কাজের ভাল কিংবা মন্দ হওয়ারই একমাত্র ফল এতে কোনো সন্দেহ নেই।
একথাটি বুঝে নেয়ার সাথে সাথে একথাটিও অতি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, মুসলমান ও কাফেরের পরিণাম ফলের পার্থক্য বিনা কারণে হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে পরিণামের পার্থক্য প্রথম সূচনার পার্থক্যের ফলমাত্র। দুনিয়ায় যদি মুসলমান এবং কাফেরের জ্ঞান ও কাজের পার্থক্য না হয়, তবে পরকালেও তাদের পরিণামের দিক দিয়ে কোনোই পার্থক্য হতে পারে না। দুনিয়ায় এক ব্যক্তির জ্ঞান ও কাজ ঠিক একজন কাফেরের জ্ঞান ও কাজের মত হবে অথচ পরকালে কাফেরের দুঃখময় পরিণাম হতে সে বেঁচে যাবে, এটা কিছুতেই হতে পারে না।
•এখন আবার সেই গোড়ার প্রশ্ন জেগে ওঠে যে, কালেমা পড়ার উদ্দেশ্য কি ? প্রথমে আপনি এ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন যে, কাফেরের পরিণাম ও মুলমানের পরিণামে পার্থক্য হওয়াই কালেমা পড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য। তারপরে আপনি পরিণাম ও পরকালের যে ব্যাখ্যা শুনিয়েছেন, সেই অনুসারে আপনার প্রদত্ত জবাব সম্পর্কে আপনাকে আবার একটু ভেবে দেখতে হবে এবং আপনাকে এখন একথাই বলতে হবে যে, কালেমা পড়ার উদ্দেশ্য দুনিয়ার মানুষের ইলম বা জ্ঞান ও কাজকে ঠিক এমনভাবে করা-যেন পরকালে তার পরিণাম ভালো হয়। পরকাল মানুষকে এ দুনিয়ায় সেই ফলের বাগানই বা তৈরি করবে কি করে, আর পরকালে সে কিসের ফল ভোগ করবে ? মানুষ যদি কেবল মুখে মুখেই এ কালেমা পড়ে ; কিন্তু তার জ্ঞান যদি কালেমা না পড়া ব্যক্তির মতো হয় এবং তার কাজ-কর্ম যদি একজন কাফেরের মতো হয়, তাহলে তার বিবেক বলে ওঠবে যে, এভাবে কালেমা পড়ার কোনোই লাভ নেই। এমন ব্যক্তির পরিণাম একজন কাফেরের পরিণামের চেয়ে ভাল হবার কোনো কারণ থাকতে পারে না। শুধু মুখ দিয়ে কালেমা পড়ে আল্লাহর ওপর সে কোনো অনুগ্রহ করেনি। কাজেই বাগান বানাবার নিয়ম না শিখে, বাগান তৈরি না করে এবং সারা জীবন কেবল কাঁটার চাষ করে কোনো মানুষই পরকালের সবুজ-শ্যামল ও ফলে-ফলে ভরা বাগান লাভ করতে পারে না। সেরূপ ধারণা করাও আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। পূর্বে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে প্রকাশ করেছি, যে কাজ করা এবং না করা উভয়েরই ফল এক রকম, সেই কাজের কোনো দাম নেই, তা একেবারেই অর্থহীন। যে ওষুধ সেবন করার পরও রোগীর অবস্থা ঠিক সেই রকম থাকে যেমন ছিল ওষুধ পান করার পূর্বে, তা আসলে ওষুধ নয়। ঠিক এ রকমই কালেমা পড়া মানুষের জ্ঞান এবং কাজ যদি ঠিক কালেমা না পড়া লোকদের মতোই থাকে তবে এমন কালেমা পড়া একেবারেই অর্থহীন। দুনিয়ায়ই যখন কাফের ও মুসলমানের বাস্তব জীবনধারায় কোনোরূপ পার্থক্য হলো না তখন পরকালে তাদের পরিণাম ফল ভিন্ন ভিন্ন হবে কেন ?
•এখন কালেমায়ে তাইয়্যেবা মানুষকে কোন ধরনের জ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং সেই জ্ঞান শেখার পর মুসলাম ও কাফেরের দৈনন্দিন কাজে কোন ধরনের পার্থক্য হওয়া বাঞ্ছনীয় তারই আলোচনা করবো।
•দেখুন, এ কালেমা হতে আপনি সর্বপ্রথম জানতে পারেন যে, আপনি আল্লাহর বান্দাহ, আর কারো বান্দাহ আপনি নন। একথা আপনি জানতে পারলেন তখন আপনা আপনি একথাও আপনার জানা হয়ে গেল যে, আপনি যার বান্দাহ দুনিয়ায় তাঁরই মর্জিমত আপনাকে কাজ করতে হবে। কারণ তাঁর মর্জিও খেলাফ যদি আপনি চলেন বা কাজ করেন, তবে আপনার মালিকের বিরুদ্ধে আপনার বিদ্রোহ করা হবে।
•অতএব, এ কালেমা আপনাকে শিক্ষা দেয় যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল । একথা জেনে নেয়ার সাথে সাথে একথাও আপনি জানতে পারলেন যে, আল্লাহর রাসূল দুনিয়ার ক্ষেতে কাঁটা ও বিষাক্ত ফলের চাষ করার পরিবর্তে ফুল এবং মিষ্ট ফলের বাগান রচনা করার যে নিয়ম দেখিয়ে দিয়েছেন, আপনাকেও ঠিক সেই নিয়মেই কাজ করতে হবে। আপনি যদি সেই নিয়ম অনুসরণ করেন, তবে দুনিয়ায় আপনার কাঁটার চাষ করা হবে এবং পরকালে ঠিক আপনি ফসলরূপে পাবেন, অন্য কিছু নয়।
•এ জ্ঞান লাভের পর আপনার দৈনন্দিন জীবনধারাকেও সেই অনুসারে গঠন করতে হবে। আপনি যদি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, আপনাকে একদিন মরতে হবে, মরার পরে এক ভিন্ন রকমের জীবন যাপন করতে হবে এবং সেই জীবনেও আপনাকে এ দুনিয়ায় অর্জিত ফসলের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে, তাহলে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থাপিত নিয়ম ও বিধান অনুসরণ না করে অন্য কোনো পন্থা অনুযায়ী চলা আপনার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। দুনিয়ায় আপনি চাষাবাদ করেন কেন ? করেন এ জন্য যে, চাষ না করলে ফসল পাওয়া যাবে না। আর ফসল না হলে না খেয়ে মরতে হবে-একথার প্রতি আপনার খুবই বিশ্বাস আছে। আপনি যদি একথা বিশ্বাস না করতেন এবং যদি মনে করতেন যে, চাষ না করলেও ফসল ফলবে কিংবা ফসল ছাড়াও আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন, তাহলে আপনি চাষাবাদের জন্য এত পরিশ্রম কিছুতেই করতেন না ।
•এখন আপনি নিজের সম্বন্ধে চিন্তা করুন। সে ব্যক্তি আল্লাহুকে নিজের প্রভু ও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রাসূল মুখে মুখে স্বীকার করে এবং আখেরাতের ওপর বিশ্বাস আছে বলে দাবী করে কিন্তু তার দৈনন্দিন জীবনে কাজ-কর্ম আল্লাহর কুরআন ও তার সম্বন্ধে জেনে রাখুন যে, তার ঈমান প্রকৃতপক্ষে অতিশয় দুর্বল। সে নিজের ক্ষেতের কাজ না করার মন্দ পরিণাম যেরূপ নিশ্চয়তার সাথে বিশ্বাস করে, যদি ততটুকু নিশ্চয়তার সাথে আখেরাতের জন্য ফসল তৈরি না করার দুঃখময় পরিণাম বিশ্বাস করতো, তবে কখনই সে পরকালের কাজে এরূপ অবহেলা প্রদর্শন করতে পারতো না। কেউ জেনে শুনে নিজের ভবিষ্যতের জন্য কাঁটা বীজের চাষ করে না। যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে না যে, কাঁটা রোপণ করলে তা হতে কাঁটাই জন্মাবে, আর সেই কাঁটাই তাকে কষ্ট দেবে একমাত্র সেই ব্যক্তিই কাঁটা চাষ করতে পারে অন্য কেই নয়। আপনি জেনে শুনে আপনার হাতে জ্বলন্ত অংগার কখনই নিতে পারেন না। কারণ আপনি নিশ্চিত জানেন যে, এতে হাত পুড়ে যাবে। কিন্তু একটি অবুঝ শিশু আগুনে হাত দেয়, কেননা তার পরিণাম যে কত কষ্টদায়ক তা সে আদৌ জানে না।
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
March 19, 2025
এখানে আমি মুসলমানের জন্য প্রয়োজনীয় গুণনসমূহ উল্লেখ করবো। অর্থাৎ মুসলমান হওয়ার জন্য কমপক্ষে শর্ত কি আর মানুষের মধ্যে কমপক্ষে কি কি গুণ বর্তমান থাকলে তাকে মুসলমান বলা যেতে পারে; এখানে আমি সে বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করবো।
একথাটি ভালো করে বুঝার জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে কুফর ও ইসলাম সম্পর্কে সঠিক এবং সম্যক ধারণা অর্জন করতে হবে। এ সম্পর্কে মোটামুটি আপনারা জেনে রাখুন যে, আল্লাহর হুকুম পালন করতে অস্বীকার করাকেই ‘কুফর’ বা কাফেরী বলা হয় ; আর কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুম পালন করে চলা এবং আল্লাহর ওয়াদা পবিত্র কুরআনের বিপরীত যে নিয়ম, যে আইন এবং যে আদেশই হোক না কেন তা অমান্য করাকেই বলা হয় ইসলাম। ইসলাম এবং ‘কুফরে’র এ পার্থক্য কুরআন মজীদের নিম্নোল্লিখিত আয়াতে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছেঃ
﴿وَ مَنْ لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ﴾ ( الماﺌدة-۴۴)
“আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে যারা ফায়সালা করে না তারাই কাফের।”
আদালত ও ফৌজদারীতে যেসব মোকদ্দমা উপস্থিত হয় কেবল সেই সবের বিচার-ফায়সালা কুরআন-হাদীস অনুসারে করার কথা এখানে বলা হয়নি। বরং প্রত্যেকটি মানুষ তার জীবনের প্রত্যেকটি কাজের সময় যে ফায়সালা করে সেই ফায়সালার কথাই এখানে বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি ব্যাপারেই আপনাদের সামনে এ প্রশ্ন ওঠে যে, এ কাজ করা উচিত কি উচিত নয়, অমুক কাজ এ নিয়মে করবো কি আর কোন নিয়মে করবো? এ সময় আপনাদের কাছে সাধারণত দু’প্রকারের নিয়ম এসে উপস্থিত হয়। এক প্রকারের নিয়ম আপনাদেরকে দেখায় আল্লাহর কুরআন এবং রাসূলের হাদীস। আর এক প্রকারের নিয়ম উপস্থিত করে আপনাদের নফস, বাপ-দাদা হতে চলে আসা নিয়ম-প্রথা অথবা মানব রচিত আইন। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া নিয়ম বাদ দিয়ে অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, প্রকৃতপক্ষে সে কুফরির পথই অবলম্বন করে। যদি সে তার সমস্ত জীবন সম্বন্ধেই এ সিদ্ধান্ত করে নেয় এবং কোনো কাজেই যদি আল্লাহর দেয়া নিয়ম অনুসরণ না করে তবে সে পুরোপুরিভাবে কাফের। যদি সে কতক কাজে আল্লাহর হেদায়াত মেনে চলে আর কতকগুলো নিজের নফসের হুকুম মতো কিংবা বাপ-দাদার প্রথা মতো অথবা মানুষের রচিত আইন অনুযায়ী করে তবে যতখানি আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে ঠিক ততখানি কুফরির মধ্যে লিপ্ত হবে। এ হিসেবে কেউ অর্ধেক কাফের, কেউ চার ভাগের এক ভাগ কাফের। কারো মধ্যে আছে দশ ভাগের এক ভাগ কুফরী আবার কারো মধ্যে আছে কুড়ি ভাগের এক ভাগ। মোটকথা, আল্লাহর আইনের যতখানি বিরোধিতা করা হবে ততখানি কুফরি করা হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
বস্তুত কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলার বান্দাহ হয়ে থাকা এবং নফস, বাপ-দাদা, বংশ-গোত্র, মৌলভী সাহেব, পীর সাহেব, জমিদার, তহশীলদার, জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট প্রভৃতি কারো আনুগত্য না করারই নাম হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাস হবে না। আর কারো দাসত্ব কবুল করবে না-এটাই হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তির কাজ। কুরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ
﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْاْ إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللّهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئاً وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً
أَرْبَاباً مِّن دُونِ اللّهِ فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُولُواْ اشْهَدُواْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾ (ال عمران: ۶۴ )
“(হে নবী !) আহলে কিতাবদের বলঃ আস, আমরা ও তোমরা এমন একটা কথায় একত্রিত হই, যা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য (অর্থাৎ তোমাদের নবীরা যা বলেছে, আমিও আল্লাহর নবী হওয়ার কারণে তাই বলছি।) তা এই যে, (১) আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারোও বান্দাহ হবো না, (২) আল্লাহর উলুহিয়াতের সাথে অন্য কাউকেও শরীক করবো না এবং (৩) আমাদের মধ্যে কেউ আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকেও নিজের অভিভাবক ও মালিক বলে মান্য করবো না। এ তিনটি কথা যদি তারা স্বীকার না করে তবে তোমরা তাদেরকে পরিষ্কার বলে দাও তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলমান-অর্থাৎ আমরা এ তিনটি কথাই পুরোপুরি কবুল করে নিচ্ছি।” সূরা আলে ইমরানঃ ৬৪
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
﴿أَفَغَيْرَ دِينِ اللّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ طَوْعاً وَكَرْهاً وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ﴾ (ال عمران: ۸۳
)
“তোমরা কি আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য করতে চাও ? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিস ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তাঁরই আনুগত্য করে যাচ্ছে। আর সকলেই তাঁর কাছে ফিরে যাবে।”
এ দু’টি আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে। তা এই যে, আসল দীন হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা, তাঁর আদেশ পালন করা।আল্লাহর ইবাদাতের অর্থ কেবল এটাই নয় যে, দিন-রাত পাঁচবার তাঁর সামনে সিজদা করলেই ইবাদাতের যাবতীয় দায়িত্ব প্রতিপালিত হয়ে যাবে। বরং দিন-রাত সর্বক্ষণ একমাত্র আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করে চলাকেই প্রকৃতপক্ষে ইবাদাত বলে। যে কাজ করতে তিনি নিষেধ করেছেন, তা হতে ফিরে থাকা এবং তিনি যা করতে আদেশ করেছেন তা পূর্ণরূপে পালন করাই হচ্ছে ইবাদাত। এজন্য প্রত্যেকটি কাজে এবং প্রত্যেকটি হুকুমের ব্যাপারেই কেবলমাত্র আল্লাহর খোঁজ নিতে হবে। নিজের মন ও বিবেক-বুদ্ধি কি বলে, বাপ-দাদারা কি বলে বা করে গেছেন, পরিবার, বংশ ও আত্মীয়গণের মত কি, জনাব মৌলভী সাহেব আর জনাব পীর সাহেব কেবলা কি বলছেন, অমুক সাহেবের হুকুম কি, কিংবা অমুক সাহেবের মত কি-এসব মাত্রই দেখবে না এবং সেই দিকে মাত্রই ভ্রক্ষেপ করা যাবে না। আল্লাহর হুকুম ত্যাগ করে এদের কারও হুকুম পালন করলে আল্লাহর সাথে শিরক করা হবে এবং যার হুকুম মান্য করা হবে তাকে আল্লাহর মতো সম্মান দান করা হবে। কারণ হুকুম দেয়ার ক্ষমতা তো কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলারঃ إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ “আল্লাহর হুকুম ছাড়া মানুষ অন্য কারো হুকুম মানতে পারে না।” মানুষের ইবাদাত-বন্দেগী তো কেবল তিনিই পেতে পারেন, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার অনুগ্রহে মানুষ বেঁচে আছে। আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসই তাঁর হুকুম পালন করে চলছে। একটি পাথর অন্য পাথরের হুকুম মতো কাজ করে না, একটি গাছ আর একটি গাছের আনুগত্য করে না, কোনো পশু অন্য পশুর হুকুমবরদারী করে চলে না।কিন্তু মানুষ কি পশু ,গাছ ও পাথর অপেক্ষাও নিকৃষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা তো শুধু আল্লাহর আনুগত্য করবে, আর মানুষ আল্লাহকে ছেড়ে অন্য মানুষের নির্দেশ মতো চলতে শুরু করবে ? একথাই কুরআনের উল্লেখিত তিনটি আয়াতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।
এ কুফর ও গোমরাহী কোথা হতে আসে এবং মানুষের মধ্যে এটা কিরূপে প্রবেশ করে, অতপর এ সম্পর্কেই আলোচনা করবো।
কুরআন শরীফ এ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, মানুষের মধ্যে আল্লাহকে অমান্য করার ভাব তিনটি পথে প্রবেশ করে।
প্রথম পথ হচ্ছে মানুষের নিজের নফসের খাহেশঃ
﴿وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾ (القصص: ٥٠ )
“আল্লাহর দেয়া বিধান পরিত্যাগ করে যে ব্যক্তি নিজের নফসের ইচ্ছামত চলে তার অপেক্ষা অধিক গোমরাহ করার মতো যত জিনিস আছে তার মধ্যে মানুষের নফসই হচ্ছে তার সর্বপ্রধান পথভ্রষ্টকারী শক্তি। যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছার দাসত্ব করবে,
আল্লাহর বান্দাহ হওয়া তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। কারণ যে কাজে টাকা পাওয়া যাবে, যে কাজ করলে সুনাম ও সম্মান হবে, যে জিনিসে অধিক স্বাদ ও আনন্দ লাভ করা যাবে, আরাম ও সুখ যে কাজে অধিক মিলবে সে কেবল সেসব কাজেরই সন্ধান করবে এবং যেসব কাজে তা দেখতে পাবে, কেবল সে কাজই করতে সে প্রাণ-পণ চেষ্টা করবে। সেসব কাজ করতে যদি
আল্লাহ নিষেধও করে থাকেন, তবুও সে সেদিকে ভ্রক্ষেপ করবে না। আর এসব জিনিস যেসব কাজে পাওয়া যাবে না সেসব কাজ করতে সে কখনও প্রস্তুত হবে না। আল্লাহ তাআলা যদি সেই কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকেন তবুও সে তার কিছুমাত্র পরোয়া করবে না। এমতাবস্থায় একথা পরিষ্কার করে বলা যেতে পারে যে, সে আল্লাহ তাআলাকে তার খোদা রূপে স্বীকার করেনি বরং তার নফসকেই সে তার একমাত্র খোদার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কুরআন শরীফে একথা অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছেঃ
﴿أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلاً - أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا
كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلاً﴾ (الفرقان: ٤٣- ٤٤)
“(হে নবী !) যে ব্যক্তি নিজের নফসের ইচ্ছাকে নিজের খোদা বানিয়ে নিয়েছে, তুমি কি তার সম্পর্কে ভেবে দেখেছ ? তুমি কি এ ধরনের মানুষের পাহারাদারী করতে পার ? তুমি কি মনে কর যে, এদের মধ্যে অনেক লোকই (তোমার দাওয়াত) মানে এবং বুঝে ? কখনও নয়। এরা তো একেবারে জন্তু-জানোয়ারের মত বরং তা অপেক্ষাও এরা নিকৃষ্ট।” যে ব্যক্তি নফসের দাস, সে যে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকতে পারেনা। কোনো পশুকে আপনারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘন করতে দেখবেন না। প্রত্যেক পশু সেই জিনিসই আহার করে যা আল্লাহ তাআলা তার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং ঠিক সেই পরিমাণ খাদ্য খায় যে পরিমাণ তার জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। আর যে জানোয়ারের জন্য যত কাজ নির্দিষ্ট করা হয়েছে প্রত্যেক জানোয়ার সে কাজই করে যায়। কিন্তু এ মানুষ এমনই এক শ্রেণীর পশু যে, সে যখন নফসের দাস হয়ে যায়, তখন সে এমন সব কাজ করে যা দেখে শয়তানও ভয় পেয়ে যায়।মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়ার এটাই প্রথম কারণ। দ্বিতীয় পথ হচ্ছে এই যে, বাপ-দাদা হতে যেসব রসম-রেওয়াজ, যে আকীদা-বিশ্বাস ও মত এবং যে চাল-চলন ও রীতিনীতি চলে এসেছে তার একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকার দরুন মানুষ তার গোলাম হয়ে যায়। আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষাও তাকে বেশী সম্মানের যোগ্য বলে মনে করে। সেই রসম-রেওয়াজের বিপরীত আল্লাহর কোনো কোনো হুকুম যদি তার সামনে পেশ করা হয়, তবে সে অমনি বলে ওঠে বাপ-দাদারা যা করে গেছে, আমার বংশের যে নিয়ম বহুদিন হতে চলে এসেছে, আমি কি তার বিপরীত কাজ করতে পারি? পূর্ব-পুরুষের নিয়মের পূজা করার রোগ যার মধ্যে এতখানি, আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হওয়া তার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। বাস্তব ক্ষেত্রে তার বাপ-দাদা এবং তার বংশের লোকেরাই তার খোদা হয়ে বসে। সে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করলে তা যে মিথ্যা দাবী হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে বড় কড়াকরিভাবে সাবধান করে দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللّهُ قَالُواْ بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْقِلُونَ شَيْئاً وَلاَ يَهْتَدُونَ﴾ (
البقرة-١٧٠)
“যখনই তাদেরকে বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করে চলো, তখন তারা শুধু একথাই বলে উঠেছে যে, আমাদের বাপ-দাদারা যে পথে চলেছে, আমরা কেবল সে পথেই চলবো। কিন্তু তাদের বাপ-দাদারা যদি কোনো কথা বুঝতে না পেরে থাকে এবং তারা যদি সৎপথে না চলে থাকে, তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে ?
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْاْ إِلَى مَا أَنزَلَ اللّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُواْ حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ
شَيْئاً وَلاَ يَهْتَدُونَ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ عَلَيْكُمْ أَنفُسَكُمْ لاَ يَضُرُّكُم مَّن ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ إِلَى اللّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعاً فَيُنَبِّئُكُم
بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾ ( الماﺌدة:۱۰٤-۱۰٥)
“ যখনই তাদেরকে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ যে বিধান পাঠিয়েছেন তার দিকে আস এবং রাসূলের দিকে আস, তখনই তারা বলেছে যে, আমাদের বাপ-দাদারা যে পথে চলে গেছে, আমাদের পক্ষে তাই যথেষ্ট। কিন্তু তাদের বাপ-দাদারা যদি আসল কথা জানতে না পেরে থাকে এবং তারা যদি সৎপথে না চলে থাকে তবুও কি তারা (অন্ধভাবে) তাদেরই অনুসরণ করে চলবে ? হে ঈমানদারগণ ! তোমাদের চিন্তা করা উচিত। তোমরা যদি সৎপথে চলতে পার, অন্য লোকের গোমরাহীতে তোমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। তোমাদের সকলকেই শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন আল্লাহ তাআলা তোমাদের কাজের ভাল-মন্দ তোমাদেরকে দেখিয়ে দেবেন।”-সূরা আল মায়েদাঃ ১০৪-১০৫
সাধারণভাবে প্রত্যেক যুগের জাহেল লোকেরা এ ধরনের গোমরাহীতে ডুবে থাকে এবং আল্লাহর নবীর দাওয়াত কবূল করতে এ জিনিস তাদেরকে বাধা দেয় । হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন সেই যুগের লোকদেরকে আল্লাহর শরীয়াতের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন তখনও তারা একথাই বলেছেনঃ
﴿أَجِئْتَنَا لِتَلْفِتَنَا عَمَّا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءنَا﴾ (يونس: ٧٨)
“আমাদের বাপ-দাদারা যে পথে চলেছে তুমি কি সেই পথ হতে আমাদেরকে ভুলিয়ে নিতে এসেছো ?” – সূরা ইউনুসঃ ৭৮
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন তাঁর গোত্রের লোকদেরকে শিরক হতে ফিরে থাকতে বললেন, তখন তারাও একথাটি বলেছিলঃ
﴿وَجَدْنَا آبَاءنَا لَهَا عَابِدِينَ﴾ (الانبياء: ٣٥ )
“আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এই দেবতারই পূজা করতে দেখেছি।”
মোটকথা প্রত্যেক নবীরই দাওয়াত শুনে সেই যুগের লোকেরা শুধু একথাই বলেছে, “তোমরা যা বলছো তা আমাদের বাপ-দাদার নিয়মের বিপরীত। কাজেই আমরা তা মানতে পারি না।”
কুরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ
﴿وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِّن نَّذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِم مُّقْتَدُونَ
قَالَ أَوَلَوْ جِئْتُكُم بِأَهْدَى مِمَّا وَجَدتُّمْ عَلَيْهِ آبَاءكُمْ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُم بِهِ كَافِرُونَ فَانتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ
الْمُكَذِّبِينَ﴾ (الٍزخرف: ٣٢ -٢٥ )
“এ রকম ঘটনা সবসময়ই ঘটে থাকে যে, যখনই কোনো দেশে আমি নবী পাঠিয়েছি, সেই দেশের অর্থশালী ও সচ্ছল অবস্থার লোকেরা তখনই একথা বলেছে যে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এক নিয়মে চলতে দেখেছি এবং আমরা ঠিক সেই নিয়মে চলছি। নবী তাদেরকে বললেন, তোমাদের বাপ-দাদার নিয়ম-প্রথা অপেক্ষা অধিক ভাল কথা যদি আমি তোমাদেরকে বলি, তবুও কি তোমরা তাদের নিয়ম অনুসারে চলতে থাকবো ? তারা উত্তরে বললো, আমরা তোমার কথা একেবারেই মানি না। তারা যখন এ জবাব দিল তখন আমিও তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করলাম। আর এখন তোমরা দেখে নাও যে, আমার বিধান অমান্যকারীদের পরিণাম কতখানি মারাত্বক হয়েছে।” - সূরা যুখরূফঃ ২৩-২৫
এসব কথা প্রকাশ করার পর আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা হয় বাপ-দাদারই নিয়ম-প্রথার অনুসরণ কর, না হয় খাঁটিভাবে কেবল আমারই হুকুম মেনে চল ; কিন্তু এ দু’টি জিনিস একত্রে ও এক সাথে কখনও পালন করতে পারবে না।
দু’টি পথের মধ্যে মাত্র একটি পথ ধরতে পারবে। মুসলমান হতে চাইলে সবকিছু পরিত্যাগ করে কেবল আমরা হুকুম পালন করে চলতে থাকঃ
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءنَا أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَى عَذَابِ
السَّعِير- ِوَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى وَإِلَى اللَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ- وَمَن كَفَرَ
فَلَا يَحْزُنكَ كُفْرُهُ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ فَنُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوا ﴾(لقمان: ٢١ -٢٣ )
“ তাদেরকে যখন বলা হলো যে, তোমরা আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসরণ কর ; তখন তারা বলল যে, আমরা তো শুধু সেই পথই অনুসরণ করে চলবো, যে পথে আমাদের বাপ-দাদাকে চলতে দেখেছি। কিন্তু শয়তান যদি তাদেরকে জাহান্নামের দিকে ডাকে, তবুও কি ? যে ব্যক্তি নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিয়েছে এবং নেককার হয়েছে সে তো মযবুত রশি ধারণ করেছে। কারণ সকল কাজের শেষ আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অস্বীকার করবে-হে নবী, তার অস্বীকারের জন্য তোমার দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। তারা সকলেই আমার কাছে ফিরে আসবে । তখন আমি তাদের সকল কাজের পরিণাম ফল দেখিয়ে দেব।” (সূরা লোকমানঃ ২১-২৩)
মানুষকে গোমরাহ করার এটা হচ্ছে দ্বিতীয় কারণ। এরপর তৃতীয় পথ সম্পর্কে কুরআন শরীফে বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন আল্লাহর হুকুম ছেড়ে দিয়ে মানুষের হুকুম পালন করতে শুরু করে এবং ধারণা করে যে, অমুক ব্যক্তি খুব বড়লোক তার কথা নিশ্চয়ই সত্য হবে, কিংবা অমুক ব্যক্তির হাতে আমার রিযক, কাজেই তার হুকুম অবশ্যই পালন করা উচিত অথবা অমুক ব্যক্তির শক্তি ও ক্ষমতা অনেক বেশী, এজন্য তার কথা অনুসরণ করা আবশ্যক ; কিংবা অমুক ব্যক্তি বদ দোয়া করে
আমাকে ধ্বংস করে দিবে অথবা অমুক ব্যক্তি আমাকে সাথে নিয়ে বেহেশতে যাবে, কাজেই সে যা বলে তা নির্ভুল মনে করা কর্তব্য অথবা অমুক জাতি আজকাল খুব উন্নতি করছে, কাজেই তাদের নিয়ম অনুসরণ করা উচিত, তখন সে কিছুতেই আল্লাহর হেদায়াত অনুযায়ী কাজ করতে পারে না।
﴿وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللّهِ إِن يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ﴾ (
الانعام:١١٦)
“ তুমি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করে চল তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে ভুলিয়ে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাবে।”
অর্থাৎ মানুষ সোজা পথে ঠিক তখনই থাকতে পারে যখন তার আল্লাহ কেবলমাত্র একজনই হবে। যে ব্যক্তি শত শত এবং হাজার হাজার লোককে ‘খোদা’ বলে স্বীকার করবে এবং যে ব্যক্তি কখনও এক খোদার কথা মতো আবার কখনও অন্য আর এক খোদার কথা মতো চলবে সে সোজা পথ কখনই পেতে পারে না।
ওপরের আলোচনায় একথা আপনারা ভাল করেই জানতে পেরেছেন যে, মানুষের গোমরাহ হবার তিনটি বড় বড় কারণ বর্তমানঃ
প্রথম - নফসের দাসত্ব।
দ্বিতীয় - বাপ-দাদা, পরিবার ও বংশের রসম-রেওয়াজের দাসত্ব।
তৃতীয় - সাধারণভাবে দুনিয়ার মানুষের দাসত্ব, ধনী, রাজা, শাসনকর্তা, ভন্ড নেতা এবং দুনিয়ার পথভ্রষ্ট জাতিগুলোর দাসত্ব এর মধ্যে গণ্য।
এ তিনটি বড় বড় “দেবতা” মানুষের খোদা হবার দাবী করে বসে আছে। যে ব্যক্তি মুসলমান হতে চায় তাকে সর্বপ্রথম এ তিনটি ‘দেবতাকেই’ অস্বীকার করতে হবে এবং যখনই সে তা করবে তখনই সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারবে। কিন্তু যে ব্যক্তি এ তিন প্রকারের দেবতাকে, নিজের মনের মধ্যে বসিয়ে রাখবে এবং এদের হুকুম মতো কাজ করবে, আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহ হওয়া তার পক্ষে বড়ই কঠিন। সে দিনের মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, সারাদিন লোক দেখানো রোযা রেখে এবং মুসলমানের মতো বেশ ধারণ করে লোককে শুধু ধোঁকাই দিতে পারবে। সে নিজেকেও ধোঁকা দিতে পারবে যে, সে খাঁটি মুসলমান হয়েছে। কিন্তু এত কোনোই সন্দেহ নেই যে, এরূপ কৌশল করে আল্লাহকে কখনও ধোঁকা দিতে পরবে না।
ওপরে আমি যে তিনটি ‘দেবতার’ উল্লেখ করেছি, এদের দাসত্ব করাই হচ্ছে আসল শিরক। আপনারা পাথরের দেবতা ভাংগিয়েছেন, ইট ও চুনের সমন্বয়ে গড়া মূর্তি ও মূর্তিঘর আপনারা ধ্বংস করেছেন ; কিন্তু আপনাদের বুকের মধ্যে যে মূর্তিঘর বর্তমান রয়েছে, সেই দিকে আপনারা মোটেই খেয়াল করেননি। অথচ মুসলমান হওয়ার জন্য এ মূর্তিগুলোকে একেবারে চূর্ণ করে দেয়াই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা দরকারী কাজ ও সর্বপ্রথম শর্ত। যদিও আমি দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানকে লক্ষ্য করেই একথা বলছি এবং আমি জানি যে, দুনিয়ার মুসলমান যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে, এ তিন প্রকারের দেবতার পূজা করাই হচ্ছে তার একমাত্র কারণ। কিন্তু এখানে আমি কেবল এ দেশীয় মুসলমান ভাইগণকে বলছি যে, আপনাদের অধপতন আপনাদের নানা প্রকারের অভাব-অভিযোগ ও বিপদের মূল হচ্ছে উপরোক্ত তিনটি জিনিস। নফসের দাসত্ব, বংশগত প্রথার দাসত্ব এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য মানুষের দাসত্ব আপনাদের মধ্যে এখনও খুব বেশী পরিমাণেই আছে। আর এটাই ভিতর থেকে আপনাদের শক্তি এবং দ্বীন ও ঈমানকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে। আপনাদের মধ্যে আশরাফ-আতরাফ, কুলীন-গৃহস্ত এবং ছোট লোক বড় লোকের পার্থক্য আছে। আর এরূপে আপনাদের সমাজের লোকদেরকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম এ সমস্ত শ্রেণী ও সম্প্রদায়কে এক জাতি ও পরস্পরের ভাই করে একটি মযবুত দেয়ালের মত করতে চেয়েছিল। সেই দেয়ালের প্রত্যেকখানা ইট অন্য ইটের সাথে মযবুত হয়ে গেঁথে থাকবে, এটাই ছিল আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। অথচ আপনারা এখনও সেই পুরাতন হিন্দুয়ানী জাতিভেদের ধারণা নিয়ে রয়েছেন। হিন্দুদের এক গোত্র যেমন অন্য গোত্র হতে পৃথক থাকে আর এক জাতি অন্য জাতিকে ঘৃণা করে আপনারাও ঠিক তাই করেছেন। বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে আপনারা পরস্পর কোন কাজ করতে পারেন না। সকল মুসলমনকে আপনারা সমানভাবে ভাই বলে গ্রহণ করতে পারেন না। মুখে মুখে ভাই বলে থাকেন, কিন্তু কাজের বেলায় আপনাদের মধ্যে ঠিক সেরূপ পার্থক্য থেকে যায় যেমন ছিল আরব দেশে ইসলামের পূর্বে। এসব কারণে আপনারা পরস্পর মিলে একটা মযবুত দেয়াল হতে পারেন না। ভাংগা দেয়ালের নানা দিকে ছড়ানো ইটের মতো আপনারা এক একজন মানুষ পৃথক হয়ে পড়ে রয়েছেন। এ জন্যই না আপনারা এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হতে পারছেন, না কোন বিপদ-আপদের মুকাবিলা করতে পারছেন। ইসলামের সুস্পষ্ট শিক্ষা অনুযায়ী আপনাদেরকে যদি বলা যায় যে, এ সমস্ত ভেদাভেদ ও পার্থক্য চূর্ণ করে দিয়ে ও পরস্পর মিলে-মিশে এক হয়ে যান তাহলে আপনারা তখন ঐ এক কথাই বলবেন যে, আমাদের বাপ-দাদার কাল হতে যে প্রথা চলে এসেছে তা আমরা ভেংগে দিতে পারি না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এর উত্তরে কি বলবেন তা কি আপনারা জানেন ? তিনি বলবেন, বেশ তোমরা এ সমস্ত ভেংগ না, আর এ সমস্ত অমুসলমানী আচার ছেড়ো না, ফলে আমিও তোমাদের একেবারে টুকরো টুকরো করে দেব এবং তোমরা দুনিয়ায় বহু লোক হওয়া সত্তে¡ও আমি তোমাদেরকে লাঞ্চিত ও অধপতিত করে রাখবো। আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে আদেশ করেছেন, তোমাদের ছেলে-মেয়েরা সকলেই তোমাদের সম্পত্তির অংশ পাবে। কিন্তু আপনারা এর কি উত্তর দিয়েছেন? আপনারা বলেছেন, আমাদের বাপ-দাদার আইনে মেয়েরা সম্পত্তির অংশ পেতে পারে না- পেতে পারে একমাত্র ছেলেরাই। কাজেই আমরা বাপ-দাদার আইন মানি আল্লাহর আইন মানতে পারি না। একটু চিন্তা করে দেখুন, এর নাম কি ইসলাম? আপনাদেরকে বলা হয়েছে যে, বংশগত ও দেশ প্রচলিত আইন পরিত্যাগ কর, উত্তরে আপনাদের প্রত্যেকেই বলে ওঠবেন-- সকলে যখন ত্যাগ করবে তখন আমিও করবো। কেননা অন্য লোক যদি তাদের মেয়েকে সম্পত্তির অংশ না দেয়, তাহলে আমার সম্পত্তি তো অন্যের ঘরে চলে যাবে, কিন্তু অন্যের ঘর হতে আমার ঘরে কিছুই আসবে না।-
ভেবে দেখুন, এ উত্তরের অর্থ কি ? অপরে যদি আল্লাহর আইন মানে তবে আপনি মানবেন, এরূপ শর্ত করে কি আপনি আল্লাহর আইনের প্রতি ঈমান এনেছেন ? তাহলে কাল আপনি এটাও বলতে পারেন যে, অপরে ব্যভিচার করলে আমিও ব্যভিচার করবো, অপরে চুরি করলে আমিও চুরি করবো। মোটকথা অপরে যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত গোনাহ না ছাড়বে আমিও ততক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত গোনাহ করতে থাকবো। আসল কথা এই যে, এ ব্যাপারে আমাদের দ্বারা উল্লেখিত তিনটি দেবতারই পূজা করানো হচ্ছে। নফসের বন্দেগী করছেন, বাপ-দাদার প্রথারও বন্দেগী করছেন, আর দুনিয়ার মুশরিক জাতিগুলোর দাসত্বও
আপনারা করছেন। অথচ এ তিনটি দেবতার পূজার সাথে সাথে ইসলামের দাবীও আপনারা করছেন। এখানে মাত্র দু’টি উদাহরণ আমি উল্লেখ করলাম। নতুবা একটু চোখ খুলে তাকালে এত প্রকারের বড় বড় রোগ আপনারদের মধ্যে দেখা যাবে যে, তা গুণেও শেষ করা যাবে না এবং লক্ষ্য করলে আপনি দেখবেন যে, কোথাও একটি দেবতার পূজা চলছে, কোথাও দু’টি দেবতার পূজা করার সাথে সাথে ইসলামেরও দাবী করা একটা হাস্যকর ব্যাপার এবং এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা খাঁটি মুসলমানদের ওপর যে অফুরন্ত রহমত নাযিল করার ওয়াদা করেছেন, ঠিক তাই আমাদের ওপর নাযিল হবে-এরূপ আশা করাও কম হাস্যকর ব্যাপার নয়। পূর্বের প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, কুরআনের মতে মানুষের গুমরাহ হবার আসল কারণ হচ্ছে তিনটি। প্রথম, আল্লাহর আইন ত্যাগ করে নিজের নফসের খাহেশাতের গোলাম হওয়া ; দ্বিতীয়, আল্লাহর আইনের মোকাবিলায় নিজের বংশের রসম-রেওয়াজ ও বাপ-দাদার পথ অনুসরণ করা এবং তৃতীয়, আল্লাহ ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে পথ নির্দেশ করেছেন, তাকে দূরে নিক্ষেপ করে দুনিয়ার মানুষের আনুগত্য করা -সেই মানুষ তার নিজের জাতির প্রতিপত্তিশীল লোক হোক, কিংবা জাতিরই হোক। মুসলমানের খাঁটি পরিচয় এই যে, সে এ তিন প্রকারের রোগ ও গোমরাহী হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে। মুসলমান শুধু তাকেই বলে, যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাস নয় এবং রাসূল ছাড়া অন্য কারো অনুসরণ করে না । সেই ব্যক্তি মুসলমান, যে পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ এবং তাঁর নবীর শিক্ষাই সম্পূর্ণ সত্য, এর বিপরীত যা, তা সবই মিথ্যা। মানুষের দীন-দুনিয়ার মংগল ও উন্নতি কেবলমাত্র আল্লাহ ও রাসুলের মহান শিক্ষার ভেতরেই নিহিত আছে। একথা যে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে পারবে, সে তার জীবনের প্রত্যেক কাজেই কেবল অনুসন্ধান করবে আল্লাহর হুকুম কি, রাসূলের বিধান কি ? আর যখনই তা সে জানতে পারবে তখনই সে সোজাসুজি এর সামনে তার মাথা নত করে দেবে। অতপর তার মন যতই অস্থির হোক না কেন, তার বংশের লোক তাকে ফিরাতে যতই চেষ্টা করুক না কেন এবং দুনিয়ার লোক তার যতই বিরোধিতা করুক না কেন, সে তাদের কারো পরোয়া করবে না। কারণ সে প্রত্যেককেই এই একমাত্র জবাব দিবে, ‘বাঃ আমি তো একমাত্র আল্লাহ তাআলারই বান্দাহ-তোমাদের কারো বান্দাহ নই আর আমি রাসুলের ওপর ঈমান এনেছি-তোমার ওপর ঈমান আনিনি।” কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তি বলে যে, আল্লাহ ও রাসূলের যদি এটা হুকুম হয়ে থাকে তবেই হোক না, আমার আন্তর তা মানে না; অথবা তাতে আমার ক্ষতি হবার আশংকা আছে ; কাজেই আমি আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম ছেড়ে আমার নিজের মতে চলবো -তাহলে এমন ব্যক্তির মনে ঈমানের নাম গন্ধও অবশিষ্ট থাকবে না। সে মু’মিন নয় -বরং মুনাফিক ; মুখে মুখে যদিও সে কেবল আল্লাহর বান্দাহ ও নবীর অনুসরণকারী হবার দাবী করে ; কিন্তু আসলে সে নিজের নফসের বান্দাহ আর তার নিজের মতেরই অনুসরণকারী।অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি যদি বলে যে, আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম যাই হোক না কেন ; কিন্তু অমুক নিয়ম যেহেতু বাপ-দাদার কাল হতে চলে এসেছে, সুতরাং তাকে কেমন করে ছাড়া যায় ? অথবা অমুক নিয়ম তো আমার বংশ বা গোত্রে আবহমানকাল হতে চলে এসেছে, আজ আমি এর বিপরীত কেমন করে করবো? তাহলে এমন ব্যক্তিকেও ঐ মুনাফিকের দলে গণ্য করতে হবে। নামাজ পড়তে পড়তে তার কপালে যতই দাগ পড়ুক না কেন, আর প্রকাশ্যে সে যতই ধার্মিকের বেশ ধারণ করে থাকুক না কেন ; কিন্তু আসলে সে একজন মুনাফিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ এই যে, ধর্মের মূল তত্ত্ব তার মনে মোটেই স্থান পায়নি- তার মন খাঁটিভাবে ইসলামকে কবুল করে না। শুধু রুকু’-সিজদাহ বা রোজা ও হজ্জকে ‘দ্বীন ইসলাম’ বলা হয় না। আর মানুষের বাহ্যিক বেশকে মুসলামনের মত করে নিলে ‘দীন’ পালন করা হয় না। বরং আসলে ‘দীন’ বা ধর্ম বলা হয় আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করাকে। যে ব্যক্তি নিজের জীবনের সমস্ত কাজ-কারবারে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতে অস্বীকার করে তার মনে প্রকৃতপক্ষে ‘দীন’ -এর নাম গন্ধও বর্তমান নেই। তার নামায, রোযা এবং তার পরহেযগারী ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনুরুপভাবে কোনো মানুষ যদি আল্লাহ এবং তাঁর নবীর হেদায়াতের প্রতি বেপরোয়া হয়ে বলে যে, যেহেতু ইউরোপীয় বা আমেরিকান জাতির মধ্যে অমুক জিনিসের খুব প্রচলন আছে এবং তারা উন্নতি লাভ করেছে, অতএব তা আমাদেরও গ্রহণ করা উচিত ; কিংবা অমুক জাতি অমুক কাজ করছে, অমুক বড় লোক একথা বলেছেন, কাজেই তা আমাদেরও পালন করা কর্তব্য, তাহলে এমন ব্যক্তির ঈমান আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ঈমান থাকলে এসব কথা কেউ বলতে পারে না। বাস্তবিকই যদি মুসলমান হয়ে থাকেন এবং মুসলমানই থাকতে চান, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুমের বিপরীত যে কথাই হবে তাই দূরে নিক্ষেপ করতে হবে। এরূপ করতে না পারলে ইসলামের দাবী করা কারো পক্ষে শোভা পায় না। “আল্লাহ ও রাসূলকে স্বীকার করি” বলে মুখে দাবী করা আর জীবনের সমস্ত কাজ কারবারে সবসময়ই আল্লাহ ও রাসূলের কথাকে বাদ দিয়ে দুনিয়ার লোকদেরকে অনুসরণ করা -এটা না ঈমান না ইসলাম, এর নাম মুনাফিকী ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
পবিত্র কুরআনের ১৮শ পারায় আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ
﴿لَقَدْ أَنزَلْنَا آيَاتٍ مُّبَيِّنَاتٍ وَاللَّهُ يَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ- وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّى
فَرِيقٌ مِّنْهُم مِّن بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُوْلَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ- وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِّنْهُم
مُّعْرِضُونَ- وَإِن يَكُن لَّهُمُ الْحَقُّ يَأْتُوا إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ- أَفِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ أَمِ ارْتَابُوا أَمْ يَخَافُونَ أَن يَحِيفَ اللَّهُ
عَلَيْهِمْ وَرَسُولُهُ بَلْ أُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ- إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَن يَقُولُوا
سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَائِزُون ﴾ (الانور:
٤٦-٥٢)َ
“আমি হক ও বাতিলের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী আয়তসমূহ নাযিল করে দিয়েছি। আল্লাহ যাকে চান এ আয়াতের সাহায্যে তাকে সোজা পথ দেখিয়ে দেন। লোকেরা বলে আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমরা (তাঁদের) আনুগত্য স্বীকার করছি ; কিন্তু পরে তাদের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক লোক আনুগত্য করা ছেড়ে দেয়। এ শ্রেণীর লোকেরা ঈমানদার নয়। তাদের কাজ-কারবারের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার আইন অনুসারে ফায়সালা করার জন্য যখন তাদেরকে ডাকা হয় তখন কিছু লোক অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। কিন্তু আল্লাহর আইনের ফায়সালা যদি তাদের মনের মত হয় তবে অবশ্য তা স্বীকার করে নেয়। তাদের মনের মধ্যে কি রোগ আছে ? না তারা শুধু অকারণ সন্দেহের মধ্যে ডুবে রয়েছে ? অথবা তাদের এ ভয় আছে যে, আল্লাহ এবং তার রাসূল তাদেও ‘হক’ নষ্ট করবেন ? কারণ যাই হোক, তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর যুলুম করেছে। প্রত্যেক ঈমাদার লোকের নিয়ম এই যে, আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার করার জন্য যখন তাদেরকে ডাকা হয় তখন তারা ‘আমরা শুনেছি এবং তা অনুসরণ করি’ বলে মাথা নত করে দেয়। বাস্তবিক পক্ষে এ শ্রেণীর লোকেরাই মুক্তি ও উন্নতি লাভ করতে পারে। আর যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুম পালন করবে, আল্লাহকে ভয় করবে এবং তাঁর নাফরমানী হতে ফিরে থাকবে কেবল তারাই সফলকাম হবে এবং মুক্তি পাবে ।”- সুরা আন নূরঃ ৪৬-৫২
এ আয়াতসমূহে ঈমানের যে পরিচয় দেয়া হয়েছে আপনারা তা একটু বিশেষভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন। বস্তুত নিজেকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হেদায়াতের সামনে সোপর্দ করে দেয়ার নামই হচ্ছে ঈমান। সেখান হতে যে হুকুম আসে তার সামনে মাথা নত করে দাও। এর বিরোধী কোনো কথা শুনবে না-না নিজের মনের কথা, না বংশ ও পরিবারের কথা আর না দুনিয়ার লোকের কথা। যে ব্যক্তির মনের মধ্যে এ গুণ বর্তমান থাকবে প্রকৃতপক্ষে সেই হবে মু’মিন ও মুসলমান। আর যার মধ্যে এ গুণ থাকবে না তাকে মুনাফিক ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আপনারা হয়তো শুনেছেন যে, আরব দেশে মদ পান করার প্রথা খুব বেশী প্রচলিত ছিল। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই মদের জন্য একেবারে পাগল প্রায় ছিল। আসলে মদের প্রতি তাদের অন্তরে গভীর আকর্ষণ বিদ্যমান ছিল। এর প্রশংসা করে কত যে গযল-গীত তারা রচনা করেছিল, তার হিসেব নেই। মদের জন্য প্রাণ দিতেও তারা প্রস্তুত হতো। একথাও আপনারা জানেন যে, একবার মদের নেশা লাগলে তা দূর হওয়া বড়ই মুশকিল। মদখোর ব্যক্তি মদের জন্য প্রাণ দিতে পারে, কিন্তু মদ ত্যাগ করতে পারে না। কোনো মদখোর যদি মদ না পায় তবে তার অবস্থা কঠিন রোগীর অপেক্ষাও খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু যখন মদ নিষিদ্ধ হওয়ার আয়াত নাযিল হয়েছিল তখন কি অবস্থা হয়েছিল তা কি আপনারা কখনও শুনেছেন ? মদের জন্য পাগল জান দিতে প্রস্তুত সেই আরবরাই এ হুকুম পাওয়ার সাথে সাথে নিজেদের হাতেই মদের বড় বড় পাত্র ভেংগে ফেলেছিল। মদীনার অলিতে-গলিতে বৃষ্টির পানির মতো মদ বয়ে গিয়েছিল। একটি মজলিসে কয়েকজন লোক একত্রে বসে মদ পান করছিল। হযরতের ঘোষণাকারী যখন তাদের কাছাকাছি গিয়ে বললো যে, মদ নিষিদ্ধ হয়েছে, তখন যার হাত যেখানে ছিল তা সেখানেই থেমে গেল আর একটুও কেউ অগ্রসর হলো না। যার হাতের পেয়ালা মুখের সাথে লেগেছিল, সে তখনই তা সরিয়ে নিলো। তারপর আর এক বিন্দু মদ তার উদরে প্রবেশ করতে পারেনি। এটাই হচ্ছে সত্যিকার ঈমানের পরিচয়। আর এটাকেই বলা হয় আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য।
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি কত কঠিন তা তো আপনাদের অজানা নয়। তা হচ্ছে পিঠে একশত চাবুক। বস্তুত এর কল্পনা করলেও মানুষের শরীর শিউরে ওঠে। আর ব্যভিচারী বিবাহিত হলে তো তাকে একেবারে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। এ কঠিন শাস্তিও নাম শুণলেই মানুষ ভয়ে কেঁপে ওঠে। কিন্তু সেসব লোকের খাঁটি ঈমান ছিল, অথচ ভুলবশত তাদের দ্বারা কোনো ব্যভিচারের কাজ হয়ে গিয়েছিল, তাদের অবস্থা কিরূপ ছিল, তা কি আপনারা জানেন ? একজন লোক শয়তানের প্রতাণায় পড়ে ব্যভিচার করে বসলো। তার সাক্ষী কেউ ছিল না, আদালতে ধরে নিয়ে যাবারও কেউ ছিল না, পুলিশকে খবর দেয়ার মতো লোকও কেউ ছিল না। কিন্তু তার মনের মধ্যে ছিল খাঁটি ঈমান। আর সেই ঈমান তাকে বললো-আল্লাহর আইনকে ভয় না করে যখন তুমি নফসের খাহেশ পূর্ণ করেছ তখন তাঁর নির্দিষ্ট আইন মতে শাস্তি নিবার জন্য প্রস্তুত হও। কাজেই সে নিজেই হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে এসে হাযির হলো এবং নিবেদন করলোঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি ব্যভিচার করেছি, আমাকে শাস্তি দিন।’ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সেই ব্যক্তি আবার সেই দিকে গিয়ে শাস্তি দেয়ার জন্য অনুরোধ করলো এবং বললো, আমি যে পাপ করেছি আমাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দিন। এটাকেই বলে ঈমান। এ ঈমান যার মধ্যে বর্তমান থাকবে, খোলা পিঠে একশত চাকুকের ঘা নেয়া এমন কি পাথরের আঘাত খেয়ে মরে যাওয়াও তার পক্ষে সহজ ; কিন্তু আল্লাহর নাফরমানী করে আল্লাহর সামনে হাযির হওয়া তার পক্ষে বড়ই কঠিন ব্যাপার। আপনারা এটাও জানেন যে, দুনিয়ার মানুষের কাছে তার আত্মীয়-স্বজনই অতিশয় প্রিয়পাত্র হয়ে থাকে। বিশেষ করে পিতা-পুত্র-ভাই মানুষের এত প্রিয় যে, তাদের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতেও মানুষ প্রস্তুত হয়। কিন্তু আপনি একবার বদর ও ওহোদের যুদ্ধের কথা চিন্তা করে দেখুন যে, তাতে কে কার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। বাপ মুসলমানদের দলে, ছেলে কাফেরদের দলে, ছেলে একদিকে, পিতা অন্যদিকে, এক ভাই ইসলামের পক্ষে অন্য ভাই দুশমনের পক্ষে। একেবারে নিকটতম আত্বীয়গণ দু’ দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আর এমনভাবে যুদ্ধ করেছে, যেন তারা কেউ কাউকে চিনেই না। কোনো টাকা পয়সা কিংবা জায়গা জমি অথবা কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য তারা যুদ্ধ করেনি। তারা নিজেদের রক্ত দান করে আত্বীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে শুধু আল্লাহ ও রাসুলের খাতিরেই যুদ্ধ করেছে। আর আল্লাহ ও রাসূলের জন্য বাপ-ভাই-ছেলে এবং বংশের সকলকেই অকাতরে কুরবান করার মতো প্রচন্ড মনোবল তাদের মধ্যে বর্তমান ছিল। আপনাদের একথাও জানা আছে যে, ইসলাম আরব দেশের প্রায় প্রাচীন রসম-রেওয়াজকে একবারে বন্ধ করে দিয়েছিল। তখনকার যুগে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান ছিল মূর্তি পূজা। এ প্রথা শত শত বছর ধরে চলে আসছিল। কিন্তু ইসলাম সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করলো, এ মূর্তিগুলো পরিত্যাগ কর। মদ পান, ব্যভিচার, জুয়া, চুরি, ডাকাতি আরব দেশের নিত্যকার ঘটনা ছিল। ইসলাম বললো, এসব ছাড়তে হবে। আরব দেশের নারীরা একেবারে খোলাখুলিভাবে চলাফিরা করতো। ইসলাম আদেশ করলো, এরূপ চলতে পারবে না পর্দার ব্যবস্থা কর। মেয়েদেরকে সেখানে সম্পত্তির অংশ দেয়া হতো না। ইসলাম ঘোষণা করলো, পুরুষদের মতো মেয়েরাও সম্পত্তির অংশ পাবে। পালিত পুত্রকে সেখানে ঠিক আপন ঔরষজাত পুত্রের মতো মনে করা হতো। ইসলাম বললো, এটা হতে পারে না। পরের ছেলে পালন করলেই একবারে নিজের ঔরষজাত সন্তানের মতো হয়ে যায় না। এমনকি পালিত পুত্র তার স্ত্রীকে তালাক দিলে তাকে বিয়েও কারা যেতে পারে। মোটকথা, এ সমস্ত পুরাতন রসমকে সেখানে একটি একটি করে চুরমার করে দেয়া হয়েছিল। যারা আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছিল, তখন তারা কিভাবে কাজ করেছিল তা কি আপনার জানেন ? শত শত বছর ধরে যেসব মূর্তিকে তারা এবং তাদের বাপ-দাদারা পূজা করেছে, যেসবের সামনে নানা প্রকারের ভেট ও ভোগ হাযির করেছে এবং যেগুলোর সামনে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করেছে, ঈমানদার ব্যক্তিগত তা নিজেদেরই হাতে এক একটা করে চূর্ণ করে ফেলেছে। শত শত বছর ধরে যেসব বংশীয় রীতিনীতি ও রসম-রেওয়ায চলে আসছিল তা সবই তারা পরিত্যাগ করেছিল ; যেসব জিনিসকে তারা মহান ও পবিত্র বলে ধারণা করতো, আল্লাহর হুকুম পেয়েই তারা তাকে পায়ের তলে দলিত করলো। যেসব জিনিস তারা ঘৃণা করতো আল্লাহর হুকুম পাওয়া মাত্রই তাকে ভাল মনে করে গ্রহণ করতে লাগলো। চিরকাল যেসব জিনিসকে পাক ও পবিত্র মনে করা হতো, আল্লাহর বিধান মতো সেই সবকে অপবিত্র মনে করতে শুরু করলো। আর যেসব জিনিসকে অপবিত্র মনে করতো, সহসা তা পবিত্র হয়ে গেল। যেসব কাফেরী চালচলনে তারা আরাম ও সুখ মনে করতো, আল্লাহর হুকুম পাওয়া মাত্রই তা সবই ছেড়ে দিয়েছিল এবং ইসলামে যেসব হুকুম পালন করা মানুষের পক্ষে কষ্টকর বলে মনে হতো তারা সেই সবকে সানন্দে কবুল করে নিলো। এরই নাম ঈমান এবং একেই বলা হয় ইসলাম। কিন্তু ভেবে দেখুন, আরব দেশের লোকেরা যদি তখন তাদের বাপ-দাদাদের মতো বলতো, অমুক অমুক কাজ আমরা মানব না, কারণ এতে আমাদের ক্ষতি হবে-অমুক কাজ আমরা নিশ্চয় করবো কারণ বাপ-দাদার কাল হতেই এটা চলে এসেছে এবং রোম দেশের লোকদের কিংবা ইরান দেশের লোকদের অমুক কাজ আমাদের খুব ভালো লাগে বলে তা আমরা ছাড়তে পারবো না। এরূপে ইসলামের এক একটা হুকুম বাতিল করে দিতো তাহলে দুনিয়ায় এখন একজন মুসলমানও থাকতো কি ?
কুরআন শরীফে বলা হয়েছেঃ
﴿لَن تَنَالُواْ الْبِرَّ حَتَّى تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَ﴾ (ال عمران: ٩٢)
“তোমাদের প্রিয় জিনিসগুলোকে যদি তোমরা আল্লাহর জন্য কুরবানী না কর তাহলে তোমরা প্রকৃত কল্যাণ কিছুতেই লাভ করতে পারবে না।” -সূরা আলে ইমরানঃ ৯২
এ আয়াতটিই ইসলাম ও ঈমানের মূল কথা। ইসলামের আসল দাবী হচ্ছে, তোমাদেও সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দাও। জীবনের সব রকমের কাজ-কারবারেই আপনারা দেখতে পাবেন যে, আল্লাহর হুকুম একদিকে আপনাকে ডাকে, আর আপনাদের নফস ডাকে এর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। আল্লহ এক কাজের হুকুম করেন অথচ আপনাদের নফস ডাকে সে কাজে আপনার ভয়ানক কষ্ট কিংবা ক্ষতি হবে বলে প্ররোচিত করে। আল্লাহ এক কাজ করতে নিষেধ করেন, কিন্তু আপনার নফস তাকে অত্যন্ত মজাদার উপকারী জিনিস মনে করে তা ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয় না। প্রত্যেক কাজেই আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে একদিকে আর সারা দুনিয়ার সুখ-সুবিধার আকর্ষণ আপনাকে ডাকতে থাকে সম্পূর্ণ অন্যদিকে। মোটকথা জীবনের প্রত্যেক পদেই মানুষের সামনে দু’টি পথ এসে পড়ে ; একটি ইসলামের পথ, অপরটি কুফর ও মুনাফিকীর পথ। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রত্যেক জিনিসকে পদাঘাত করে একমাত্র আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা নত করে দেবে, মনে করতে হবে যে, কেবল সেই ব্যক্তিই ইসলামের পথ ধরেছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমের ওপর পদাঘাত করতে নিজের মনের বা দুনিয়ার খুশী চরিতার্থ করবে, বুঝতে হবে যে, সে কাফেরী এবং মুনাফিকীর পথ গ্রহণ করেছে।
বর্তমান কালে মানুষ সম্পূর্ণ সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করেছে। তারা ইসলামের সরল নিয়মগুলো তো অত্যন্ত আনন্দের সাথে স্বীকার করে, কিন্তু কুফর ও ইসলামের প্রকৃত মোকাবিলার সময় নিজেদের গতি পরিবর্তন করে ফেলে। ইসলামের বড় বড় দাবীদার লোকদের মধ্যেও এ রকম দুর্বলতা রয়েছে। ইসলাম ! ইসলাম ! করে তারা চীৎকার তো খুবই করে, ইসলামের তা’রীফ করতে গিয়েও তাদের মুখে খৈ ফোটে আর সে জন্য লোক দেখানো কাজও তারা যথেষ্ট করে, কিন্তু যে ইসলামের তারা এত তা’রীফ করে থাকে, সকলে মিলিত হয়ে সেই ইসলামের পরিপূর্ণ বিধানকে নিজেদের ওপর জারী করার জন্য তাদেরকে আহ্বান জানালে তারা অমনি বলে উঠেঃ ঐ কাজ সহজ নয়, এতে নানা প্রকারের কষ্ট আছে কিংবা এখন তা হতে পারে না। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ইসলাম একটা সুন্দর খেলনা মাত্র। তাকে তাকের ওপর উঠিয়ে রেখে দিলে এর সৌন্দর্য দেখা যায়। মুখে এর খুবই তা’রীফ করা যেতে পারে, কিন্তু নিজের ও পরিবারের লোকজনের ওপর, আত্বীয়-স্বজনের ওপর, নিজেদের কাজ-কারবারের ওপর তাকে একটা পরিপূর্ণ আইন হিসেবে জারী করার নাম নেয়া তাদের মতে একটা অপরাধ। আমাদের আজকালকার ধার্মিক বলে পরিচিত ব্যক্তিদের অবস্থা হয়েছে এই-তারপর দুনিয়ার অন্য লোকদের কথা আর কি বলা যায় ? মনে রাখবেন, ঠিক এ কারণেই আজ আমাদের নামায, রোযা, কুরআন তেলাওয়াত ও শরীয়াতের প্রকাশ্য অনুসরণের মধ্যে পূর্বের সেই প্রভাব আর বর্তমান নেই এবং সে জন্যই তাতে আমরা বাস্তব জীবনে কোনো ফলই লাভ করতে পারছি না। কারণ প্রাণটাই যখন না থাকে, তখন প্রাণহীন দেহটা আর কি সুফল দেখাতে পারে ?
আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কিতাবে বলেছেনঃ
﴿قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِين﴾ (
الانعام: ١٦٢- ١٦٣)
“(হে মুহাম্মাদ !) বল, আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদাত অনুষ্ঠান এবং আমার জীবন ও মৃত্যু--সবকিছুই আল্লাহর জন্য ; যিনি সারা-জাহানের মালিক ও প্রভূ। তাঁর কেউ শরীক নেই। এরূপ বলার জন্যই আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আর সর্বপ্রথম আমি তাঁরই সামনে আনুগত্যের মস্তক নত করে দিচ্ছি।”--সূরা আল আনআমঃ ১৬৩-১৬৪
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ
مَنْ اَحَبَّ ِللهِ وَ اَبْغَضَ ِللهِ وَ مَنَعَ ِللهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْاِيْماَنَ
“আল্লাহর জন্য যে ভালবাসলো, আল্লাহর জন্য যে দুশমনী করলো, আল্লাহরই জন্য যে দান করলো এবং আল্লাহরই জন্য দেয়া বন্ধ করলো, সে তার ঈমানকে পূর্ণ করলো। অর্থাৎ সে কামিল ঈমানদার হলো।”প্রথমে আমি যে আয়াতের উল্লেখ করেছি তা হতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম মানুষকে তার সমস্ত দাসত্ব-আনুগত্যের এবং নিজের জীবন ও মৃত্যুকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিষ্ঠা সহকারে উৎসর্গ করার এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার নির্দেশ দিচ্ছে। অন্য কথায় মানুষ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব ও আনুগত্য কারবে না। তার জীবন-মৃত্যুও আল্লাহ ছাড়া আর কারো উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত হবে না। ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষায় যা পেশ করা হয়েছে তাতে জানতে পারা যায় যে, মানুষের ভালবাসা, শুত্রুতা এবং নিজের বৈষয়িক জীবনের সমস্ত কাজ-কারবার ও লেন-দেন একান্ত ভাবে আল্লাহরই জন্য উৎসর্গকৃত হওয়া মূল ঈমানের ঐকান্তিক দাবী। তা না হলে উচ্চমর্যাদা লাভ তো দূরের কথা ঈমানই পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এ ব্যাপারে যতটুকু অপূর্ণতা থাকবে মানুষের ঈমানের ঠিক ততটুকুই অপূর্ণতা থেকে যাবে । পক্ষান্তরে এদিক দিয়ে মানুষ যত পূর্ণতা সহকারে আল্লাহর কাছে সমর্পিত চিত্ত হতে পারবে তার ঈমানও ততটুকুই পূর্ণ হবে। অধিকাংশ লোকের ধারণা এই যে, নিজেকে সর্বোতভবে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দেয়া শুধু উচ্চ মরতবা বা মর্যাদা লাভের জন্যই প্রয়োজন, শুধু ঈমান ও ইসলামের জন্য কারোও মধ্যে এতদূর উন্নতভাবের সৃষ্টি হওয়া কোনো জরুরী শর্ত নয়। অন্য কথায় তাদের ধারণা এই যে, উক্ত রূপ ভাবধারার মূলের দিক দিয়েই ভুল আর সাধারণ মানুষ আইনগত ইসলাম ও আল্লাহর কাছে গণ্য প্রকৃত ইসলামের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না বলেই এরূপ ভূল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ফিকাহ সম্মত ও আইনগত ইসলামে মানুষের মনের প্রকৃত অবস্থা দেখা হয় না-আর তা দেখা সম্ভবও নয়। বরং মানুষের মৌখিক স্বীকৃতির বাস্তব প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি জরুরী বাহ্যিক নিদর্শন বর্তমান থাকার ওপরই লক্ষ্য আরোপ করা হয়। কেউ যদি মুখে আল্লাহ, রাসূল, কুরআন, পরকাল ও অন্যান্য জরুরী বিষয়ে ঈমান রয়েছে বলে স্বীকার করে অতপর এ মৌখিক স্বীকারোক্তির বাস্তব প্রমাণের জরুরী শর্তগুলো পূরণ করে তবে তাকে ইসলামের সীমার মধ্যে গণ্য করা হবে। তাকে মুসলামন মনে করেই তার সাথে সকল কাজ-কর্ম করা হবে। কিন্তু মূলত এসব বিষয়ই শুধু এ দুনিয়ার জন্য সীমাবদ্ধ এবং এটাতে শুধু বৈষয়িক দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ও তমুদ্দুনিক ভিত্তিই লাভ হয়ে থাকে। এরূপ স্বীকারোক্তির সাহায্যে যারা মুসলিম সমাজে প্রবেশ করবে তারা সকলেই মুসলিম বলে গন্য হবে। তাদের মধ্যে কাউকে কাফের বলা যাবে না। তারা পরস্পরের কাছ হতে শরীয়াত সম্মত নৈতিক ও সামাজিক অধিকার লাভ করবে, তাদের পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারবে, মীরাস বন্টন হবে এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। কিন্তু পরকালে মানুষের মুক্তি লাভ, তার মুসলিম ও মু’মিন রূপে গণ্য হওয়া এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের মধ্যে শামিল হওয়া কেবলমাত্র উক্ত রূপ আইনগত ও মৌখিক স্বীকৃতি দ্বারা সম্ভব নয়, বরং মানুষের মনে স্বীকৃতি আল্লাহর দিকে অন্তরকে সমাহিত করা এবং ঐকান্তিক আগ্রহ ও উৎসাহ সহকারে নিজেকে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেয়াই এর জন্য অপরিহার্য শর্ত। পৃথিবীতে মৌখিক স্বীকৃতির মূল্য হয় শুধু কাযীর দরবারে ও সাধারণ মানুষ বা মুসলমানদের মধ্যে ; কেননা তারা কেবল বাহিরকেই দেখতে পারে। কিন্তু আল্লাহ দেখেন মানুষের মন বা অন্তরকে- তার ভিতরকার আসল অবস্থা ও ভাবধারাকে। আল্লাহ মানুষের ঈমানের পরিমাপ করেন। মানুষ তার জীবন ও মৃত্যুকে তার যাবতীয় কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব, আনুগত্য, দাসত্ব ও গোটা জীবনের কর্মধারাকে আল্লাহরই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করেছে, না অপর কারোও জন্য, আল্লাহর দরবারে ঠিক এ মাপকাঠিতেই মানুষকে যাচাই করা হবে। এ যাচাইয়ের ফলে যদি প্রমাণিত হয় যে, সে এসব কিছু একমাত্র আল্লাহরই জন্য উৎসর্গ করেছিল তবে সে মুসলিম এবং মু’মিন বলে গণ্য হবে, আর অন্য কারো জন্য উৎসর্গ করে থাকলে সে না মুসলিমরূপে গন্য হবে, না মু’মিরূপে । এ দৃষ্টিতে যে যতদূর কাঁচা ও অপরিপক্ক প্রমাণিত হবে তার ঈমান এবং ইসলামও ঠিক ততদূরই অপরিপক্ক হবে। ----- দুনিয়ায় যে অতিবড় মুসলিমরূপে গণ্য হলেও এবং সেখানে তাকে অতুল্য মর্যাদা দান করা হলেও আল্লাহর দরবারে তার কোনোই গুরুত্ব হবে না। আল্লাহ যা কিছু আপনাকে দিয়েছেন, আপনি তার সবকিছুই আল্লাহর জন্য --আল্লাহরই নির্দেশিত পথে প্রয়োগ করলেন কি না শুধু এ দিক দিয়েই আল্লাহর কাছে মানুষের মূল্য স্থির হবে। আপনি এরূপ করে থাকলে আপনাকে ঠিক অনুগত ও বন্ধুত্বের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া হবে। আর কোনো জিনিস যদি আপনি আল্লাহর বন্দেগী হতে দূরে রাখেন, আল্লাহর নির্দেশিত পথে প্রয়োগ না করেন তবে আপনার মুসলিম দাবী করার - অর্থাৎ নিজেকে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত করার মৌখিক উক্তি দ্বারা প্রতারিত হয়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে আপনাকে স্থান দিতে এবং মুসলিম হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধা দান করতেও পারে। কিন্তু আল্লাহ কখনও তাতে প্রতারিত হবেন না এবং আপনাকে তাঁর বিশ্বস্ত ও অনুগত বন্ধুদের মধ্যে গণ্য করবেন না। আইনগত ইসলাম ও প্রকৃত ইসলামের এ পার্থক্যের যে ব্যাখ্যা দান করা হলো, তা গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝতে পারা যায় যে, এর ফলাফল কেবল পরকালেই ভিন্ন ভিন্ন হবে না ; বরং দুনিয়ায়ও এ পার্থক্যের বাস্তব ফল ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। এজন্য দুনিয়ায় যত মুসলামন এসেছে এবং যত মুসলমান এখন দুনিয়ায় রয়েছে তাদের সকলকে উপরোক্ত দু’ভাবে ভাগ করা যেতে পারে।
এক ধরনের মুলমান দেখা যায় যারা আল্লাহ ও রাসূলকে স্বীকার করে ইসলামকে শুধু একটি ধর্ম হিসেবে মেনে নেয় ; কিন্তু এ ধর্ম নিজেদের সামগ্রিক জীবনের শুধু একটি অংশ বা একটি বিভাগের মর্যাদাই দেয়-তার অধিক নয়। ফলে এ বিশেষ অংশ বা একটি বিভাগের ইসলামের প্রতি বিশ্বাস পূর্ণ মাত্রায় স্থাপন করা হয়। ইবাদাত-বন্দেগীর অনুষ্ঠানসমূহ যথারীতি পালন করা হয়। তাসবীহ পাঠ ও যিকির-আযকার করা হয়। পানাহার ও কোনো কোনো সামাজিক ব্যাপারে পরহেযগারীও অবলম্বন করা হয় ; ধর্ম পালন বলতে যা করণীয় তা প্রায় সবই করা হয়। কিন্তু এ অংশ ও বিভাগ ছাড়া জীবনের অন্যান্য দিকে ও বিভাগে মুসলমানী কাজসমূহ করার কোনো সুযোগই দেয়া হয় না ; সেখানে ভালবাসা হলে তা হয় নিজের প্রতি, নিজ স্বার্থের প্রতি, দেশ ও জাতি কিংবা অন্য কোনো জিনিসের প্রতি আর দুশমনী বা যুদ্ধ করলেও তা করা হয় অনুরূপ কোনো বৈষয়িক স্বার্থের জন্য। তাদের লেন-দেন, তাদের কাজ-কারবার, সম্পর্ক-সম্বন্ধ, তাদের সন্তান-সন্ততি, বংশ-পরিবার, দেশ ও
সমাজ এবং অন্যান্য লোকের সাথে ব্যবহার ইত্যাদি সবই হয়ে থাকে দ্বীন ইসলামকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে নিছক বৈষয়িক দৃষ্টিতে। জমিদার, ব্যবসায়ী, শাসনকর্তা, সৈনিক যে যাই হোক না কেন, প্রত্যেকেই একজন স্বাধীন পেশাদার হিসেবে কাজ করে, মুসলামন হিসেবে নয়। এ দিক দিয়ে মুসলমানীকে বিন্দুমাত্র স্থান দেয় না। তারা মিলিত ও সমষ্টিগতভাবে যে তমুদ্দুনিক, শিক্ষামূলক ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় অংশ গ্রহণ করে তার ওপর তাদের মুসলমানীর আংশিক প্রভাব পড়লেও তার সাথে ইসলামের কোনোই সর্ম্পক স্থাপিত হয় না। দ্বিতীয় প্রকার মুসলমান দেখা যায়, যারা নিজেদের পূর্ণ ব্যক্তিত্বকে, নিজেদের সমগ্র সত্তাকে ইসলামের কাছে সোপর্দ করে দেয়। তাদের জীবনের সমগ্র দিকেই তারা মুসলিমরূপে কর্তব্য সম্পাদন করে। তারা হয় মুসলিম পিতা, মুসলিম সন্তান, মুসলিম স্ত্রী, ব্যবসায়ী, জমির মালিক, মজুর, চাকর-যাই হোক না কেন, সর্বত্র মুসলিম হিসেবেই তাদের জীবন চালিত হয়, তাদের মনের ভাবধারা, আশা-আকাংখা, চিন্তা ও মতবাদ, তাদের রায় ও সিদ্ধান্ত, তাদের ঘৃণা ও ভালবাসা তাদের পছন্দ অপছন্দ সবকিছুই ইসলামী আদর্শের অনুসারেই হবে। তাদের মন ও মগযের ওপর তাদের চোখ ও কানের ওপর, তাদের উদর ও লজ্জাস্থানের ওপর, তাদের হাত-পা ও দেহের যাবতীয় অংগ-প্রত্যংগের ওপর সর্ম্পূণ রূপে ইসলামের আধিপত্য বিরাজ করবে। তাদের স্নেহ ভালবাসা বা শত্রুতা ইসলামের সীমালংঘন করবে না। কারো সাথে সম্পর্ক স্থাপন করলে ইসলামের জন্যই করবে, কারো সাথে লড়াই করলে ইসলামেরই জন্য লড়াই করবে, কাউকে কিছু দান করলে শুধু এ জন্য দান করবে যে, এরূপ দান করা ইসলামের নির্দেশ। পক্ষান্তরে কাউকে কিছু দেয়া বন্ধ করলে তা ঠিক ইসলামের নির্দেশ অনুসররে বন্ধ করবে। তাদের এরূপ কর্মনীতি ব্যক্তিগত জীবনেই কার্যকর হবে না, তাদের সামগ্রিক জীবনেও সর্বতোভাবে ও সম্পূর্ণরূপে ইসলামেরই ভিত্তিতে স্থাপিত হবে। সমষ্টিগতভাবে তাদের সম্পূর্ণ সত্তাই হবে ইসলামের জন্য নিয়োজিত- ইসলামের জন্য উৎসর্গীকৃত। তাদের গোটা জাতীয় চরিত্র ও ভুমিকা ও তাদের কর্মতৎপরতা ইসলামের মূলনীতির বুনিয়াদে স্থাপিত ও পরিচালিত হবে। এ দু’প্রকারের মুসলমান মূলত সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। আইনের দৃষ্টিতে উভয় শ্রেণী একই উম্মাত তথা একই জাতির মধ্যে গণ্য হলেও এবং ‘মুসলিম’ শব্দটি উভয়ের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হলেও প্রকৃত ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রথম প্রকারের মুসলমানের কোনো কীর্তিই ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য বা গৌরবের বস্তুরূপে পরিগণিত হয়নি। তারা এমন কোনো কাজই করেনি, যা পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামের কোনো গুরূত্বই কোনো দিন অনুভব করেনি। বরং প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ইসলামের পশ্চাদমুখী গতি এ ধরনের মুসলমানের দ্বারা এবং এদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। মুসলিম সমাজে এ ধরনের মুলমানদের সংখ্যা অধিক হওয়ার কারণেই মানব জীবনের ওপর কুফরির কর্তৃত্ব স্থাপিত হওয়া এবং তার অধিক সীমাবদ্ধ ধর্মীয় জীবন যাপনের সুযোগ লাভ করেই মুলমানদের তুষ্ট হওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ কখনই এ ধরনের মুসলমান চাননি। এ ধরনের মুসলমান বানাবার জন্য তিনি কিতাব নাযিল করেননি। বস্তুত এ ধরনের মুসলমান দুনিয়ায় না থাকলেও বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভাব অনুভুত হতো না। আর তা পূরণের জন্য অহী নাযিল করার এ দীর্ঘস্থায়ী ধারা পরিচালনারও প্রয়োজন দেখা দিত না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ যে ধরনের মুসলমান তৈরি করার জন্য নবী পাঠিয়েছেন ও বিতাব নাযিল করেছেন, আর যারা ইসলামের
দৃষ্টিতে কোনো মূল্যবান ও উল্লেখযোগ্য কার্যসম্পাদন করেছে এবং এখনও করতে সমর্থ তারা হচ্ছে শুধু দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমান। কেবল ইসলামের ব্যাপারেই একথা সত্য নয়। যারা নিজেদের নীতি ও আদর্শকে শুধু মৌখিক স্বীকৃতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে ও তাকে জীবনের একটি পরিশিষ্টরূপে গণ্য করে এবং নিজেদের জীবন ও মৃত্যু অন্য কোনো জিনিসের জন্য উৎসর্গ করে তাদের দ্বারা দুনিয়ার কোনো আদর্শেরই পতাকা উন্নীত হতে পারে না। বর্তমান সময়ের একথার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। একটি আদর্শের প্রকৃত নিষ্ঠাবান অনুসারী কেবল তারাই হতে পারে যারা মন ও প্রাণ দিয়ে তার অনুসরণ ও তার খেদমতের কাজে আত্মসমর্পণ করে -যারা নিজেদের পূর্ণ ব্যক্তিসত্তাকে এরই জন্য উৎসর্গ করে এবং যারা নিজেদের অধিকারভূক্ত কোনো জিনিসকে-নিজের প্রাণ ও সন্তানকে পর্যন্ত তা অপেক্ষা বেশী ভালো না বাসে। বস্তুত দুনিয়ায় এ ধরনের লোকদের দ্বারাই কোনো বিশেষ আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করতে পারে। এজন্য প্রত্যেকটি আদর্শ এ ধরনের লোকের প্রতীক্ষা করে। অবশ্য একটি ব্যাপারে ইসলাম ও অন্যান্য আদর্শের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য আদর্শর মানুষের কাছে উল্লেখিত রূপ আতœসমর্পণ, ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আনুগত্যের দাবী করে বটে, কিন্তু মূলত দাবী করার তাদের কোনোই অধিকার নেই। এটা বরং মানুষের ওপর তাদের একটি অন্যায় আবদার মাত্র। পক্ষান্তরে মানুষের প্রতি ইসলামের দাবী অত্যন্ত শাশ্বত ও স্বাভাবিক। একটি আদর্শ যেসব কারণে অন্যান্য মানুষের কাছে তার নিজের সমগ্র জীবন র্পূণ ব্যক্তি সত্তাকে উৎসর্গ করার দাবী জানায়, মূলত সেসবের মধ্যে একটি জিনিসের জন্য মানুষ তার নিজের কোনো জিনিসকে কুরবান করতে পারে না। কিন্ত ইসলাম যে আল্লাহর জন্য মানুষের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ঐকান্তিক নিষ্ঠার দাবী করে প্রকৃতপক্ষে যে জন্যই মানুষের উৎসর্গিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা সবই আল্লাহর। মানুষ নিজেই আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষের কাছে এবং মানুষের মধ্যে যা আছে, সবকিছুই আল্লাহর মালিকানা। মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব জিনিস দ্বারা কাজ করে তাও আল্লাহর। কাজেই জ্ঞান-বুদ্ধি ও সুবিচারের দৃষ্টিতে এটাই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে যে, যা আল্লাহর তা আল্লাহরই পথে উৎসর্গ করতে হবে। অপরের জন্য কিংবা নিজ স্বার্থ ও ইপ্সিত বস্তুর জন্য মানুষ যে কুরবানী করে তা মূলত খিয়ানত-অন্যায় ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা আল্লাহর জন্য যা কিছুই উৎসর্গ করা হয়, তা দ্বারা মূলত আল্লাহরই হক আদায় করা হয়। কিন্তু যারা বাতিল মতবাদ ও আদর্শ এবং নিজেদের মনগড়া ইলাহ ও প্রভুদের জন্য নিজেদের সবকিছু কুরবান করে এবং সে জন্য অবিচল ও দৃঢ়তা সহকারে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাদের কর্মতৎপরতা হতে মুসলমানদের শিক্ষাগ্রহণ করা আবশ্যক। বাতিলের জন্য যখন মানুষ এত নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা প্রদর্শন করতে পারে তখন সত্যের জন্য যদি তার এক সহস্রাংশ ত্যাগ স্বীকার করা না হয় তবে তা কত পরিতাপের বিষয়।
উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস হতে ঈমান ও ইসলামের যে সঠিক মাপকাঠির সন্ধান পাওয়া যায়, তদনুযায়ী আমাদের প্রত্যেককেই আত্মপরীক্ষা করা কর্তব্য। আপনি যদি ইসলাম কবুল করার ও ঈমান আনার দাবী করেন তবে আপনার জীবন ও মৃত্যু একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গীকৃত কিনা, তা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে যাচাই করে দেখা বাঞ্ছনীয়। আপনি একমাত্র আল্লাহরই জন্য জীবিত কিনা, আপনার মন ও মস্তিষ্কের সমগ্র যোগ্যতা-ক্ষমতা, আপনার দেহ ও প্রাণের শক্তি, আপনার সময় ও শ্রম একমাত্র আল্লাহর মর্জী পূরণের জন্য এবং মুসলিম উম্মাতের দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত কিনা তা বিশেষভাবে যাচাই করে দেখা কর্তব্য। আপনার বন্দেগী ও আনুগত্য আল্লাহরই জন্য কিনা, অন্যদিকে নফসের দাসত্ব এবং পরিবার, গোত্র, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজ তথা সরকারের বন্দেগী হতে আপনার জীবন সম্পূর্ণরূপে মুক্ত কিনা, তাও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। আপনার পছন্দ-অপছন্দ আল্লাহর মর্জী অনুযায়ী নির্ধারিত কিনা তাও বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়। আরও বিচার করে দেখুন, আপনি যাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন, তা কি আল্লাহর জন্য করেন? যার প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন, তাও কি আল্লাহর জন্য করেন ? এ ঘৃণা ও ভালোবাসায় আপনার নিজের কোনো স্বার্থ কাজ করে না তো ? দেয়া না দেয়াও কি আল্লাহরই জন্য হচ্ছে ? নিজের উদর ও মনসহ দুনিয়ায় যাকে যা কিছু আপনি দেন, তা দিয়ে কি আপনি একমাত্র আল্লাহরই সন্তোষ পেতে চান ? পক্ষান্তরে আপনার না দেয়াও কি ঠিক আল্লাহরই জন্য হচ্ছে ? আপনি কি এজন্য দিচ্ছেন না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করছেন ? --------- এরূপে সবকিছুই আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার ভাবধারা যদি আপনি আপনার নিজের মধ্যে বর্তমান দেখতে পান তবে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করুন। কেননা আল্লাহ সত্যই আপনার ঈমানকে র্পূণতা দান করেছেন। কিন্তু এদিক দিয়ে যদি আপনি আপনার মধ্যে কোনো প্রকার অভাব অনুভব করেন, তবে তা দূর করার জন্য এখনই যত্মবান হোন, সকল চেষ্টা ও তৎপরতা এদিকে নিবদ্ধ করুন। কেননা এ অভাব পূরণের ওপরই আপনার ইহকালীন সাফল্য ও পরকালীন মুক্তি নির্ভর করে। দুনিয়ায় আপনি কোনো মহাসম্পদ লাভ করলেও তা দ্বারা এ অভাব পূরণ হতে পারে না। কিন্তু এ অভাব যদি আপনি পূরণ করে নিতে পারেন, তবে দুনিয়ায় আপনি কিছু না পেলেও প্রকৃত পক্ষে আপনি কোনোরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।স্বরণ রাখতে হবে যে, কুরআন হাদীসের এ মাপকাঠিতে অপরকে যাচাই করার জন্য এবং তাকে মু’মিন কিংবা মুনাফিক অথবা মুসলিম কিংবা কাফের বলে ঘোষণা করার জন্য নয়। প্রকৃতপক্ষে নিজেকে বাঁচাবার জন্য এবং পরকালের বিচারালয়ের কাঠগড়ায় দাড়াবার পূর্বে এ দুনিয়ায় নিজের ত্রুটি জেনে তা সংশোধন করার জন্যই এ মাপকাঠি নির্ধারিত হয়েছে। দুনিয়ার মুফতি ও কাজী আপনাকে কি মনে করছেন সেই চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই, মহাবিচারক-গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুর একমাত্র জ্ঞাতা-আল্লাহ আপনাকে কি স্থান দেন তাই আপনাকে চিন্তা করতে হবে। দুনিয়ার আদমশুমারীর খাতায় আপনি মুসলিম রূপে গণ্য হয়েছেন দেখেই আপনার নিশ্চিত হয়ে বসে থাকা উচিত নয়। আল্লাহর দফতরে আপনার কি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেই সম্পর্কে সতর্ক হওয়া আপনার কর্তব্য। সমগ্র পৃথিবী আপনাকে ঈমান ও ইসলামের সার্টিফিকেট দিলেও প্রকৃতপক্ষে আপনার কোনো লাভ নেই। মূল বিচার যে আল্লাহর হাতে তাঁরই কাছে মুনাফিকের পরিবর্তে মু’মিন-অবাধ্যের পরিবর্তে অনুগত বান্দাহ রূপে গণ্য হওয়াই আপনার জীবনের প্রকৃত সাফল্য।পূর্বেই কয়েকটি প্রবন্ধে আপনাদেরকে আমি বার বার একথাই বলেছি যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মেনে চলার নামই ইসলাম এবং মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের খাহেশ, বাপ-দাদার কুসংস্কার, দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ ও লোকেদের আদেশ অনুযায়ী চলা ছেড়ে দিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই মুসলমান হতে পারবে না।কিন্তু আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম পালন করার ওপর এত জোর কেন দেয়া হয়, এখানে আমি সেই কথারই বিস্তারিত আলোচনা করবো। একজন মানুষ জিজ্ঞেস করতে পারে যে, আল্লাহর আনুগত্য করার দরকারটা কি, তিনি কি আমাদের আনুগত্য পাবার মুখাপেক্ষী ? আর সে জন্যই কি আল্লাহ আমাদের কাছে তাঁর নিজের এবং তাঁর রাসূলের হুকুম পালন করে চলার দাবী করছেন? দুনিয়ার রাজা-বাদশাহরা যে রকম নিজেদের হুকুমাত চালারবার জন্য লালায়িত, আল্লাহ কি তেমন লালায়িত? দুনিয়ার জনগণ যেমন বলে যে, আমার প্রভুত্ব স্বীকার করো আল্লাহও কি তেমনি বলেন ? এখন একথারই আমি জবাব দিতে চাই। আসল কথা এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের কাছে তার আনুগত্য দাবী করেন তাঁর নিজের স্বার্থের জন্য নয়। বরং এ
মানুষেরই কল্যাণের জন্য তিনি তা চাচ্ছেন। আল্লাহ দুনিয়ার রাজা-বাদশাহর মত নন, দুনিয়ার রাজার ও রাজকর্মচারীগণ তো শুধু নিজেদেরই স্বার্থের জন্য লোকেদের ওপর তাদের হুকুমাত চালায়-লোকদেরকে নিজেদের মর্জীর গোলাম বানাতে চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কোনো স্বার্থ নেই, তিনি সকল রকম স্বার্থের নীচতা হতে পবিত্র। আপনার কাছ থেকে টাকা আদায় করার কোনো দরকার আল্লাহর নেই । প্রাসাদ তৈরি করা, মোটর গাড়ী ক্রয় করা কিংবা আপনাদের টাকা-পয়সা, বিলাস-ব্যসন বা আরাম-আয়েশের সামগ্রী সংগ্রহ করার কোনো প্রয়োজনই তাঁর নেই। তিনি পাক, তিনি কারো মোহতাজ বা মুখাপেক্ষী নন। দুনিয়ার সবকিছুই তাঁর, সমস্ত ধন-সম্পদের তিনিই একমাত্র মালিক। তিনি আপনাদেরই মঙ্গলের জন্য-আপনাদেরই কল্যাণ করতে চান। তিনি মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ করে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর এ শ্রেষ্ঠ মাখুলুক বা বিরাট সৃষ্টি মানুষেরা শয়তানের গোলামী করুক, কিংবা অন্য মানুষের দাস হোক অথবা দুনিয়ার সামান্য ও হীন জিনিসের সামনে মাথা নত করুক এটা তিনি মাত্রই পছন্দ করেন না। তিনি যে মানুষকে দুনিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি বানিয়েছেন, তারা মূর্খতার অন্ধকারে ঘুরে মরুক এবং পশুর মতো নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী চলে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হোক-এটাও তাঁর মনপুত নয়। এজন্যই তিনি মানুষকে বলেছেনঃ “হে মানুষ ! তোমরা আমারাই হুকুম মেনে চল-কেবল আমারই নির্দেশ মত চল-কেবল আমারই আনুগত্য কর। আমি আমার নবীর মারফতে তোমাদের কাছে যে জ্ঞানের আলো পাঠিয়েছি, তা গ্রহণ কর ; তবে তোমরা সরল ও সোজা পথের সন্ধান পেতে পারবে। আর এ সোজা পথে চলে তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বত্রই সম্মান লাভ করতে পারবে ।”
﴿لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدمِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىَ لاَ انفِصَامَ
لَهَا وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ- اللّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُواْ يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوُرِ وَالَّذِينَ كَفَرُواْ أَوْلِيَآؤُهُمُ الطَّاغُوتُ
يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾ (البقره: ٢٥٦- ٢٥٧)
“দীন ইসলামের ব্যাপারে কোনো জোর-যবরদস্তি নেই। হেদায়াতের সোজা পথ গোমরাহীর বাঁকা পথ হতে ভিন্ন করে একেবারে পরিষ্কার করে দেখানো হয়েছে। এখন তোমাদের মধ্যে যারাই মিথ্যা খোদা এবং ভ্রান্ত পথে চালনাকারীদেরকে ত্যাগ করে কেবল এক আল্লাহর প্রতিই ঈমান আনবে, তারা এত মযবুত রজ্জু ধারণ করতে পারবে, যা কখনই ছিঁড়ে যাবার নয়। আল্লাহ সবকিছুই শুনতে পান এবং সবকিছুই তিনি অবগত আছেন। যারা ঈমান আনলে তাদের রক্ষাকারী হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা, তিনি তাদেরকে অন্ধকার হতে মুক্তি দান করে আলোকের উজ্জলতম পথে নিয়ে যান। আর যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদেরকে রক্ষা করার ভার তাদের মিথ্যা খোদা ও গোমরাহকারী নেতাদের ওপর অর্পিত হয়। তারা আদেরকে আলো হতে পথভ্রষ্ট অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। তারা দোযখে যাবে ও সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।” -সূরা বাকারাঃ ২৫৬-২৫৭
আল্লাহকে ছেড়ে অন্যান্য মিথ্যা খোদার হুকুম মানলে ও তাদের আনুগত্য করলে মানুষ কেন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, আর কেবল আল্লাহর আনুগত্য করলেই কেন আলোকোজ্জল পথ লাভ করা যাবে তা আপনাদের বিচার করে দেখা আবশ্যক।আপনারা দেখছেন, দুনিয়ায় আপনাদের জীবন অসংখ্য রকম সম্পর্কের সাথে জড়িত। আপনাদের প্রথম সম্পর্ক আপনাদের দেহের সাথে। হাত, পা , কান, চোখ, জিহ্বা, মন, মগয এবং পেট সমস্তই আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে দান করেছেন আপনাদের খেদমত করার জন্য। কিন্তু এগুলো দ্বারা আপনারা কিভাবে খেদমত নিবেন, তা আপনাদেরই বিচার করতে হবে। পেটকে কি খেতে দেবেন এবং কি খেতে দিবেন না ; হাত দ্বারা কি করবেন, কি করবেন না ; পা দু’খানিকে কোন্ পথে চালাবেন কোন্ পথে চালাবেন না ; মনে কোন্ কথার খেয়াল রাখবেন আর কোন্ কথার রাখবেন না ; মন-মগয দিয়ে কোন্ কথার চিন্তা করবেন আর কোন্ কথার করবেন না-এসবই আপনাকে সবদিক চিন্তা করে ঠিক করতে হবে। এরা সবাই আপনার চাকর এদের দ্বারা আপনি ভালো কাজও করাতে পারেন, আর পাপের কাজও করাতে পারেন। এরা আপনার কাজ করে আপনাকে উচ্চতম মর্যাদার মানুষেও পরিণত করতে পারে আবার এরা আপনাকে জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট ও নীচ জীবও বানিয়ে দিতে পারে। অতপর আপনার নিকটতম সম্বন্ধ আপনার ঘরের লোকেদের সাথে-বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্য আত্বীয়-স্বজন সকলের সাথে-আপনাকে রাত-দিন সকল সময়ের জন্য সম্বন্ধ রেখে চলতে হয়। কিন্তু এদের সাথে আপনি কিরূপ ব্যবহার করবেন, তা আপনাকে বিশেষভাবে চিন্তা করেই ঠিক করতে হবে। এদের ওপর আপনার কি ‘হক’ (অধিকার) আছে এবং আপনার ওপরই বা এদের কি অধিকার আছে, তা আপনার ভালো করে জেনে নেয়া দরকার। মনে রাখবেন, এদের সাথে আপানার ব্যবহার সুষ্ঠু হওয়ার ওপরই আপনার দুনিয়ার ও আখেরাতের সুখ-শান্তি ও সফলতা নির্ভর করে। যদি এদের সাথে আপনি ভুল ব্যবহার করেন তবে দুনিয়াকেই আপনি নিজের জন্য জাহান্নামে পরিণত করবেন। আর শুধু দুনিয়াই নয়, পরকালেও আপনাকে আল্লাহর কাছে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। এরপর আসে দুনিয়ার অন্যান্য অগণিত লোকের সাথে আপনার সম্পর্কের কথা। অনেক লোক আপনার পাড়া-পড়শী, বহুলোক আপনার বন্ধু, কতগুলো লোক আপনার দুশমন। বহুলোক আপনার খেদমত করে এবং আপনি বহুলোকের খেদমত করেন। আপনি কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করেন এবং কাউকে আপনি কিছু দেন। কেউ আপনার ওপর ভরসা করে তার কাজের ভার আপনাকে দেয়, আবার আপনি কারো ওপর ভরাসা করে আপনার কাজের ভার তার ওপর অর্পণ করেন। কেউ আপনার বিচারক আর আপনি অন্য কারো বিচারক। আপনি কাউকে হুকুম দেন আবার আপনাকে কেউ হুকুম দেয়। ফলকথা, কত সংখ্যক লোকের সাথে আপনার রাত-দিন কোনো না কোনো সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়, যার হিসেব করে আপনি শেষ করতে পারেন না। এ সম্পর্কগুলো আপনাকে খুব ভালোভাবেই রক্ষা করতে হয়। দুনিয়ায় আপনার সুখ-শান্তি, পছন্দ-অপছন্দ, স্ফুর্তি, সফলতা, মান-সম্মান ও সুনাম অর্জন একান্তভাবে এরই ওপর নির্ভর করে। সেগুলোকে খুব ভালোভাবে রক্ষা করতে পারলে আপনি দুনিয়ায় সুখ-শান্তি এবং আনন্দ ও গৌরব লাভ করতে পারেন, নতুবা পারেন না। অনুরূপভাবে যদি পরকালে আপনি আল্লাহর কাছে কারোও অধিকার হরণকারী সাব্যস্ত না হয়ে হাজির হতে পারেন, তাহলে আপনি তার কাছে উপস্থিত হতে হবে যেন আপনি কারো হক নষ্ট করেননি, কারো উপর যুলম করেননি, কেউ আপনার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করে না, কারো জীবন নষ্ট করার দায়িত্ব আপনার ওপর নেই এবং কারো জান-মাল ও সম্মান আপনি অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেননি। কাজেই এখন আপনাকে এই ফায়সালা করতে হবে যে, এই অগণিত লোকের সাথে সঠিকভাবে সম্পর্ক কিভাবে রাখা যাবে এবং যেসব কারণে এসব সম্পর্ক ছিন্ন, নষ্ট বা তিক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তা জেনে নিয়ে তা থেকে আপনাকে ফিরে থাকতে হবে। এখন আপনারা চিন্তা করুন যে, আপনাদের দেহের সাথে, আপনাদের পরিবারের লোকদের সাথে এবং দুনিয়ার অন্যান্য সমস্ত লোকের সাথে সঠিক সম্পর্ক রাখার জন্য জীবনের প্রতি ধাপে জ্ঞানের উজ্জল আলো লাভ করা আপনাদের কতখানি আবশ্যক। প্রতি ধাপে আপনার জানা চাই যে, কোনটা মিথ্যা ? সুবিচার কি এবং যুলুম কি ? আপনার ওপর কার কি পরিমাণ অধিকার আছে এবং আপনারই বা তার ওপর কি পরিমাণ অধিকার আছে ? জীবনের কোন কাজে প্রকৃত উপকার পাওয়া যাবে আর কিসে আসলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে ? ------কিন্তু এসব কিছুর জ্ঞান আপনি কোথায় পেতে পারেন ? এটা যদি আপনি আপনার মনের কাছে জানতে চান, তবে সেখানে তা পাবেন না। কারণ আপনার মন নিজেই অজ্ঞ ও মূর্খ, নিজের স্বার্থ ও অসৎ কামনা ছাড়া আর কিছুই জানা নেই। সে তো বলবেঃ মদ খাও, যেনা কর, হারাম উপায়ে টাকা রোজগার কর। কারণ এসব কাজে খুবই আনন্দ আছে। সে বলবে, সকলেরই হক মেরে খাও, কাউকে হক দিও না। কারণ তাতে লাভও আছে, আরামও আছে। এমন একটা অজ্ঞ-মূর্খের হাতে যদি আপনি আপনার জীবনের রজ্জু ছেড়ে দেন-মন যা চায়, যদি কেবল তাই করেন, তবে এটা আপনাকে একেবারে অধপতনের চরম সীমায় নিয়ে যাবে। এমনকি, পরিণামে আপনি একজন নিকৃষ্ট স্বার্থপর, হীনচেতা ও পাপিষ্ঠে পরিণত হবেন। এতে আপনার দ্বীন-দুনিয়া সবকিছুই নষ্ট হবে। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে এই যে, আপনি আপনার মনের খাহেশের কথা না শুনে আপনারই মতো অন্য মানুষের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করবেন এবং প্রত্যেক কাজেই আপনি সেই লোকদের কথামত কাজ করবেন। তারা যেদিকে চালায়, আপনি অন্ধভাবে সেদিকেই চলবেন। এ পথ যদি অবলম্বন করেন, তবে কোনো স্বার্থপর লোক এসে আপনাকে তার নিজের ইচ্ছামত পরিচালিত এবং নিজের স্বার্থোদ্ধারের জন্য ব্যবহার করতে পারে, এর খুবই আশংকা আছে। কিংবা কোনো মূর্খ ও পথভ্রষ্ট লোক এসে আপনাকেও বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যেতে পারে। অথবা কোনো যালেম ব্যক্তি আপনাকেও বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যেথে পারে। অথবা কোনো যালেম ব্যক্তি আপনাকে হাতিয়ার স্বরূপ গ্রহণ করে আপনার দ্বারা অন্যের ওপর যুলুম করাতে পারে। মোটকথা, অন্য লোকের অনুসরণ করলেও আপনি জ্ঞানের সেই জরুরী আলো লাভ করতে পারেন না, যা আপনাকে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝাতে, ন্যায় ও অন্যায় বলে দিতে পারে এবং আপনার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। এরপর একটি মাত্র উৎসই থেকে যায় যেখান থেকে আপনি আপনার এ অত্যাবশ্যক জ্ঞানের আলো লাভ করতে পারেন। সেই উপায়টি হচ্ছে আপনার ও নিখিল জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা। আল্লাহ তাআলা সবকিছুই অবগত আছেন, সবকিছুই দেখতে পান, প্রত্যেকটি জিনিসের প্রকৃতি তিনি ভাল করেই জানেন ও বুঝেন। একমাত্র তিনিই বলে দিতে পারেন যে, কোন্ জিনিসে আপনার প্রকৃত উপকার, আর কোন জিনিসে আপনার আসল ক্ষতি হতে পারে, কোন্ কাজ আপনার করা উচিত, কোন্ কাজ করা উচিত নয়-- তা একমাত্র তিনিই বলে দিতে পারেন। আল্লাহ তাআলার কোনো কিছুর অভাব নেই, তাঁর নিজের কোনো স্বার্থ আদায় করবেন না। কারণ তিনি পাক-পবিত্র, তিনি সবকিছুরই মালিক, তিনি যা কিছু পরামর্শ দিবেন তার মধ্যে তাঁর নিজের স্বার্থের কোনো গন্ধ নেই এবং তা কেবল আপনারই উপকারের জন্য। এছাড়া আল্লাহ তাআলা ন্যায় বিচারক, তিনি কখনই কারো ওপর অবিচার করেন না। কাজেই তাঁর সকল পরামর্শ নিশ্চয়ই নিরপেক্ষ, ন্যায় ও ফলপ্রসূ হবে। তাঁর আদেশ অনুযায়ী চললে আপনার নিজের ওপর বা অন্য কারো ওপর কোনো যুলুম হবার আশংকা নেই।
আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে যে আলো পাওয়া যায়, তা থেকে কল্যাণ লাভ করা দু’টি জিনিসের ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে। প্রথম জিনিস এই যে, আল্লাহ তাআলা এবং তিনি যে নবীর সাহায্যে এ আলো পাঠিয়েছেন সেই নবীর প্রতি আপনাকে প্রকৃত ঈমান আনতে হবে, আপনাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কাছ থেকে তাঁর রাসূল যে বিধান ও উপদেশ নিয়ে এসেছেন, তা সম্পূর্ণ সত্য ; তার সত্যিকার উপকারিতা যদি আপনি অনুভব করতে না-ও পারেন তবুও আপনাকে একথা বিশ্বাস করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ঈমান আনার পর আপনি আপনার জীবনের প্রত্যেকটি কাজেই আল্লাহর সেই বিধান অনুসরণ করে চলবেন। কারণ তার প্রতি ঈমান আনার পর কার্যত তাঁর অনুসরণ না করলে সেই আলো হতে কিছুমাত্র ফল পাওয়া যেতে পারে না। মনে করুন, কোনো ব্যক্তি আপনাকে বললো, অমুক জিনিসটি বিষ, তা প্রাণীর প্রাণ নাশ করে ; কাজেই তা খেও না। আপনি বললেন, হাঁ ভাই, তুমি যা বলেছ তা খুবই সত্য, তা যে বিষ এবং তা প্রাণ ধ্বংস করে, তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সত্য জেনে-শুনে বিশ্বাস করে এবং মুখে স্বীকার করেও আপনি তা খেলেন। এখন বিষের যা আসল ক্রিয়া তা তো হবেই। জেনে খেলেও হবে, না জেনে খেলেও হবে। আপনি তা না জেনে খেলেও জেনে খাওয়ার মত একই ফল হতো। এরূপ জানা ও না জানার মধ্যে কার্যত কোনো পার্থক্য নেই। আর এরূপ জানা এবং স্বীকার করার প্রকৃত ফল ও উপকারিতা আপনি ঠিক তখনই পেতে পারেন যখন আপনি কোনো সত্য জানার ও স্বীকার করার সাথে সাথে সেই অনুসারে কাজ করবেন। আপনাকে যে কাজের হুকুম দেয়া হয়েছে, কেবল মুখে মুখে তাকে সত্য বলে স্বীকার করেই বসে থাকবেন না বরং তাকে কাজে পরিণত করবেন। আর যে কাজ করতে আপনাকে নিষেধ করা হয়েছে, শুধু মুখ মুখে তা থেকে ফিরে থাকার কথা মেনে নিলে চলবে না, বরং আপনার জীবনের সমস্ত কাজ-কারবারেই সেই নিষিদ্ধ কাজ হতে ফিরে থাকতে হবে। এজন্য আল্লাহ তাআলা বার বার বলেছেন
﴿أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ﴾ (النساء: ٥٩)
“আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মেনে চল।”-সূরা আন নিসাঃ ৫৯
﴿وَإِن تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا﴾ (النور: ٥٤)
“যদি তোমরা রাসূলের অনুসরণ কর, তবেই তোমরা সৎপথের সন্ধান পাবে।” -সূরা আন নূরঃ ৫৪
﴿فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَة﴾ (النور: ٦٣)
“যারা আমার রাসূলের হুকুমের বিরোধিতা করছে, তাদের ভয় করা উচিত যে, তাদের ওপর বিপদ আসতে পারে। ” -সূরা আন নূরঃ ৬৩
আমি আপনাদেরকে বারবার বলছি যে, কেবল আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলেরই আনুগত্য করা উচিত ; এর অর্থ এই নয় যে, কোনো মানুষের হুকুম আদৌ মানতে হবেনা। আসলে এর অর্থ এই যে, আপনারা অন্ধ হয়ে কারো পিছনে চলবেন না। সবসময়ই আপনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কেবল এটাই দেখবেন যে, যে ব্যক্তি আপনাকে কোনো কাজ করতে বলে, তা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের অনুরূপ, না তার বিপরীত। যদি তার অনুরূপ হয়, তবে তা মেনে নেয়া অবশ্যই কর্তব্য। কারণ, সেই হুকুম মতো কাজ করলে তাতে আসলে সেই ব্যক্তির নিজের হুকুম পালন করা হয় না, তা করলে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলেরই আনুগত্য করা হবে। আর সে যদি আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের বিপরীত হুকুম দেয়, তবে তা তার মুখের ওপর নিক্ষেপ করুন, সে যে ব্যক্তি হোক না কেন। কারণ, আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম ছাড়া অন্য কারো হুকুম পালন করা একেবারেই জায়েয নয়।
আপনারা একথা সহজেই বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলা নিজে মানুষের সামনে এসে হুকুম দেন না, তাঁর যা কিছু হুকুম-আহকাম দেয়ার ছিল, তা সবই তাঁর রাসূলের মারফতে পাঠিয়েছেন। আমাদের সেই প্রিয় নবীও প্রায় চৌদ্দ শত বছর পূর্বে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। তাঁর কাছে আল্লাহ তাআলা যা কিছু হুকুম-আহকাম দিয়েছিলেন, তা সবই এখন পবিত্র কুরআন ও হাদীসের মধ্যে নিহিত আছে। কিন্তু এ কুরআন শরীফ এমন কোনো জিনিস নয়, যা নিজেই আপনাদের সামনে এসে আপনাদেরকে আল্লাহর কথা বলতে ও হুকুম দান করতে পারে এবং আপনাদেরকে আল্লাহর নিষিদ্ধ পথ হতে বিরত রাখতে পারে। মানুষই আপনাদেরকে কুরআন ও হাদীস অনুসারে পরিচালিত করবে। কাজেই মানুষের অনুসরণ না করে তো কোনো উপায় নেই। অবশ্য অপরিহার্য কর্তব্য এই যে, আপনারা কোনো মানুষের পিছনে অন্ধভাবে চলবেন না। আপনারা সতর্কভাবে শুধু এতটুকুই দেখবেন যে, সেই লোকেরা আপনাদেরকে পবিত্র কুরআন ও হাদীস অনুসারে পরিচালিত করে কিনা। যদি কুরআন ও হাদীস অনুসারে চালায় তবে তাদের অনুসরণ করা আপনাদের কর্তব্য এবং তার বিপরীত পথে চালালে তাদের অনুসরণ করা পরিষ্কার হারাম। ধর্ম সম্বন্ধে কথাবার্তা বলার সময় আপনারা দু’টি শব্দ প্রায়ই শুনে থাকবেন এবং আপনারা নিজেরাও প্রায়ই বলে থাকেন। সেই দু’টি শব্দের একটি হচ্ছে দ্বীন; দ্বিতীয়টি হচ্ছে শরীয়াত। কিন্তু অনেক কম লোকই এ শব্দ দু’টির অর্থ ও তাৎপর্য ভালো করে জানে। যারা লেখা-পড়া জানে না, তারা এর অর্থ না জানলে তা কোনো অপরাধের কথা নয় ; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ভালো ভালো শিক্ষিত লোকেরা-এমন কি বহু মৌলভী সাহেব পর্যন্ত শব্দ দু’টির সঠিক অর্থ এবং এ দুটির পারস্পরিক পার্থক্য সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল নন। এ দু’টির অর্থ ভালো করে না জানায় অনেক সময় ‘দীন' কে শরীয়াতের সাথে এবং শরীয়াতকে দীনের সাথে একেবারে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়া হয়। এতে অনেক প্রকার ভুল বুঝাবুঝি হয়ে থাকে। এ প্রবন্ধে আমি খুব সহজ কথায় এ শব্দ দু’টির অর্থ আপনাদের কাছে প্রকাশ করবো। দীন (دين) শব্দের কয়েকটি অর্থ হতে পারে। প্রথমঃ শক্তি, কর্তৃত্ব, হুকুমাত, রাজত্ব-আধিপত্য এবং শাসন ক্ষমতা।
দ্বিতীয় ঃ এর সম্পূর্ণ বিপরীত যথা-নীচতা, আনুগত্য, গোলামি, অধীনতা এবং দাসত্ব। তৃতীয়, হিসেব করা ফায়সালা করা ও যাবতীয় কাজের প্রতিফল দেয়া। কুরআন শরীফে ‘দ্বীন’ (دين) শব্দটি এ তিন প্রকারের অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছেঃ
﴿إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللّهِ الإِسْلاَمُ﴾ (ال عمران: ١٩)
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে তাই হচ্ছে একমাত্র ‘দীন’ যাতে মানুষ শুধু আল্লাহ তাআলাকেই শক্তিমান মনে করে এবং তাকে ছাড়া আর কারো সামনে নিজেকে নত মনে করে না। কেবল আল্লাহকেই মনিব, মালিক, বাদশাহ ও রাজাধিরাজ বলে মানবে এবং তিনি ছাড়া আর কারো কাছে হিসেব দেয়ার পরোয়া করবে না ; অন্য কারো কাছে প্রতিফল পাবার আশা করবে না এবং কারো শাস্তির ভয় করবে না। এ ‘দীনের’ই নাম হচ্ছে ‘ইসলাম’। কোনো মানুষ যদি এ আকীদা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আসল শক্তিমান, আইন রচয়িতা, আসল বাদশাহ ও মালিক, প্রকৃত প্রতিফলদাতা মনে করে এবং তার সামনে বিনয়ের সাথে মাথা নত করে, যদি তাঁর বন্দেগী ও গোলামী করে, তাঁর আদেশ মতো কাজ করে এবং তার প্রতিফলের আশা ও তার শাস্তির ভয় করে, তাহলে তাকে মিথ্যা ‘দীন’ মনে করতে হবে। আল্লাহ এমন ‘দীন’ কখনও কবুল করবেন না। কারণ এটা প্রকৃত সত্যের সম্পূর্ণ খেলাপ। এ নিখিল পৃথিবীতে আসল শক্তিমান ও সম্মানিত সত্তা আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়। এখানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন আধিপত্য নেই, বাদশাহী নেই। আর মানুষকে আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী ও গোলামী করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। সেই আসল মালিক ছাড়া কাজের প্রতিফল দেয়ায় ক্ষমতা কারো নেই। একথাই অন্য এক আয়াতে এভাবে বলা হয়েছেঃ
﴿وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِيناً فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾ (ال عمران: ٨٥)
অর্থাৎ আল্লাহর আধিপত্য ও প্রভূত্ব ছেড়ে যে ব্যক্তি অন্য কাউকে নিজের মালিক এবং আইন রচয়িতা বলে স্বীকার করে, তার বন্দেগী ও গোলামী কবুল করে এবং তাকে কাজের প্রতিফলদাতা মনে করে, তার এ ‘দ্বীন’ কে আল্লাহ তাআলা কখনই কবুল করবেন না। কারণঃ
﴿وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاء﴾ (البينه: ٥)
“মানুষকে আল্লাহ তাঁর নিজের বান্দাহ করে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কারো বন্দেগী করার আদেশ মানুষকে দেয়া হয়নি। তাদের একমাত্র অবশ্য কর্তব্য ফরয এই যে, সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধু আল্লাহর জান্যই নিজেই দ্বীন-অথাৎ আনুগত্য ও গোলামীকে নিযুক্ত করবে, একমুখী হয়ে তাঁরই বন্দেগী করবে এবং শুধু তাঁরই হিসেব করার ক্ষমতাকে ভয় করবে।” - সূরা আল বাইয়্যেনাঃ ৫
﴿أَفَغَيْرَ دِينِ اللّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ طَوْعاً وَكَرْهاً وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ﴾ (ال عمران: ٨٣)
“মানুষ কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো গোলামী ও হুকুম পালন করতে চায়? অথচ প্রকৃতপক্ষে আকাশ ও প্রথিবীর সমস্ত জিনিসই কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলারই একান্ত গোলাম ও হুকুম পালনকারী এবং এসব জিনিসকে তাদের নিজেদের হিসাব-কিতাবের জন্য আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে যেতে হবে না। তবুও মানুষ কি আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত জিনিসের বিরুদ্ধে আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া আর অন্য কোনো পথ অবলম্বন করতে চায় ?” -সূরা আলে ইমরানঃ ৮৩
﴿هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ﴾ (الصف: ٩)
“আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে ইসলামী জীবনব্যবস্থা ও সত্যের আনুগত্যের ব্যবস্থা সহকারে এ জন্য পাঠিয়েছেন যে, তিনি সকল ‘মিথ্যা খোদার’ খোদায়ী ও প্রভুত্ব ধ্বংস করে দিবেন এবং মানুষকে এমন ভাবে আযাদ করবেন যে, তারা আল্লাহ ছাড়া
আর কারো বান্দাহ হবে না, কাফের আর মুশরিকগণ নিজেদের মূর্খতার দরুন যতই চীৎকার করুক না কেন এবং একে ঘৃণা করুন না কেন।” - সূরা আস সফঃ ৯
﴿وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلّه﴾ (الأنفال : 3٩)
“তোমরা যুদ্ধ কর যেন দুনিয়া হতে গায়রুল্লাহর প্রভুত্ব চিরতরে দুর হয় এবং দুনিয়ায় যেন শুধু আল্লাহরই আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর বাদশাহী যেন সকলেই স্বীকার করে এবং মানুষ যেন শুধু আল্লারই বন্দেগী করে।”-সূরা আল আনফালঃ ৩৯
ওপরের এ ব্যাখ্যা দ্বারা ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থ পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে আশা করি। সংক্ষেপে বলতে গেলে তা এই -আল্লাহকে মালিক, মনিব এবং আইন রচনাকারী স্বীকার করা-আল্লাহরই গোলামী, বন্দেগী ও তাবেদারী করা, আল্লাহর হিসাব গ্রহণের ও তাঁর শাস্তি বিধানের ভয় করা এবং একমাত্র তাঁরই কাছে প্রতিফল লাভের আশা করা। তারপরও যেহেতু আল্লাহর হুকুম তাঁর কিতাব ও রাসূলের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌছিয়ে থাকে, এজন্য রাসূলকে আল্লাহর রাসূল এবং কিতাবকে আল্লাহর কিতাব বলে মান্য করা আর কার্যক্ষেত্রে তার অনুসরণ করাও “দ্বীন” এর মধ্যে গণ্য। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿يَا بَنِي آدَمَ إِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي فَمَنِ اتَّقَى وَأَصْلَحَ فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ﴾ (
الاعراف: ٣٥)
“হে আদম সন্তান ! আমার নবী যখন তোমাদের কাছে বিধান নিয়ে আসবে তখন যারা সেই বিধানকে মেনে আদর্শবাদী জীবনযাপন করবে এবং সেই অনুসারে নিজেদের কাজ-কারবার সমাপন করবে, তাদের কোনো ভয়ের কারণ নেই।” - সূরা আল আরাফঃ ৩৫
এর দ্বারা জানা গেল যে, আল্লাহ সোজাসুজি প্রত্যেক মানুষের কাছে তাঁর বিধান পাঠান না, বরং তার নবীদের মাধ্যমেই পাঠিয়ে থাকেন। কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহকে আইন রাচনাকারী বলে স্বীকার করবে সেই ব্যক্তি কেবল নবীদের হুকুম পালন করে এবং তাঁদের প্রচারিত বিধানের আনুগত্য করেই আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারে একে বলা হয় ‘দ্বীন’।
অতপর শরীয়াতের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করবো। শরীয়াত শব্দের অর্থ ঃ পথ ও নিয়ম। একজন মানুষ যখন আল্লাহকে আইন রচনাকরী বলে তার বন্দেগী স্বীকার করে এবং একথাও স্বীকার করে নেয় যে, রাসূল আল্লাহর তরফ হতেই অনুমতি প্রাপ্ত আইনদাতা হিসেবে এসেছেন এবং কিতাব তাঁরই তরফ হতেই নাযিল হয়েছে, ঠিক তখনই সে দ্বীন-এর মধ্যে দাখিল হয়। এরপরে যে নিয়ম অনুযায়ী তাকে আল্লাহর বন্দেগী করতে হয় এবং তার আনুগত্য করার জন্য যে পথে চলতে হয় তারই নাম হচ্ছে শরীয়াত। এ পথ ও কর্মপদ্ধতি আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের মারফতে পাঠিয়েছেন। মালিকের ইবাদাত কোন নিয়মে করতে হবে, পাক-পবিত্র হওয়ার নিয়ম কি, নেকী ও তাকওয়ার পথ কোনটি, অন্য মানুষের হক কিভাবে আদায় করতে হবে, কাজ-কারবার কিভাবে করতে হবে, জীবন কিভাবে যাপন করতে হবে, এসব কথা নবীই বলেছেন। দ্বীন ও শরীয়াতের মধ্যে পার্থক্য এই যে, দ্বীন চিরকালই এক-ছিল এক আছে এবং চিরকাল একই থাকে ; কিন্তু শরীয়াত দুনিয়ায় বহু এসেছে, বহু বদলিয়ে গেছে। অবশ্য শরীয়াতের এ পরিবর্তনের কারণে দ্বীনের কোনো দিনই পরিবর্তন হয়নি। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দ্বীন যা ছিল হযরত নূহ আলাইহিস সালামের দ্বীনও তাই ছিল, হযরত মূসা আলাইহিস সালামের দ্বীনও তাই ছিল। হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম, হযরত সালেহ আলাইহিস সালাম এবং হযরত হুদ আলাইহিস সালামের দ্বীনও তাই ছিল এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীনও ঠিক তাই। কিন্তু এ নবীগণের প্রত্যেকেরই শরীয়াতে কিছু না কিছু পার্থক্য বর্তমান ছিল। নামাজ এবং রোজার নিয়ম এক এক শরীয়াতে এক এক রকমের ছিল। হারাম ও হালালের হুকুম, পাক-পবিত্রতার নিয়ম, বিয়ে ও তালাক এবং সম্পত্তি বন্টনের আইন এক এক শরীয়াতের এক এক রকম ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা সকলেই মুসলমান ছিলেন। হযরত নূহ আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত মুছা আলাইহিস সালামের উম্মতগণও মুসলমান ছিলেন, আর আমরাও মুসলমান কেননা সকলের দ্বীন এক। এর দ্বারা জানা গেল যে, শরীয়াতের হুকুম বিভিন্ন হলেও দ্বীন এক থাকে, তাতে কোনো পার্থক্য হয় না-দ্বীন অনুসারে কাজ করার নিয়ম-পন্থা যতই বিভিন্ন হোক না কেন। এ পার্থক্য বুঝার জন্য একটা উদাহরণ দেয়া যাচ্ছে। মনে করুন, একজন মনিবের বহু সংখ্যক চাকর আছে। যে ব্যক্তি সেই মনিবকে মনিব বলে স্বীকার করে না এবং তার হুকুম মান্য করা দরকার বলে মনেই করে না, সে তো পরিষ্কার নাফরমান এবং সে চাকরের মধ্যে গণ্যই নয়। আর যারা তাকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার হুকুম পালন করা কর্তব্য বলে বিশ্বাস করে এবং তার হুকুমের অবাধ্য হতে ভয় করে, তারা সকলেই চাকরের মধ্যে গণ্য। চাকুরী করা এবং খেদমত করার নিয়ম বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মূলত তারা সকলেই সমানভাবে সেই একই মনিবের চাকর, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। মালিক বা মনিব যদি একজন চাকরকে চাকুরীর এক নিয়ম বলে দেয় আর অন্যজনকে বলে আর এক নিয়ম তবে এদের কেউই একথা বলতে পারে না যে, আমি মনিবের চাকর কিন্তু ঐ ব্যক্তি চাকর নয়। এভাবে মনিবের হুকুমের অর্থ ও উদ্দেশ্য যদি এক একজন চাকর এক এক রকম বুঝে থাকে অর্থ উভয়েই নিজের নিজের বুদ্ধিমত সেই হুকুম পালন করে, তবে চাকুরীর বেলায় উভয়ই সমান। অবশ্য হতে পারে যে, একজন চাকর মনিবের হুকুমের অর্থ ভুল বুঝেছে, আর অন্যজন এর অর্থ ঠিকমত বুঝেছে। কিন্তু হুকুম মত কাজ উভয়েই যখন করেছে, তখন একজন অন্যজনকে নাফরমান অথবা মনিবের চাকুরী হতে বিচ্যূত বলে অভিযুক্ত করতে পারে না। এ উদাহরণ হতে আপনারা দ্বীন ও শরীয়াতের পারস্পরিক পার্থক্য খুব ভাল করে বুঝতে পারেন। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন নবীর মারফতে বিভিন্ন শরীয়াত পাঠিয়েছিলেন। এদের একজনকে চাকুরীর এক রকমের নিয়ম বলেছেন, আর অন্যজনকে বলেছেন অন্যবিধ নিয়ম। এ সমস্ত নিয়ম অনুসরণ করে আল্লাহর হুকুম মতো যারা কাজ করেছেন, তাঁরা সকলেই মুসলমান ছিলেন-যদিও তাদের চাকুরির নিয়ম ছিল বিভিন্ন রকমের। তারপর যখন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায় তাশরীফ আনলেন, তখন সকলের মনিব আল্লাহ তাআলা হুকুম করলেন যে, এখন পূর্বের সমস্ত নিয়মকে আমি বাতিল করে দিলাম। ভবিষ্যতে যে আমার চাকুরি করতে চায় তাকে ঠিক সেই নিয়ম অনুসারেই কাজ করতে হবে, যে নিয়ম আমার শেষ নবীর মাধ্যমে আমি প্রচার করবো। এরপর পূর্বের কোনো নিয়মকে স্বীকার না করে এবং এখনও সেই পুরাতন নিয়ম মতো চলতে থাকে, তবে বলতে হবে যে, সে আসলে মনিবের হুকুম মানছে না, সে তার নিজের মনের কথাই মানছে। কাজেই এখন সে চাকুরি হতে বরখাস্ত হয়েছে। -অর্থাৎ ধর্মের পরিভাষায় সে কাফের হয়ে গেছে। প্রাচীন নবীগণকে যারা এখনও মেনে চলতে চায় তাদের সম্বন্ধে একথাই প্রযোজ্য। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগামী যারা তাদের সম্পর্কে উল্লেখিত উদাহরণের দ্বিতীয় অংশ বেশ খেটে যায়। আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদের কাছে যে শরীয়াত পাঠিয়েছেন, তাকে যারা আল্লাহর শরীয়াত বলে স্বীকার করে এবং তা পালন করা কর্তব্য বলে মনে করে, তারা সকলেই মুসলমান। এখন এই শরীয়াতকে একজন যদি একভাবে বুঝে থাকে আর এজন অন্যভাবে এবং উভয়ই নিজ নিজ বুদ্ধিমত সেই অনুসারে কাজ করে তবে তাদের কেউই চাকুরী হতে বিচ্যুত হবে না। কারণ এই যে, তাদের প্রত্যেকেই যে নিয়মে কাজ করছে সে একান্তভাবে মনে করে যে, তা আল্লাহর দেয়া নিয়ম এবং এটা বুঝেই সে সেই নিয়ম অনুসরণ করছে। কাজেই একজন চাকর কেমন করে বলতে পারে যে, আমিই খাঁটি চাকর আর অমুক খাঁটি চাকর নয়। সে বেশী কিছু বললেও শুধু এতটুকু বলতে পারে যে, আমি মনিবের হুকুমের ঠিক অর্থ বুঝেছি, আর অমুক লোক ঠিক অর্থ বুঝতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে অন্য জনকে চাকরি হতে খারিজ করে দেয়ার বা খারিজ মনে করার তার কোনো অধিকার নেই ; তবুও যদি কেউ এতখানি দুঃসাহস করে তবে আসল মনিবের পদকে সে নিজের বিনা অধিকারে দখল করছে। তার কথার অর্থ এই হয় যে, তুমি তোমার মনিবের হুকুম মানতে যেরূপ বাধ্য, আমার হুকুম মানতেও তুমি অনুরূপভাবে বাধ্য।
আমার হুকুম যদি তুমি না মন তাহলে আমি আমার ক্ষমতা দ্বারা মনিবের চাকুরি হতে তোমাকে খারিজ করে দিব। একটু ভেবে দেখুন, এটা কত বড় স্পর্ধার কথা। এ কারণেই নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন
মুসলমানকে অকারণে কাফের বলবে, তাঁর কথা স্বয়ং তার নিজের ওপরই বর্তিবে। কারণ মুসলমানকে আল্লাহ তাআলা নিজের হুকুমের গোলাম বানিয়েছেন। কিন্তু ঐ ব্যক্তি বলে-না, তুমি আমার বুদ্ধি ও আমার মতের গোলামী কর। অর্থাৎ শুধু আল্লাহই তোমার ইলাহ নন, আমিও তোমার একজন ছোট ইলাহ এবং আমার হুকুম না মানলে আমার নিজের ক্ষমতার দ্বারা তোমাকে আল্লাহর বন্দেগী হতে খারিজ করে দেব-আল্লাহ তাআলা তাকে খারিজ করুন আর না-ই করুন। আর এ ধরনের কথা যারা বলে তাদের কথায় অন্য মুসলমান কাফের হোক বা না হোক কিন্তু সে নিজেকে কাফেরীর বিপদে জড়িয়ে ফেলে।
দ্বীন ও শরীয়াতের পার্থক্য আপনারা ভাল করে বুঝতে পেরেছেন আশা করি। সেই সাথে একথাও আপনারা জানতে পেরেছেন যে, বন্দেগীর বাহ্যিক নিয়মের পার্থক্য হলেও আসল দ্বীনে কোনো পার্থক্য হয় না। অবশ্য তার জন্য শর্ত এই যে, মানুষ যে পন্থায়ই কাজ করুক না কেন, নেক নিয়তের সাথে করা কর্তব্য এবং একথা মনে রেখে করতে হবে যে, যে নিয়মে সে কাজ করছে, তা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলেরই নিয়ম।
এখন আমি বলবো যে, দ্বীন ও শরীয়াতের এ পার্থক্য না বুঝতে পেরে আমাদের মুসলমান জামায়াতের কতই না অনিষ্ট হচ্ছে। মুসলমানদের মধ্যে নামাজ পড়ার নানা রকম নিয়ম আছে। একদল বুকের ওপর হাত বেঁধে থাকে, অন্যদল নাভির ওপর হাত বাঁধে। একদল ইমামের পিছনে মোকতাদী হয়ে আলহামদু সূরা পড়ে, আর একদল তা পড়ে না; একদল শব্দ করে ‘আমীন’ বলে, আর একদল বলে মনে মনে। এদের প্রত্যেকেই যে নিয়মে চলছে একথা মনে করেই চলছে যে, এটা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই নিয়ম। কাজেই নামাজের বাহ্যিক নিয়ম বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও এরা সকলেই সমভাবে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগামী। কিন্তু যেসব যালেম লোক শরীয়াতের এসব খুটিনাটি মাসয়ালার বিভিন্নতাকে আসল দ্বীনের বিভিন্নতা বলে মনে করে নিয়েছে এজনই তারা নিজেদের আলাদা দল গঠন করে নিয়েছে, মসজিদ ভিন্ন করে তৈরি করেছে । একদল অন্যদলকে গালাগালি করে, মসজিদ হতে মেরে বের করে দেয়, মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করে এবং এভাবে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতকে টুকরো টুকরো করে দেয়।
এতেও এ শয়তানদের দিল ঠান্ডা হয় না বলে ছোট ছোট ও সামান্য ব্যাপারে একজন অপরজনকে কাফের, ফাসেক ও গোমরাহ বলে আখ্যা দিতে থাকে। এক ব্যক্তি কুরআন ও হাদীস হতে নিজ নিজ বুদ্ধি মতো আল্লাহর হুকুম বের করে। এখন সে যা বুঝেছে সেই অনুসারে নিজের কাজ করাকেই সে যথেষ্ট বলে মনে করে না ; বরং সে নিজের এ মতকে অন্যের ওপরও যবরদস্তি করে চাপিয়ে দিতে চায়। আর অন্য লোক যদি তা মানতে রাজী না হয় তাহলে তাকে কাফের ও আল্লাহর দ্বীন হতে খারিজ মনে করতে শুরু করে। মুসলমানদের মধ্যে আপনারা এই যে হানাফী, শাফেয়ী, আহলে হাদীস ইত্যাদি নানা দলের নাম শুনতে পান এরা সকলে পবিত্র কুরআন ও হাদীসকে সর্বশেষ কিতাব বলে বিশ্বাস করে এবং নিজের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী তা থেকে আইন ও বিধান জেনে নেয়। হতে পারে একজনের সিদ্ধান্ত ঠিক ও বিশুদ্ধ, আর অন্যজনের সিদ্ধান্ত ভুল। আমিও একটা নিয়ম অনুসরণ করে চলি এবং তাকে শুদ্ধ বলে মনে করি-আমি যাকে শুদ্ধ বলে বুঝেছি, তা তাদেরকে বুঝাতে চাই। কিন্তু কারো সিদ্ধান্ত ভুল মনে করি, তার দোষ-ত্রুটি তাদের বুঝাতে চাই। কিন্তু কারো সিদ্ধান্ত ভুল হওয়া এক কথা আর দ্বীন হতে খারিজ হয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। নিজ নিজ বিবেক অনুসারে শরীয়াতের কাজ করার অধিকার প্রত্যেক মুসলমানেরই আছে। দশজন মুসলমান যদি দশটি বিভিন্ন নিয়মে কাজ করে, তবু যতক্ষণ তাঁরা শরীয়াত মানবে ততক্ষণ তাঁরা সকলেই মুসলমান, একই উম্মাতের মধ্যে গণ্য ; তাদের ভিন্ন ভিন্ন দল-গোষ্ঠী গঠন করার কোনোই কারণ নেই। কিন্তু এ নিগূঢ় কথা যারা বুঝতে পারে না, তারা অতি ছোট ও সামান্য সামান্য কারণে দলাদলি করে। একদল অন্যদলের সাথে ঝগড়া বাঁধায়, নামাজ ও মসজিদ আলাদা করে, একদল অন্যদলের সাথে বিয়ে-শাদী, মিলা-মিশা এবং সম্পর্ক স্থাপন চিরতরে বন্ধ করে দেয় আর নিজ মতের লোকদেরকে নিয়ে একটা আলাদা দল গঠন করে। মনে হয় তারা আলাদা নবীর উম্মাত।
আপনারা ধারণা করতে পারেন যে, এরূপ দলাদলির ফলে মুসলমানের কি বিরাট ক্ষতি হয়েছে। কথায় বলা হয় যে, মুসলমান একদল-এক উম্মাত। এ উপমহাদেশে মুসলমানের সংখ্যা ৮ কোটি । এতবড় একটা দল যদি বাস্তবিকই সংঘবদ্ধ হতো এবং পরিপূর্ণ একতার সাথে আল্লাহর কালামকে বুলন্দ করার জন্য কাজ করতো, তাহলে দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাদেরকে দুর্বল
মনে করতে পারতো না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ দলাদলির কারণেই এ উম্মাতটি বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের
একজনের মন অন্যজনের প্রতি বিষাক্ত ও শ্রদ্ধাহীন। বড় বড় বিপদের সময়ও তারা একত্রিত হয়ে বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না। একদলের মুসলমান অন্যদলের মুসলমানকে ঠিক ততখানিই শত্রু বলে মনে করে, বরং তা থেকেও অধিক। এমনও দেখা গেছে যে, একদল মুসলমানকে পরাজিত করার জন্য আর একদল মুসলমান কাফেরদের সাথে যোগ দিয়ে ষড়যন্ত্র করে। এমতাবস্থায় দুনিয়ার মুসলমান যদি দুর্বল হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এটা তাদের নিজেদেরই কর্মফল। তাদের ওপর সেই আযাবই নাযিল হয়েছে যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআন মজিদে বলেছেনঃ
﴿أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعاً وَيُذِيقَ بَعْضَكُم بَأْسَ بَعْضٍ﴾ (الانعام: ٦٥)
“মানুষের প্রতি আল্লাহর এমন আযাবও আসতে পারে, যার ফলে তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়া হবে, তোমরা পরস্পর কাটাকাটি করে মরবে।” - সূরা আল আনআমঃ ৬৫
ওপরে যে আযাবের কথা বলা হলো, এতদাঞ্চলে তা খুব বেশী পরিমাণেই দেখা যায়। এখানে মুসলমানের নানা দল ; এমনকি আলেমদের দলেরও কোনো হিসেব নেই। এজন্যই এখানকার মুসলমান এবং আলেমদের কোনো শক্তি নেই। আপনারা যদি বাস্তবিকই মঙ্গল চান, তবে আপনাদের ও আলেমদের এ বিভিন্ন দল ভেংগে দিন। আপনারা পরস্পর পরস্পরের ভাই হিসেবে এক উম্মাতরূপে গঠিত হোন। ইসলামী শরীয়াতে এরূপ হানাফী, শাফেয়ী, আহলে হাদীস প্রভৃতি আলাদা আলাদা দল গঠন করার কোনো অবকাশ নেই। এরূপ দলাদলি মূর্খতার কারণেই হয়ে থাকে। নতুবা আল্লাহ তাআলা তো একটি মাত্র দল তৈরি করেছেন এবং সেই একটি মাত্র দলই হচ্ছে মুসলমান।
March 19, 2025
সহকর্মী বন্ধুগণ!
চারদিন ব্যাপী সম্মেলনের পর এখন সকলেই এখান থেকে বিদায় নিচ্ছে। এ সম্মেলন উপলক্ষে নির্ধারিত কার্যসূচী আল্লাহর ফযলে সম্পন্ন হয়েছে এবং সেই সম্পর্কে আমরা বিশেষ অধিবেশনে মোটামুটি ভাবে পর্যলোচনাও করেছি। এখান থেকে বিদায় গ্রহণের পূর্বে আমি আমার সহকর্মী রুকন এবং মুত্তাকীগণকে (বর্তমানে সহযোগী সদস্য) আমাদের কর্মপন্থা সম্পর্কে কয়েকটি জরুরী কথা বলতে চাই; যেন তারা ভবিষ্যতে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন।
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক :
আম্বিয়ামে কিরাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং জাতির আদর্শ ও সৎ ব্যক্তিগণ প্রত্যেকটি কাজ উপলক্ষে তাদের সহকর্মীগণকে যে বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন, সর্বপ্রথম আমি তার উল্লেখ করতে চাই । তাঁরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করতে,, মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি ভক্তিভাব পোষণ করতে এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক ঘন্ঠিষ্ঠতর করতে তাকীদ করেছেন। তাঁদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে আমিও আপনাদের কে আজ এ উপদেশই দিচ্ছি। আর ভবিষ্যতেও আমি যখন সুযোগ পাবো, ইনশাআল্লাহ একথাই আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবো। কারণ এ বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্যান্য সকল বিষয়ের তুলনায় এটাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি ঈমান, ইবাদতের বেলায় আল্লাহর সাথে নিবিড়তর সম্পর্ক স্থাপন, নৈতিক চরিত্রে আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ এবং আচার-ব্যবহার ও লেন-দেনের বেলায় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ করাকেই প্রাধান্য লাভ করা বাঞ্চনীয়। বিশেষত আমরা যে কাজের জন্য সংঘবদ্ধ হয়েছি, এটা শুধু আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে সম্পন্ন হতে পারে। আমরা আল্লাহ্ তাআলার সাথে যতখানি গভীর ও দৃঢ় সম্পর্ক করবো আমাদের আন্দোলন তাতোই মযবুত হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক দুর্বল হলে এ আন্দোলও দুর্বল হয়ে পড়বে। আল্লাহ যেন এটা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন।
বলা বাহুল্য মানুষ যে কাজেই অংশগ্রহণ করুক না কেন-সেই কাজ দুনিয়ার হোক কি আখেরাতের তার প্রেরণা সেই কাজের মূল উদ্দেশ্য হতেই লাভ করে। যে কাজের জন্য সে উদ্যোগ-আয়োজন করেছে, সে কাজে তার চেষ্টা-তৎপরতা তখনই পরিলক্ষিত হবে যখন মূল উদ্দেশ্যে সাথে তার মনে প্রবল আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা যাবে। আত্মকেন্দ্রিক স্বর্থপর ব্যক্তি ছাড়া কেউ প্রবৃত্তির পূজা করতে পারে না। সুতরাং যে ব্যক্তি যতবেশী স্বার্থপর হবে, ততোই সে আপন প্রবত্তির জন্য কাজ করতে থাকবে। সন্তান-সন্তির মঙ্গলের জন্য নিজের পার্থিব জীবনেই নয় নিজের আখেরাতকেও বরবাদ করতে ইতস্তত করে না। কারণ তার সন্তান-সন্ততি অধিকতর সুখ-শান্তি লাভ করুক এটাই হচ্ছে তার একমাত্র কামনা।
অনুরূপভাবে দেশ ও জাতির খেদমতে আত্মনিয়োগকারী ব্যক্তি মূলত দেশ ও জাতির প্রেমে আবদ্ধ হয়। এর ফলেই সেই ব্যক্তি দেশ ও জাতির আযাদী, নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে, কয়েদখানার দুর্বিসহ যাতনা অনায়াসে বরণ করে এবং এজন্য দিন-রাত পরিশ্রম করে। এমনকি একাজে সে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও আদৌ কুন্ঠিত হয় না। সুতরাং আমরা যদি এ কাজ আপন প্রবৃত্তির জন্য, আত্নীয়-স্বজনের জন্য, দেশ ও জাতির বিশেষ কোনো স্বার্থের জন্য না-ই করি বরং একমাত্র আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক গভীল এবং মজবুত না হলে যে আমদের এ কাজ কখনো অগ্রসর হতে পারে না, একথা আপনারা সহজেই উপলবদ্ধি করতে পারেন। আর এ কাজের জন্য আমাদের চেষ্টা-তাৎপরতা শুধু তখনই শুরু হতে পারে যখন ও প্রতিষ্ঠার জন্যই কেন্দ্রীভূত হবে। এ কাজে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার সাথে শুধু সম্পর্ক স্থাপন করাই যথেষ্ট নয় বরং তাদের যাবতীয় আশা-ভরসা একমাত্র আল্লাহ তাআলার সাথেই সম্পর্কিত হওয়া আব্শ্যক। এটা একাধিক সম্পর্কের এতটি অন্যতম সম্পর্ক হলে চলবে না, বরং এটাকেই একমাত্র মৌলিক ও বাস্তব যোগসূত্রে পরিণত হতে হবে। পরন্তু আল্লাহ তাআলার সাথে এ সংযোগ-সম্পর্ক হ্রাস না পেয়ে বরং যাতে ক্রমশ বৃদ্ধি পায় সেই চিন্তাই যেন তাদের মনে প্রতিটি মুহূর্তে জাগরুক থাকে। বস্তুত আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই যে আমাদের এ কাজের মূল প্রাণ স্বরূপ : এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে কোনো প্রকার দ্বিতম নেই। আল্লাহর ফযলে আমাদের কোনো সহকর্মীই এর গুরুত্ব সম্পর্কে অসতর্ক নয়। তবে এ ব্যাপারে কতকগুলো প্রশ্ন অনেক সময় লোকদেরকে বিব্রত করে তোলে, তাই এই যে, আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সঠিক তাৎপর্য কি, এটা কিরূপে স্থাপিত এবং বর্ধিত হয়। আর আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, থাকলেই বা কতখানি এবং এসব কথা জানাবার সঠিক উপায় কি হতে পারে?
এ সকল প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর জানা না থাকার কারণে আমি অনেক সময় অনুভব করেছি যে, অনেকেই এ ব্যাপারে নিজেদেরকে সীমাহীন মরুভূমির ম্যধে পতিত ও সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় দেখতে পায়। সেখানে বসে তারা আপন লক্ষ্য পথের সন্ধান করতে পারে না। এমনকি কতখানি পথ অতিক্রম করেছে, কোনখানে এসে পৌঁছেছে এবং কতখানি পথ বাকি আছে, তাও সঠিকরূপে অনুমান করতে পারে না। ফলে অনেক সময় আমাদের কোনো সহকর্মী হয়তো অস্পষ্ট ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েন। কেউ বা এমন পথে অগ্রসর কারো পক্ষে লক্ষ্যস্থলের দূরে কিংবা নিকটবর্তী বস্তুত মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা দু:সাধ্য হয়ে পড়েছে। কেউ বা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। এ কারণেই আমি আপনাদেরকে শুধু আল্লাহ তাআলার সাথে সংযোগ স্থাপন সম্পর্কে উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হবো না, বরং উল্লেখিত প্রশ্নাবলীর একটা সুষ্ঠু জবাব দেয়ার জন্য সাধ্যনুযায়ী চেষ্টা করবো।
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের তাৎপর্য সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : মানুষের জীবন-মরণ, ইবাদাত-বন্দেগী, কুরবানী ইত্যাদি সবকিছু একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই নির্ধারিত হবে। এজন্যই নির্দিষ্ট করে তাঁর ইবাদাত করবে :
নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু একমাত্র রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যই উৎসর্গীকৃত। সূরা আল আনআম : ১৬২
সে পূর্ণ একাগ্রতার সাথে দীনকে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সম্বন্ধে এমন বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন যে, এর অর্থ ও তাৎপর্যের ভিতর কোনোটাই অস্পষ্টতা নেই।
তাঁর বাণী সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অর্থ হচ্ছে :
গোপনে এবং প্রকাশ্যে সকল কাজেই আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো।
নিজের উপায়-উপাদানের তুলনায় আল্লাহ তাআলার মহান শক্তির উপরেই অধিক ভরসা করা এবং আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য লোকের বিরাগভাজন হওয়া। এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা হচ্ছে লোকের সন্তুষ্টিলাভের জন্য আল্লাহ তাআলার অসন্তোষ অর্জন করা অতপর এ সংযোগ-সম্পর্ক যখন বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থায় উপনীত হবে যে, লোকের সাথে বন্ধুত্ব, শত্রুতা এবং লেন-দেন ইত্যাদি সবকিছুই একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যেই সম্পন্ন হবে, নিজের ইচ্ছা প্রবৃত্তি বা আগ্রহ ঘৃণার বিন্দুমাত্র প্রভাবও সেখানে থাকবে না, তখনই বুঝতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালার সাথে তার সম্পর্ক পরিপূর্ণ হয়েছে।
এছাড়া প্রত্যেক রাতে আপনার দোয়ায়ে কুনুতে যা পাঠ করেন, তার প্রতিটি শব্দই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার এ সম্পর্কের পরিচয় দিচ্ছে। আপনারা আল্লাহ তাআলার সাথে কোন ধরনের যোগ-সম্পর্ক স্থাপনের স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তা এ দোয়ার শব্দাবলীর প্রতি লক্ষ্য করলেই সুন্দরূপে বুঝতে পারেন।
হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাচ্ছি, তোমারই কাছে সরল-সত্য পথের নির্দেশ চাচ্ছি, তোমারই কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি, তোমারই উপরে আস্থা স্থাপন করছি, তোমারই উপর ভরসা করছি এবং তোমার যাবতীয় উত্তম প্রশংসা তোমার জন্য নির্দিষ্ট করছি। আমরা তোমারই কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ, তোমার অকৃতজ্ঞ দলে শামিল নই। তোমার অবাধ্য ব্যক্তিকে আমার বর্জন করে চলি। হে আল্লাহ! আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি, তোমারই জন্য সালাত আদায় করি, সেজদা করি এবং তোমার জন্যই আমাদের যাবতীয় চেষ্ট-তৎপরতা নিবদ্ধ। আমরা তোমার অনুগ্রহ প্রার্থী এবং তোমার শাস্তি সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত। নিশ্চয়ই তোমার যাবতীয় আযাব কাফেরদের জন্য নির্দিষ্ট।
হযরত রাসূলে করীম (স) তাহাজ্জুদের জন্য উঠার সময় যে দোয়া পাঠ করতেন তাতেও আল্লাহ তাআলার সাথে এ সম্পর্কের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি আল্লাহ তাআলাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন :
হে আল্লাহ! আমি তোমারই অনুগত হলাম, তোমার প্রতি ঈমান আনলাম, তোমার উপর ভরসা করলাম, তোমার দিকে আমি নির্বিষ্ট হলাম, তোমার জন্যই আমি লড়াই করছি এবং তোমার দরবারেই আমি ফরিয়াদ জানাচ্ছি।
আল্লাহ তাআলার সাথে একজন মুমিনের যে সম্পর্ক থাকা উচিত, উপরে তার সঠিক বর্ণনা দেয়া হলো। এখন এ সম্পর্ক এবং তা বৃদ্ধি করা যায় কিভাবে তা-ই আমাদের চিন্তা করে দেখতে হবে।
এ সম্পর্ক স্থাপনের একটি মাত্র উপায় রয়েছে, তা এই যে, মানুষকে সর্বান্তকরণে এক ও লা-শরীক আল্লাহ তাআলাকে নিজের এবং সমগ্র জগতের একমাত্র মালিক, উপাস্য এবং শাসকরূপে স্বীকার করতে হবে। প্রভূত্বের যাবতীয় গুনাবলী, অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই নির্দিষ্ট বলে গ্রহণ করতে হবে। নিজের মন-মস্তিষ্ককে নির্মল ও পবিত্র রাখতে হবে। এ কাজটি সম্পাদনের পরই আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এসম্পর্ক দুটি উপায়ে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো চিন্তা ও গবেষণার পন্থা আর দ্বিতীয়টি হলো বাস্তব কাজের পন্থা।
চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায় হলো পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহের সাহায্য এ ধরনের সংযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করা ।এভাবে আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার যে স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে কার্যত যে রূপ সম্পর্ক থাকা উচিত সেই বিষয়ে আপনাকে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হবে। এ ধরনের যোগসূত্র সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে হবে। এধরনের যোগসূত্র সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা ও অনুভূতি লাভ এবং এটাকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, পবিত্র কুরআন-হাদীস বুঝে পাঠ করতে হবে এবং বারবার অধ্যয়ন করতে হবে। পবিত্র কুরআন-হাদীসের আলোকে যে সকল বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার যোগ সম্পর্ক আপনাকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলার সাথে আপনি কোন কোন বিষয়ে কতখানি দাবী আপনি পূরণ করেছেন, কোন বিষয়ে কতখানি ত্রুটি অনুভব করেছেন, আপনাকে তা যাচাই করে দেখতে হবে। এ অনুভূতি সমীক্ষা যতখানি বৃদ্ধি পাবে, ইনশাআল্লাহ আপনার সাথে আল্লাহ তাআলার যোগ সম্পর্কও ততই বাড়তে থাকবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার একটি সম্পর্ক এই যে, তিনি আপনাদের মাবুদ এবং আপনারা তাঁর গোলাম। দ্বিতীয় সম্পর্ক হলো, পৃথিবীর বুকে আপনার তাঁর প্রতিনিধি। আর তিনি অসংখ্য জিনিস আপনাদের কাছে আমানত রেখেছেন। তৃতীয় সম্পর্ক এই যে, আপনারা তাঁর প্রতি ঈমান এনে একটি বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করেছেন। সেই অনুসারে আপনাদের জান ও মাল বিনিময়ে চুক্তি সম্পাদন করেছেন। সেই অনুসারে আপনাদের জান ও মাল তাঁকে প্রদান করেছেন। এবং তিনি জান্নাতের বিনিময়ে তা খরিদ করে দিয়েছেন। চতুর্থ সম্পর্ক এই যে, আপনাকে তাঁর নিকট জবাবাদিহি করতে হবে এবং তিনি শুধু আপনার প্রকাশ্য বিষয়সমূহের প্রতি লক্ষ্য রেখেই হিসেবে গ্রহণ করবেন না। বরং আপনার প্রত্যেকটি কাজ, আপনার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর নিকট সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ রয়েছে: তার দৃষ্টিতে তিনি আপনার পুংখানুপুংখ হিসেবে গ্রহণ করবেন। মোটকথা, এরূপ অনেক বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার সম্পর্ক রয়েছে। এই সকল সংযোগ-সম্পর্ক স্পষ্ট ধারণা লাভ করা, তাংপর্য উপলব্ধি করা ও এর সদাসর্বদা স্মরণ রাখা এবং এর দাবীগুলো পূরণ করার উপরই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক-সংযোগ গভীর ও ঘনিষ্ঠতর হওয়া নির্ভর করেছে। পক্ষান্তরে এ ব্যাপারে আপনারা যতখানি সর্তক ও মনোযোগী হবেন, ততই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক গভীর ও মযবুত হবেন, ততই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক গভীর ও মযবুত হবেন, ততই আল্লাহ তাআলার সাথে আপনাদের সম্পর্ক গভীর ও মযবুত নিয়ে বেশীদুর অগ্রসর হওয়াই সম্ভব নয়। বাস্তব কাজ বলতে বুঝায় নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ তাআলার যাবতীয় নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন করা।
এ সমস্ত কাজে কোনো পার্থিব স্বার্থ নয় বরং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ করাকেই একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা যে সমস্ত কাজ নিষিদ্ধ করেছেন, গোপনে ও প্রকাশ্যে যে কোনো অবস্থায় তা আন্তরিক ঘৃণার সাথে বর্জন করতে হবে। এবং এর মূলেও কোনো প্রকার পার্থিব ক্ষতি বা বিপদের আশাংকা নয়, বরং আল্লাহ তাআলার গযব বা শাস্তির ভয়কেই বিশেষভাবে সক্রিয় রাখতে হবে। এভাবে আপনার যাবতীয় কার্যকলাপ তাকওয়ার পর্যায়ে উপনীত হবে এবং এর পরবর্তী কর্মপন্থা আপনাকে ইহসানের স্তরে উন্নীত করবে। অর্থ্যাৎ আল্লাহ তাআলার পছন্দ অনুসরে প্রত্যেকটি ন্যায় ও সৎকাজের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আপনি আগ্রহের সাথে আত্মনিয়েগের করবেন এবং তার অপছন্দীয় প্রত্যেকটি অন্যায় ও অসৎকাজের প্রতিরোধ চেষ্টায় ব্রত হবেন। এ পথে আপনি নিজের জান-মাল, শ্রম এবং মন-মগযের শক্তি সামর্থ কুরবানী করার ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্য করবেন না। শুধু তাই নয়, এপথে আপনি যা কিছু কুরবানী করবেন সেই জন্য আপনার মনে বিন্দুমাত্র গর্ব অনুভূত হওয়া উচিত নয়। আপনি কারো প্রতি কিছুমাত্র অনুগ্রহ করেছেন এরূপ ধারণাও কখনো পোষণ করবেন না। বরং বৃহত্তর কুরবানীর পরও যেন আপনার মনে একথাই জাগ্রত থাকে যে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আপনার যে দায়িত্ব রয়েছে, এতসব করার পরও তা পালন করা সম্ভব হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কর্মপন্থা অনুসরণ করা মোটেই সহজসাধ্য নয় । এটা অত্যন্ত দুর্গম লক্ষ্যস্থল । এ পর্যন্ত পৌছুতে হলে বিশেষ শক্তি সামর্থের প্রয়োজন । নিম্নলিখিত উপায়ে এ শক্তি অর্জন করা সম্ভব ।
এক . সালাত : শুধু ফরজ ও সুন্নত ই নয় , বরং সাধ্যানুযায়ী নফল সালাতও আদায় করা দরকার। কিন্ত নফল সালাত অত্যন্ত গোপনে আদায় করতে হবে, এবং আপনার মধ্যে নিষ্ঠার ভাব জাগ্রত হয়। নফল পড় বিশেষত তাহাজ্জুদ পড়ার কথা বাহির করতে থাকলে মানুষের মধ্যে এক প্রকার মারাত্মক। অন্যান্য নফল সাদকা এবং যিকর-আযকারের প্রচারের মধ্যেও অনুরূপ ক্ষতির আশাংকা রয়েছে।
দুইঃ আল্লাহর যিকর- জীবনের সকল অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার যিকর করা উচিত। কিন্তু বিভিন্ন সুফী সম্প্রদায় এজন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছেন কিংবা অপরের নিকট হতে গ্রহণ করেছেন,তা মোটেই ঠিক নয়। বরং এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) যে পন্থা অনুসরণ করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে শিক্ষা দিয়েছেন তাই হচ্ছে উত্তম ও সঠিক প্রক্রিয়া। হুজুরে আকরাম (স) এর অনুসৃত দোয়া, যিকর ইত্যাদির মধ্যে যতখানি সম্ভব আপনারা মুখস্ত করে নিবেন এবং শব্দ এ তার অর্থ উত্তমরূপে বুঝে নিবেন; অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে তা মাঝে মাঝে পড়তে থাকবেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ রাখা তা মাঝে মাঝে পড়তহে থাকবেন। বস্তুত আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ রাখা এবং তাঁর প্রতি মনকে নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটি বিশেষ কার্যকরী পন্থা।
তিনঃ সওম : শুধু পরয নয় ; বরং নফল সওমও প্রয়োজন। প্রত্যেক মাসে নিয়মিত তিনটি সওম রাখাই উত্তম। নফল সম্পর্ক এটাই বিশেষ উপযোগী ব্যবস্থা। এ সময়ে সওমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ কুরআন শরীফে বর্ণিত তাকওয়া অর্জনের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করা উচিত।
চারঃ আল্লাহর পথে অর্থ খরচ করা :
এ ব্যাপারে শুধু ফরযই নয়; সাধ্যানুসারে নফলও আদায় করতে হবে। এ সম্পর্কে একটি কথা উত্তমরূপে বুঝে নেয়া দরকার যে, আপনি আল্লাহ তাআলার পথে কি পরিমাণ অর্থ-সম্পদ ব্যায় করেছেন,মূলত তার কোনো গুরুত্ব নেই; বরং আপনি আল্লাহর জন্য কতখানি কুরবানী করলেন তা-ই হচ্চে প্রকৃত আপনি আল্লাহর জন্য কতখানি কুরবানী করলেন তা-ই হচ্ছে প্রকৃত বিচার্য। একজন গরীব যদি অভূক্ত থেকে আল্লাহর রাস্তায় একটি পয়সাও ব্যয় করে তবে তার সেই পয়সাটি ধনী ব্যক্তির এক হাজার টাকা হতে উত্তম। ধনী ব্যক্তির এক হাজার টাকা হয়তো তার ভোগ সামগ্রীর দশমাংশ কিংবা বিশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। এ প্রসংগে আরও একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার, আত্মার বিশুদ্ধিকরণের (তাযকিয়ায়ে নাফস) জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স) যে সব পন্থা নির্দেশ করেছেন তার মধ্যে সাদকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর কার্যকরী ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি অনুশীলন করে দেখতে পারেন কোনো ব্যাপারে আপনার একমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে আপনি অনুতপ্ত হৃদয়ে শুধু তাওবা করেই ক্ষান্ত হবেন। ঘটনাক্রমে পুনরায় যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে তখন আপনি তাওবা করার সাথে সাথে সাদকা করলে আত্মা অধিকতর বিশুদ্ধ হয়ে থাকে এবং অসৎ চিন্তার মুকাবিলায় আপনি অধিক সাফল্যের সাথে অগ্রসর হতে পারবেন।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ আমাদেরকে এ সহজ-সরল পন্থা অনুসরণেরই নির্দেশ দান করেছে। নিষ্ঠার সাথে এর অনুশীলন করলে কঠোর সাধনা, তপস্যা কিংবা মোরাকাবা ছাড়াই আপনি নিজ গৃহে স্ত্রী-পুত্রাদির সাথে অবস্থান করে এবং সমস্ত সাংসারিক দায়িত্ব পালন করেই আল্লাহ তাআলার সাথে সংযোগ সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবেন।
এখন একটি সমস্যার সমাধান হওয়া আবশ্যক। তা এই যে, আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সংযোগ-সম্পর্ক কতখানি স্থাপিত হয়েছে তা কিভাবে ও কি উপায়ে বুঝবো? আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে, না হ্রাস পাচ্ছে তা-ই বা আমরা কি উপায় বুঝবো? এর জবাবে আমি আপনাদেরকে বলতে চাই যে, এটা অনুভব করার জন্য স্বপ্নযোগে সু-সমাচার প্রাপ্ত অথাব কাশফ ও কারামত যাহির করার প্রয়োজন নেই; কিংবা অন্ধকার কুঠরীর মধ্যে বসে আলোক প্রাপ্তির অপেক্ষা করার কোনো আবশ্যক নেই। এ সম্পর্ক পরিমাপ করার ব্যবস্থা তো আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে করেই রেখেছেন। আপনি জাগ্রত জীবন ও কর্ম প্রচেষ্টা এবং দিনের বেলায়ই তা পরিমাপ করে দেখতে পারেন। নিজের জীব্ন ও কর্ম প্রচেষ্টা এব আপনার চিন্তা-ভাবধারা সম্পর্কে পর্যালোচনা করে দেখুন। নিজের হিসেব-নিকেশ আপনি নিজেই ঠিক করে দেখুনঃ আল্লাহ তাআলার সাথে যে চুক্তিতে আপনি আবদ্ধ রয়েছেন তা কতখানি পালন করেছেন। আল্লাহ তাআলার আমানাতসমূহ কি আপনি একজন আমানাতদার হিসেবে ভোগ-ব্যবহার করেছেন, না আপনার দ্বারা কোনো প্রকার খেয়ানত হচ্ছে? আপনার সময়, শ্রম, যোগ্যতা, প্রতিভা, ধন-সম্পদ ইত্যাদির কতটুকু আল্লাহ কাজে ব্যয়িত হচ্ছে আর কতটুকু অন্য পতে নিয়োজিত হচ্ছে? আপনার স্বার্থ কিংবা মনোভাবের উপর আঘাত লাগলে আপনি কতখানি বিরক্ত ও রাগান্বিত হন। তখনই বা আপনার ক্রোধ, মর্মপীড়া, মানসিক অশান্তি কতখানি হয়? এরূপ আরো অনেক প্রশ্ন আপনি নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন এবং এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবের উপর ভিত্তি করে আপনি প্রত্যেহ বুঝতে পারেন যে, আল্লাহ তাআলার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক ও যোগ আছে কিনা? থাকলে তা কতখানি এবং তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, না কমে যাচ্ছে? কাজেই স্বপ্নের সুসংবাদ, কাশফ-কারামত, কিংবা নূরের তাজাল্লী ইত্যাদি অতি-প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বনের চেষ্টা হতে আপনি বিরত থাকুন। প্রকৃতপক্ষে এ বস্তুজগতের প্রবঞ্চনামূলক বৈচিত্রের প্রলোভন ও ভয়ভীতির মুকাবিলায় সরল-সত্য পথে মযবুতভাবে কায়েম থাকা অপেক্ষা বড় কারামত আর কিছুই হতে পারে না। কুফরী, ফাসেকী ও গুমরাহীর ঘনঘোর অন্ধকারের মধ্যে সত্যের আলো দেখতে পাওয়া এবং তা অনুসরণ করার চেয়ে কোনো বড় নূরের তপস্যা থাকতে পারে না। তার মুমিনগণ সবচেয়ে বড় সুসংবাদ লাভ করতে চাইলে-আল্লাহ তাআলাকে নিজের রব (প্রভু ও পালনকর্তা) হিসেবে স্বীকার করে এর উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকা এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে চলাই হচ্ছে এর একমাত্র উপায়।
যারা বলছে যে, আল্লাহ আমাদের রব অতপর তারা এ ব্যাপারে অটল-অবিচল থাকে, নিসন্দেহে তাদের উপর ফেরেশতা নাযিল হয় (এবং তাদেরকে বলে) তোমরা ভয় করো না, দু:খ করো না, বরং তোমাদের সাথে যে জান্নাতের ওয়াদা করা হয়েছে তার সুসংবাদে আনন্দিত হও। সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৩০
আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক-সংযোগ স্থাপনের পর আমি আপনাদের আরো একটি কথা বলতে চাই। তা এই যে, আপনারা সকল অবস্থায়ই পার্থিব সুযোগ-সুবিধার চেয়ে আখেরাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করবেন ও নিজেদের কাজের মূলে আখেরাতের সাফল্য লাভের আকাঙ্ক্ষাকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন।
কুরআন মজীদ আমাদেরকে বলছে, স্থায়ী অনন্ত জীবন ক্ষেত্র হচ্ছে আখেরাত। দুনিয়ার এ অস্থায়ী বাসস্থানে আমাদেরকে শুধু পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত সামান্য সাজ-সরঞ্জাম, সীমাবদ্ধ ক্ষমতা-ইখতিয়ার, সামান্য অবকাশ ও সুযোগোর সদ্ব্যবহার করে আমাদের মধ্যে হতে কতো লোক আল্লাহ তাআলার জান্নাতের স্থায়ী সাসিন্দা হওয়ার যোগ্য প্রতিপন্ন হতে পারে আমাদেরকে সেই পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু শিল্প,বাণিজ্য, কৃষি কাজ ও রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কতখানি কৃতিত্ব রয়েছে, রাস্তাঘাট ও বাড়ী নির্মাণে আমরা কতখানি পটু কিংবা এক শানদার সভ্যতা সংস্কৃতি গঠনে আমরা কতখানি সাফল্য লাভ করতে পারি, সেই বিষয়ে আমাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না। বরং আল্লাহ তাআলার প্রদত্ত আমানাতসমূহের ব্যাপারে আমরা তাঁর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে কতখানি যোগ্যতার অধিকারী এটাই হচ্ছে আমাদের পরীক্ষার মূল বিষয়। আমরা কি এখানে বিদ্রোহী ও স্বাধীন হয়ে বসবাস করি, না তাঁর অনুগত বান্দাহ হিসেবে; আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর মর্জি পূরণ কির; আল্লাহর দুনিয়াকে তাঁর ইচ্ছানুসারে সুসজ্জিত করি, না বিভেদ-বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শয়তানী শক্তিগুলোর সামনে আত্মসমর্পণ করি, না তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকি, এটাই হলো আমাদের পরীক্ষা। জান্নাতে হযরত আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস হলো আমাদের পরীক্ষা হয়েছিলো মূলত তাও ছিলো ঠিক এ পরীক্ষা। আর আখেরাতের জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে মানব জাতির মধ্যে হতে যাদেরকে নির্বাচিত করা হবে তাও হবে। এ চূড়ান্ত প্রশ্নটির ভিত্তিতে। সুতরাং সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল মাপকাঠি এটা মোটেই নয় যে, কে রাজ সিংহাসনে বসে পরীক্ষা দিয়েছে, আর কে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে, কাউকে বিরাট সাম্রাজ্য দান করে পরীক্ষা করা হয়েছে আর কাউকে জীর্ণ কুটিরে বসিয়ে। পরীক্ষা কেন্দ্রের সাময়িক সুযোগ-সুবিধা যেমন সাফল্যের কোনো প্রমাণ নয়, তেমনি তা কোনো অসুবিধা ও ব্যর্থতার ও লক্ষণ নয়। আসল কামিয়াবী-যেদিকে এ পরীক্ষা কেন্দ্রের যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন আমাদের সাজ-সরঞ্জাম যাই হোক না কেন, আমরা যেন নিজেদেরকে আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দাহ এবং তাঁর মর্জির সঠিক তাবেদার সাব্যস্ত করতে পারি। একমাত্র এভাবেই আমরা আখেরাতে আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দাহদের নির্দিষ্ট মর্যাদা লাভে সক্ষম হবো।
বন্ধগণ! এটাই হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু এটা এমন একটি বিষয় যে, একবার মাত্র জানলে, বুঝলে ও স্বীকার করলেই এ কাজটি সম্পন্ন হতে পারে না,বরং সদা-সর্বদা স্মরণ রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও যত্ন করতে নয়। নতুবা এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যে, আখেরাতকে অস্বীকার না করেও আমরা হয়তো আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসীদের ন্যায় নিছক পার্থিব কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বো। কেননা পরকাল হচ্ছে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অবস্থিত, শুধু মৃত্যুর পরেই তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হবে। পার্থিব জীবনে আমরা শুধু চিন্তা কল্পনা-শক্তির সাহায্যেই এর ভালো-মন্দ ফলাফল অনুভব করতে পারি। পক্ষান্তরে এ দুনিয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, এটা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব এবং ভালো-মন্দ প্রত্যকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা সর্বক্ষণ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। এর বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনবলী ও পরিণতিকে অনেক সময়ে চূড়ান্ত বলে আমাদের মনে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আখেরাত সম্পর্কিত কোনো কাজ হলে সেই বিষয় শুধু আমাদের অন্তরের এক কোণায় লুক্কায়িত বিবেক সামান্য কিছুটা তিক্ততা অনুভব করি মাত্র, অবশ্য যদি তা সজীব থাকে। কিন্ত আমাদের পার্থিব কোনো স্বার্থ বিনষ্ট হলে আমাদের প্রতিটি লোমকূপও তার জন্য ব্যথা অনুভব করে। আমাদের স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নির্বিশেষে সমাজের সাধারণ লোকজন সকলেই তা অনুভব করতে পারে। অনুরপভাবে আখেরাত যদি সাফল্য হয়, তবে আমাদের অন্তরের একটি নিভৃত কোণ ছাড়া আমাদের গাফলতির দরুন সম্পূর্ণরূপে নিষ্পন্দ হয়ে গিয়ে না থাকে। কিন্তু আমাদের পার্থিব সাফল্যকে আমাদের গোটা সত্ত্বা ও ইন্দ্রিয়নিচয় অনায়সে অনুভব করতে পারে এবং আমাদের সমগ্র পরিবেশ তা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। এ কারণেই একটি ধারণা বা বিশ্বাস হিসেবে আখেরাতকে স্বীকার করা হয়তো কোনো কঠিন কাজ নয়; কিন্তু গোটা চিন্তাধারা, দৈনতিক চরিত্র ও কর্মজীবনের সমগ্র ব্যবস্থাপনার বুনিয়াদ হিসেবে এটাকে গ্রহণ করে তদানুযায়ী আজীবন কাজ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। মুখে দুনিয়া কিছু নয় বলা যতই সহজ হোক না কেন; কিন্তু অন্তর হতে এর বাসনা কামনা এবং চিন্তাধারা হতে এর প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদূরিত করা মোটেই সহজ নয়। এ অবস্থায় উপনীত হবার জন্য বহু চেষ্টা-যত্ন আবশ্যক। আর অবিশ্রান্ত চেষ্টার ফলেই তা স্থায়ী হতে পারে।
আপনারা হয়তো জিজ্ঞেস করবেন যে, আমরা সেই জন্য কিরূপ চেষ্টা করতে পারি? এবং এ জন্য আমরা কোন কোন জিনিসের সাহায্য গ্রহণ করবো? এর জবাবে আমি বলতে চাই যে, এরও দুটি উপায় রয়েছে : একটি চিন্তাও আদর্শমূলক। অপরটি হলো বাস্তব কর্মপন্থা।
চিন্তা ও আদর্শিক অনুশীলনের পন্থা এই যে, আপনি শুধু আমি আখেরাতের প্রতি ঈমান আনলাম। একথাটির মুখে উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হবেন না। বরং অর্থ বুঝে কালামে পাক অধ্যয়নের অভ্যাস করবেন। এর ফলে আপনার বিশ্বাসের চোখে ক্রমাগত পার্থিব দুনিয়ার এ আবরণের অন্তরালে অবস্থিত আখেরাত অত্যন্ত স্পষ্টরূপে ধরা দেবে। কারণ কালামে পাকে সম্ভবত এমন একটি পৃষ্ঠাও নেই যেখানে কোনো না কোনোরূপে আখেরাতের উল্লখ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন স্থানে আখেরাতের এমন বিস্তারিত নকশা দেখতে পাবেন যে, আপনার মনে হবে, যেন কেউ চাক্ষুসভাবে দেখার পরেই এটা বর্ণনা করেছে। এমনকি অনেক স্থানে এ চিত্র এমন সুন্দরভাবে ফুটে উছেছে বলে অনুভব করতে থাকে তখন মনে হয় যেন, এজড় জগতের হাল্কা পর্দাখানা একটু একটু সরে গেলেই বর্ণিত ঘটনবলী প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হতো। সুতরাং নিয়মিত কুরআন শরীফ বুঝে তেলাওয়াত করতে থাকলে মানুষের মনে ক্রমশ সর্বদা স্মরণ রাখতে পারবে যে, তার স্থায়ী হতে পারবে। তখন সে কথাটি সর্বদা স্মরণ রাখতে পারবে যে, তার স্থায়ী বাসভূমির সন্ধান লাভ মৃত্যুর পরই সম্ভব এবং দুনিয়ার এ অস্থায়ী জীবনেই এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
হাদীস অধ্যয়ন করলে এ মনোভাব আরও বলবত ও মযবুত হয়। কারণ হাদীস শরীফে পরলোক সম্পর্কে প্রায় চাক্ষুস অভিজ্ঞতার মতোই বিবরণ সন্নিবিষ্ট রয়েছে। এছাড়া হযরত নবী করীম (স) স্বয়ং এবং তাঁর সাহাবায়ে কিরাম সর্বদা আখেরাত সম্পর্কে কতখানি সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন তা থেকে তা জানা যায়। কবর যিয়ারত করলে এ বিষয়ে আরো সাহায্য লাভ করা যায়। নবী করীম (স) কবর যিয়ারত উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলেছেন যে, মানুষ এর সাহায্য নিজের মৃত্যুর স্মরণ করতে সক্ষম হয় এবং লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ এ দুনিয়ার বুকে অবস্থান করেও একথা তার মনে জাগরুক রাখতে পারে যে, সকল মানুষ যেখানে গিয়েছে এবং প্রত্যহ অসংখ্য লোক যেখানে পৌঁছাছে তাকেও একদিন সেখানে এবং প্রত্যহ অসংখ্য লোক যেখানে পৌঁছেছে তাকেও একদিন সেখানে যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে গুমরাহ লোকেরা যে সমস্ত মাযারকে মকছুদ হাসিল কিংবা মুশকিল আসানের কেন্দ্র হিসেবে খাড়া করেছে,তার পরিবর্তে সাধারণ গরীব লোকদের কবরস্থান এদিক দিয়ে অনেক বেশী উপকারী। অথবা এ উদ্দেশ্যে প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের শূন্য ও পাহারাদার বিবর্জিত বিরাটকার কবরগুলো পরিদর্শন করা চলে।
অতএব বাস্তব কর্মপন্থার কথায় আসুন। এ পার্থিব জীবনে আপনাকে ঘর-সংসার, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, নিজের শহর ও দেশের ব্যবস্থাপনা, আদান-প্রদান এবং অর্থনৈতিক কাজ-কারবার এক কথায় জীবনের প্রতি পদেই আপনাকে উভয় সংকটের সম্মুখীন হতে হয় এবং একদিকে আখেরাত বিশ্বাস আর অপরদিকে দুনিয়াদারী আপনাকে হাতছানি দেয়। এমতাবস্থায় আপনাকে প্রথমোক্ত পথেই অগ্রসর হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যদি নফসের দুর্বলতা কিংবা আলস্যবশত আপনি কখনো ভিন্ন পথেই অগ্রসর হন, তবে সেই কথা স্মরণ হওয়ার সাথে সাথেই আপনি পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন, ভুল পথে আপনি অনেক দূল অগ্রসর হলেও কোনো কথা নেই। তাছাড়া আপনি মাঝে মাঝে নিজের হিসেব-নিকেশ করে দেখবেন, কোন কোন ক্ষেত্রে দুনিয়া আপনাকে নিজের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছে আর আপনিইবা কতবার আখেরাতের দিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছেন। এ পর্যালোচনার দ্বারাই আপনি কতখানি মযবুত হয়েছে আর কতখানি আপনাকে অভাব পূরণ করতে হবে। যতখানি অভাব দেখেবেন তা নিজেই পূরণের চেষ্টা করবেন। এ ব্যাপারে বাহির থেকে কোনো প্রকার সাহায্য লাভ করতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম দুনিয়াদার লোকদের সংশ্রব পরিত্যাগ করতে হবে এবং আপনার জানা মতে যাঁরা দুনিয়ার তুলনায় আখারতেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, এধরনের নেক লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু একটি কথা আপনাকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, আপনার নিজের চেষ্টা ছাড়া কোনো গুণের হ্রাস-বৃদ্ধি করার বাস্তব কোনো পন্থা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কিংবা নিজের মধ্যে মূল উপাদান পর্যন্ত বর্তমান নেই, এমন গুণ সৃষ্টিও করাও সম্ভব নয়।
তৃতীয় যে বিষয়ে আমি আপনাদেরকে উপদেশ দিতে চাই তা এই যে, গত কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগত চেষ্টার ফলে আপনাদের ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিকভাবে কখনো দেখা না দেয়। আপনারা যেন ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিকভাবে কখনো এরূপ ভুল ধারণা পোষণ না করেন যে, আমরা এখন পূর্ণত্ব লাভ করেছি, যা কিছু যোগ্যতা অর্জন করা দরকার ছিলো, তার সবই আমরা হাসিল করে ফেলেছি। সুতরাং এখন আর আমাদের কাম্য এমন কোনো বস্তু নেই, যেজন্য আমাদেরকে আরো চেষ্টা-যত্ন করতে হবে। আমাকে এবং জামায়াতের অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণকে অনেক সময়ই একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বেশ কিছুদিন যাবত কিছু সংখ্যক লোক জামায়াতে ইসলামীর-প্রকৃতপক্ষে জামায়াত পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের মূল্য হ্রাস করার মতলবে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, এ জামায়াত নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার আত্মশুদ্ধি বা আধ্যাত্মিকতার কোনো নাম-নিশানা নেই। এর কর্মীদের মধ্যে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক এবং আখেরাত চিন্তার অভাব রয়েছে। এদলের পরিচালক নিজে যেমন কোনো পীরের মুরীদ নয়, তেমনি তিনি কোনো খানকা হতেও তাকওয়া পহহেযগারী বা ইহসান-কামালিয়াতের ট্রেনিং-এর সুযোগ পাবেন, তারও কোনো সম্ভবনা নেই। এধরনের প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং আন্দোলনের প্রতি আগ্রহশীল লোকদের মনে জামায়াতের প্রতি বীতশ্রদ্ধার সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে পুনরায় এমন আস্তনায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করা, যেখানে কুফরীর আশ্রয়ে থেকে ইসলামের আংশিক খেদমত করাকেই আজ পর্যন্ত এক বিরাট কীর্তীরূপে গণ্য করা হচ্ছে, যেখানে দীন ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী করার কোনো কল্পনারই অস্তিত্ব নেই। বরং যেখানে এ ধরনের কোনো পরিকল্পনার কথা উত্থাপন করার পার নানাভাবে এটাকে এক অধর্মীয় প্রস্তাব বলে প্রমাণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে এবং এরূপ প্রস্তাবকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, কুফর ও ফাসেকীর পরিবর্তে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পুন: প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য বিস্তারের কল্পনাকে একটি নিতান্ত বৈষায়িক চিন্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। একারণেই আমাদরকে বাধ্য হয়ে খানকার আত্মশুদ্ধি ও ইসলামী আত্মশুদ্ধির মধ্যকার পার্থক্য উদঘাটন করতে হয় এবং প্রকৃত তাকওয়া পরহেযগারী ও ইহসানের সঠিক পরিচয় যা ইসলামের কাম্য-পরিষ্কার করে বর্ণনা করতে হয় এবং ধর্ম শিল্পে লোকগণ যে সনাতন ও কামালিয়াতের শিক্ষা বা ট্রেনিং দিচ্ছেন, তার সাথে ইসলামের পার্থক্য কতটুকু তা বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেই সাথে জামায়াতে ইসলামী কর্তক অনুসৃত সংশোধন ও ট্রেনিং পদ্ধতি এবং এর ফলাফলও আমাদেরকে প্রকাশ করতে হয়, যেন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চেতনা সম্পন্ন যে কোনো লোক একথা বুঝতে পারেন যে, জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও কর্মনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পর প্রাথমিক ভাবধারা সৃষ্টি হতে শুরু করে, তা জীবন ব্যাপী আত্মশুদ্ধির ট্রেনিং লাভের পরও এমনকি ট্রেনিংদাতাদের মধ্যেও দেখা যায় না।
এ সকল কথা আমরা আমাদের সমালোচকদের বে-ইসাফীর কারণেই বলতে বাধ্য হচ্ছি। নিছক আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং ইসলামী আন্দোলনের নিরাপত্তার জন্য এটা আমাদের বলতে হয়, কিন্তু এ সমস্ত কথার ফলে আমাদের সহকর্মীদের মনে যেন কোনো প্রকার গর্ব-অহংকার কিংবা নিজেদের কামালিয়াত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা না জন্মে, সে জন্য আমরা আল্লাহর নিকট পানাহ চাচ্ছি। আল্লাহ না করুন, আমাদের মধ্যে যদি কোনো প্রকার মিথ্যা অহমিকা দেখা দেয়, তবে এ পর্যন্ত আমরা যতটুকু লাভ করেছি তাও হয়তো হারিয়ে বসবো।
এ বিপদ হতে আত্মরক্ষার জন্যই আমি আপনাদেরকে তিনটি নিগুঢ় সত্য ভালো করে বুঝে নিতে এবং তা কখনো বিস্মৃত না হতে অনুরোধ করি।
কামালিয়াত (পূর্ণত্ব) একটি সীমাহীন ব্যাপার, এর শেষ সীমা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে অবস্থিত। মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, এর শীর্ষদেশে আরোহণ করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করা এবং কথাও পৌঁছেয়ে একথা ব্যক্ত না করে যে, সে কামেল হয়ে গিয়েছে। কোনো ব্যক্তি যে মুহূর্তে এ ধারণায় পতিত হবে সাথে সাথেই তার উন্নতি থেমে যাবে। শুধু যে থেমে যাবে তা-ই নয়, বরং সেই সাথে তার অবনতির সূত্রপাত হবে। একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, কেবল উচ্চস্থানে উন্নীত হওয়ার জন্যই নয় বরং সেই সাথে তার অবনতির সূত্রপাত হবে। একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, কেবল উচ্চস্থানে উন্নীত হওয়ার জন্যই নয় বরং সেখানে টিকে থাকতে হলেও অবিশ্রান্ত চেষ্টা-তৎপরতা আবশ্যক। কারণ এ চেষ্টার ধারা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে নিম্নভূমির আকর্ষণ মানুষকে নীচের দিকে টানতে আরম্ভ করে। কোনো বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে কেবলমাত্র নীচের দিকে তাকিয়ে সে কতখানি উপরে উঠেছে, তা দেখা উচত নয়। বরং তার আর কতখানি উপরে উঠেছে, তা দেখা উচিত নয়। বরং তার আর কতখানি উপরে উঠতে হবে এবং এখনো সে কতখানি দূরে রয়েছে এটাই তার দেখা কর্তব্য।
দ্বিতীয়ত, ইসলাম আমাদের সামনে মানুষত্বের যে উচ্চতম আদর্শ উপস্থাপিত করেছে, এর প্রাথমিক স্তরসমূহ ও অন্যান্য অনৈসলামিক ধর্ম ও মতবাদগুলোর উচ্চতম আদর্শের তুলনায় অনেক ঊর্ধে অবস্থিত। এটা আদৌ কোনো কল্পনাপ্রসূত মান নয় বরং এ পার্থিব জীবনেই আম্বিয়ায়ে কিরাম, মহানুভব সাহাবাগণ এবং জাতির আদর্শ পুরুষগণ পবিত্র জীবনধারা আমাদের সামনে ইসলামের মহান আদর্শ সম্পর্কে পথনির্দে করেছে। এ আদর্শ আমন সর্বদা আপনার সামনে রাখবেন। এভাবে আপনার তথাকথিত কামালিয়াতের বিভ্রান্তির কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবেন এবং নিজেদের পশ্চাৎপদতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সক্ষম হবেন। পরন্তু উন্নতি লাভের চেষ্টা-তৎপরতার জন্য এটা এমনভাবে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকবে, যার ফলে আপনি আজীবন সংগ্রাম-সাধনার পরও মনে করবেন যে, এখনো উন্নতির অনেক স্তর বাকী রয়েছে। আপনার আশেপাশে মূমূর্ষ রোগীদের দেখে নিজেদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা সম্পর্কে একটুও গর্ববোধ করবেন না। আপনারা নৈতিক ও আধ্যাত্মিকতার সেই বীর পাহলোয়ানদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন যাদের স্থলাভিষিক্ত হিসেবেই আপনারা শয়াতানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ময়দানে অবতীর্ণ হচ্ছেন। দীন-সম্পদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উন্নত ও অগ্রসর লোকদের দিকে লক্ষ্য রাখা এবং বৈষায়িক ধন-সম্পদের কর্তব্য, যেন তার ভিতর থেকে দীন-সম্পদের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকদেরকে সামনে রাখাই ঈমানদার লোকদের কর্তব্য, যেন তার ভিতর থেকে দীন-সম্পদ লাভের তৃষ্ণা বিদূরিত না হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যতটুকু বিষয়-সম্পত্তি দান করেছেন তাতেই সে আল্লাহর শোকর করতে পারে এবং অল্পতেই যেন তার ধন-সম্পদের পিপাসা নিবৃত হয়।
তৃতীয়ত, আমাদের জামায়াত এ পর্যন্ত যতটুকু গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে, প্রকৃতপক্ষে শুধু তা বর্তমান বিকৃত পরিবেশের কারণেই সম্ভব হয়েছে। কেননা এ ঘনঘোর অন্ধকার মধ্যে আমরা যে ক্ষীণ শিখার একটি প্রদীপ জ্বলাবার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তাই এখন উজ্জ্বল প্রকটিত হয়ে দেখা দিয়েছে। নতুবা প্রকৃত সত্য কথা এই যে, ইসলামের নিন্মতম আদর্শের সাথে আমাদের চেষ্টা-তৎপরতার তুলনা করলেও প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে-ব্যক্তিগত জীবন ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে-কেবলমাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতি স্বীকার কির তবে তা যেন শুধু বিনয় প্রকাশের জন্যই না হয়, বরং তা যেন আন্তরিক স্বীকৃত হয়। এর ফলে আমাদের প্রত্যেকটি দুর্বলতা যেন সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে এবং তা দূর করার জন্য আগ্রহ ও চেষ্টা যেন তীব্রতর হয়।
এ কাজে আপনাদের সাহায্যের জন্যই জামায়াতের পক্ষ থেকে ট্রেনিং-এর নতুব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ কার্যসূচী অনুসারে যে সমস্ত ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে তাতে জামায়াতের রুকন বা মুত্তাফিক সকলেই শরীক হতে পারেন। ট্রেনিং-এর মেয়াদ ইচ্ছা করেই সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, যেন ব্যবসায়ী, কর্মচারী, কৃষিজীবী সকল শ্রেণীর লোকই এটা হতে সহজে ফায়াদা হাসিল করতে পারেন। ট্রেনিং কোর্সের দুটি ভাগ রয়েছেঃ একটি শিক্ষা মূলক, অপরটি অনুশীলনমূলক। প্রথম অংশে আমাদের লক্ষ্য হলো-শিক্ষার্থীগণ অল্প সময়ের সধ্যেই যেন পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা, ফিকাহ শাস্ত্রের হুকুম ও আহকাম এবং জামায়াতের পুস্তকাদির একটি প্রয়োজনীয় অংশ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সক্ষম হয়। এর ফলে ট্রেনিং গ্রহণকারী কর্মী যেন সহজেই দীনি
যে ব্যক্তি নিজের দীনের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত উন্নত লোকের প্রতি দৃষ্টি রেখে তার অনুসরণ করবে এবং পার্থিব বিষয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যক্তিকে দেখে আল্লাহ তাআলার দান সামগ্রীর শুকরিয়া প্রকাশ করবে, সে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ ও ধৈর্যশীলরূপে পরিগণিত হবে। আর যে ব্যক্তি দীনের ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকের প্রতি লক্ষ্য করবে এবং পার্থিব ব্যাপারে অধিক ধনশীলতার প্রতি লক্ষ্য করবে, কোনো বিষয়ের অভাব থাকলে সেই জন্য সে আফসোস করবে, আল্লাহর দরবারে সেই ব্যক্তি কৃতজ্ঞ এবং ধৈর্যলীরূপে পরিগণিত হতে পারবে না।
ব্যবস্থা, তার দাবী, তদনুযায়ী জীবনযাপনের পন্থা এবং এর প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত কর্মসূচী স্পষ্ট বুঝতে পারে। সেই সাথে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বাস্তব রূপায়ণের জন্য কোন ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চরিত্রের আবশ্যক, তাও যেন সে উপলব্ধি করতে পারে। কর্মসূচীর অনুশীলনমূলক অংশের উদ্দেশ্য এই যে, এর মাধ্যমে আমাদের কর্মগণ অনন্ত কিছুদিন এ স্থানে সমবেতভাবে স্বচ্ছ ও নির্মল ইসলামী পরিবেশে বসবসের সুযোগ স্থানে সমবেতভাবে স্বচ্ছ ও নির্মল ইসলামী পরিবেশে বসবাসের সুযোগ লাভ করতে পারবে। এর ফলে তাদের মধ্যে নিয়মানুবর্তীতা, শৃঙ্খলা রক্ষা, সৌভ্রাতৃত্ব এবং প্রীতি সৌহার্দের অভ্যাস জন্মাবে, এছাড়া একে অপরের গুণাবলী আহরণ করতে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতসমূহ দূর করার সুযোগ লাভ করবে। সর্বোপরি তারা কয়েক দিনের জনব্য হলেও নিরবচ্ছিন্ন সাংসারিক কাজ-কর্ম হতে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার জন্যই নিজেদের সমস্ত চিন্তা,লক্ষ্য এবং কর্মতৎপরতা কেন্দ্রিভূত করতে সক্ষম হবে।
এজন্য অন্ততপক্ষে প্রত্যেক জেলায় এক একটি করে ট্রেনিং কেন্দ্র স্থায়ীভাবে স্থাপন করার জন্য আমরা আন্তরিক আগ্রহ পোষণ করি। কিন্তু এ ধরনের ট্রেনিং কেন্দ্র পরিচালনার জ্য আমাদের কাছে যোগ্যতাসম্পন্ন লোক এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপায়-উপাদানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ কারণেই আপাতত লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, মূলতান ও করাচীতে সাময়িকভাবে ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও এ সামান্য ব্যবস্থা দ্বারাই আপনাদের যথেষ্ট উপকার হবে বলে আমি আশা করি। ইনশাআল্লাহ ট্রেনিং কেন্দ্রের কর্মসূচী অনুশীলনের পর নিজেরাই এর বিরাট উপাকারিতা অনুভব করতে পারবেন। তখন আপনারা বুঝতে পারবেন যে, জামায়াত যথার্থই একটি প্রয়োজনীয় কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
আমি এ কর্মসূচীর মাধ্যমে যতবেশী সম্ভব ফায়দা হাসিল করার জন্য সমস্ত কর্মীকে অনুরোধ করছি।
অতপর আমি আপনাদের সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের লোকজন সংশোধন সম্পর্কে বলতে চাই। আল্লাহ বলেছেনঃ
যে সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রী-পরিজনের অন্ন-বস্ত্রের জন্য আপনারা চিন্তা করেন, তারাও যাতে দোযখের ইন্ধনে পরিণত না হয়, সেদিকেও আপনাদের বিশেষ লক্ষ্য রাখা কর্তব্য। তাদের পরিণাম যাতে শুভ হয় এবং জান্নাতের পথেই তারা অগ্রসর হয়, সেই জন্য অপরকে সাধ্যানুসারে চেষ্টা করতে হবে। এর পরও যদি কেউ স্বেচ্ছায় ভুল পথেই অগ্রসর হয় তবে সে জন্য আপনার কোনো দায়িত্ব থাকবে না। মোটকথা, তাদের অশুভু পরিণতির ব্যাপারে আপনার যেন কোনো সহযোগিতা না থাকে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
আমার কাছে অনেক সময় অভিযোগ করা হয় যে, জামায়াতের কর্মীগণ সাধারণ মানুষের সংশোধন ও কল্যাণের জন্য যতটা চেষ্টা করেন নিজেদের পরিবার-পরিজন এবং সন্তান-সন্ততির সংশোধনের জন্য কতটা চেষ্টা করেন না। হয়তো কোনো কোনো লোকের বেলায় এ অভিযোগ সত্য হতে পারে, আবার কারোও বেলায় হয়তো বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের অবস্থা পর্যালোচনা করা আমার পক্ষে মুশকিল। এজন্যই আমি এ সম্পর্কে কয়েকটি সাধারণ নীতি বর্ণনা করতে চাই।
আমাদের একান্ত প্রিয়জনকে শান্তি ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে দেখে আমাদের চক্ষু যাতে জুড়ায় এবং প্রাণ-মন শীতল হয় সেজন্য আমাদের সকলেরই ঐকান্তিক বাসনা থাকা উচিত এবং সে জন্য আমাদের চেষ্টা ও যত্ন থাকা আবশ্যক। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেনঃ
হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী ও স্তানদের এমন গুণ বিশিষ্ট করে তোল যে, যাদের দেখে যেন আমাদের চক্ষু জুড়ায় এবং আমাদেরকে পরহেযগার লোকদের অনুগামী করে দাও। সূরা ফুরকান : ৭৪
এ ব্যাপারে জামায়াতের কর্মীদের পরষ্পরের জীবন ধারার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া আবশ্যক। তাদের কেবল আপডন-সন্তান-সন্ততিই নয় বরং কর্মীদের সন্তান-সন্ততির সংশোধনের দিকেও খেয়অল রাখা উচিত। কেননা অনেক সময় শিশুকে পিতার তুলনায় পিতার বন্ধুদের প্রভাব সহজেই গ্রহণ করতে দেখা যায়।
নিজেদের ও পরিবারস্থধ লোকজনের সংশোধন প্রচেষ্টার সাথে সাথে আপনারা সহকর্মীদের সংশোধনের দিকেও খেয়াল রাখনবেন। যারা আল্লাহর উদ্দেশ্য সত্যের কালেমাকে বুলন্দ করার জন্য একটি জামায়াতে পরিণত হয়েছে, তাদের পরষ্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সাহায্যকারী হওয়া একান্ত আবশ্যক। তাদের বুঝা দরকার যে, তাদের সংগঠন যদি নৈতিকতা ও নিয়ম-শৃংখলার দিক দিয়ে সামগ্রিকভাবে মযবুত না হয়, তবে তাদের মহান উদ্দেশ্য কিছুতেই সফল হতে পারে না। সুতরাং তাদের এ অনুভূতির ফল স্বারূপ পারষ্পরিকব দোষ-ত্রুটি সংশৌধনের কাজে সহযোগিতা করা এবং সম্মিলিতভঅবে আল্লাহ তাআলার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য একে অপরকে সাহায্য করা কর্তব্য। এটা হচ্ছে ইসলামের সামগ্রিক সংশোধন প্রচেষ্টার উপায়। আপনি যদি আমাকে আছাড় খেতে দেখেন তা ত্বরিদ্বেগে এসে আমাকে সাহায্য করবেন। আর আমি যদি আপনাকে ভুল করতে দেখি তা কখনই আমি অগ্রসর হয়ে আপনার হাত ধরবো। আমার পরিচ্ছেদে কোনো কালিমা দেখলে আপনারা তা পরিষ্কার করবেন। আমার পরিচ্ছেদ কোনো কালিমা দেখলে আপনারা তা পরিষ্কার করবেন। আর আপনাদরপোষাকে কোনো ময়লা দেখলে আপনারা তা পরিষ্কার করবেন। আর আপনাদের পোশাকে কোনো ময়লা দেখলে আমিও তা পরিষ্কার করবো। আবার যে কাজে আমার মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে আপনারা মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করবো আপনাদেরকে তা জানাব। বস্তুত বৈষায়িক ব্যাপারে পারষ্পরিক আদান-প্রদানের ফলে যেমন সামগ্রিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারেও পারষ্পরিক সহযোগিতা ও আদান-প্রদানের রীতি চালু হলে গোটা জামায়াতের নৈতিক সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
পারষ্পরিক দোষ-ত্রুটি সংশোধনের সঠিক পন্থা এই যে, কারো কোনো কাজে আপনার আপত্তি থাকলে কিংবা কারো বিরুদ্ধে আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে, সে বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে প্রথমে বিষয়টি সুষ্ঠরূপে বুঝতে চেষ্টা করবেন। পরে আপনি প্রথম অবকাশেই তার সাথে সাক্ষাত করে সেই সম্পর্কে নির্জনে আলাপ করবেন। এতেও যদি তার সংশোধন না হয় এবং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, তবে সংশিষ্ট এলাকার আমীরকে এটা জানাবেন। প্রথমে তিনি নিজেই তার সংশোধনের জন্য চেষ্টা করবেন। পরে আবশ্যক হলে জামায়াতের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। এ সময়ে মধ্যে উক্ত বিষয়ে কখনো সংশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবর্তমানে আলোচনা করা স্পষ্ট গীবত বা পরিচর্চায় পরিণত হবে। সুতরাং এটা সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করতে হবে।
নিজেদের মধ্যকার দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা দূর করার আর একটি উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে সমালোচনা। কিন্তু সমালোচনার সঠিক সীমা ও পদ্ধতি সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন না করলে এতে ভয়ানক ক্ষতির আশাংকা রয়েছে। এজন্যই আমি বিস্তারিতভাবে এর সীমা ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই।
একঃ সকল স্থানে ও সকল সময়ে আলোচনা করা চলবে না বরং বিশেষ বৈঠক আমীরে জামায়াতের প্রস্তাব কিংবা অনুমতিক্রমেই তা করা যেতে পারে।
দুইঃ সমালোচনাকারী সর্বপ্রথম। আল্লাহতাআলাকে হাযির-নযির জেনে নিজের মনের অবস্থা সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করে দেখবেন যে, তিনি সততা ও শুভাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়েই সমালোচনা করেছেন, না কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ এর মূলে সক্রিয় রয়েছে। প্রথমোক্ত অবস্থায় নিসন্দেহে সমালোচনা করা যেতে পারে, অন্যথায় কোনো প্রকার উচ্চবাক্য না করে নিজের অন্তর হতে এ কালিমা দূর করার জন্য তার সচেষ্ট হওয়া উচিত।
তিনঃ সমালোচনার ভঙ্গী ও ভাষা এমন হওয়া উচিত, যা শুনে প্রত্যেকেই বুঝতে পারবে যে, আপনি সত্যই সংশোধনের বাসনা পোষণ করেছেন।
চারঃ সমালোচনা উদ্দেশ্য কথা বলার পূর্বে আপনার অভিযোগের সমর্থনে কোনো বাস্তব প্রমাণ আছে কিনা, তা অবশ্যই ভেবে দেখবেন। অহেতুক কারো বিরুদ্ধে কথা বলা অত্যন্ত কঠিন গুনাহ,এর ফলে সামাজিক জীবনে বিশৃংখলা দেখা দেয়।
পাঁচঃ যে ব্যক্তির সমালোচনা করা হবে, তার অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সমালোচকের বক্তব্য শ্রবণ করা এবং সততার সাথে তা ভেবে দেখা কর্তব্য। অভিযোগের যে অংশ সত্য, তা অকপটে স্বীকার করা এবং যে অংশ সত্য নয় তা যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা খন্ডন করা উচিত। সমালোচনা শুনে রাগান্বিত হওয়া অহংকার ও আত্মরিকতার লক্ষণ।
ছয়ঃ সমালোচনা এবং এর জবাবের ধারা সীমাহীনভাবে চলা উচিত নয়, কেননা এতে একটি স্থায়ী বিরোধ ও কথা কাটাকাটির সূত্রপাত হতে পারে। আলোচনা শুধু উভয় পক্ষের বক্তব্য সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্তই চলতে পারে। এরপরও যদি বিষয়টির মীমাংসা না হয়, তবে আলোচনা সেখানেই স্থগিত রাখুন, যেন উভয় পক্ষ ধীরস্থীরভাবে এবং শান্ত মনে নিজেদের বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।
অতপর সে বিষয়ে যদি একান্তেই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়, তবে পরবর্তী বৈঠকে পুনারায় তা উত্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আপনাদের জামায়াতে বিরোধী বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকা এবং উক্ত সিদ্ধান্তের ফলে বিরোধের সমাপ্তি ঘটা আবশ্যক।
উল্লেখিত সীমার প্রতি লক্ষ্য রেখে যে সমালোচনা করা হবে তা শুধু কল্যাণকরই নয় জামায়াতের নিয়ম-শৃংখলা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বটে। এ ধরনের ব্যবস্থা ছাড়া কোনো সংগঠই সঠিকভাবে বেশী দূর অগ্রসর হতে পারে না। সুতরাং কাউকেও এ সমালোচনার উদ্র্ধে নয়। আমি এটাকে জামায়াতের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য একান্ত অপরিহার্য মনে করি।আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, যে দিন আমাদের জামায়াতে এ সমালোচনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে, ঠিক সেদিন হতেই আমাদের অধপতন শুরু হবে। এজন্যই আমি প্রথম হতেই প্রত্যকটি সাধারণ সম্মেলনের পরে জামায়াতের কার্যাবলী ও ব্যবস্থাপনার সমালোচনা-পর্যালোচনার জন্য রুকনদের একটি বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠান করে আসছি। এধরনের বৈঠকে সর্বপ্রথমে আমি নিজেকে সমালোচনার জন্য পেশ করি, যেন আমার বিরুদ্ধে কিংবা আমার কোনো কাজে কারো আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে তারা সকলের সামনে বিনা দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে। এটা হলে হয় আমার ভুল-ত্রুটির সংশোধন হবে নতুবা আমার জবাব শুনে অভিযোগকারী এবং তার ন্যায় অন্যান্য লোকেদেরও ভুল ধারনা দূর হবে। গত রাতে ঠিক এ ধরনেরই একটি বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে প্রকাশ্য ও অবাধ সমালোচনার দৃশ্য আপনারা সকলেই প্রত্যক্ষ্য করেছেন। আমি জেনে বিস্মিত হলাম যে, জামায়াতের যেসব কর্মী এই প্রথমবার এ ধরনের দৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তারা নাকি খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তারা কিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে এর বিচার বিশ্লেষণ করলে তাদের নিকট জামায়াতের গুরুত্ব পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পেত। এ ভূখন্ডে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া এমন কোন সংগঠন রয়েছে, যেখানে তিন-চার শত প্রতিনিধি একত্রে একস্থানে বসে কয়েক ঘন্টা যাবত এরূপ অবাধ ও প্রকাশ্য সমালোচনা করার পরও একখানা চেয়ারও ভাঙ্গে না, একটি মাথাও ফাটে না বরং বৈঠক সমাপ্ত কালে কারও মনে কতটুকু কালিমা রেখা পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না।
আর একটি বিষয়ে আমি আপনাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করার প্রয়োজন অনুভব করছি। তা এই যে, এখনও আমাদের মধ্যে আনুগত্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে। একথা যদিও সত্য যে, আমাদের বর্তমান সামাজিক পরিবেশের প্রতি লক্ষ্য করলে নিজেদেরকে অনেক সুসংবদ্ধ বলে মনে হয়। কিন্তু ইসলামের সুমহান আদর্শ ও আমাদের কঠিন দায়িত্বও কর্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করলে আমাদের বর্তমান শৃঙ্খলা ও সংগঠনকে নিতান্তই নগণ্য বলে মনে হবে।
আপনারা মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক যৎ সামান্য উপায়-উপাদান নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। অথচ ফাসেকী ও জাহেলিয়াতের কয়েক হাজার গুন অধিক শক্তি এবং কয়েক লক্ষ গুণ বেশী উপায়-উপাদানের মুকাবিলায় শুধু বাহ্যিক জীবন ব্যবস্থারই নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত ভাবধারও আমূল পরিবর্তন সাধন করাই হচ্ছে আপনাদের লক্ষ্য। কিন্তু আপনারাই হিসেব করে দেখতে পারেন, সংখ্যা-শক্তি কিংবা উপায়-উপাদানের দিক দিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে আপনাদের কোনো তুলনাই হয় না। এমতাবস্থায় আপনাদের কাছে নৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি ছাড়া আর কোন জিনিসটি আছে যার সাহায্যে প্রতিযোগিতায় সাফল্য লাভের আশা পোষণ করতে পারেন? আপনাদের সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে সমাজ মনে যদি আস্থা জন্মে এবং আপনাদের সংগঠন যদি এতখানি শক্তিশালী হয় যে, জামায়াতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ আবশ্যক বোধে একটি মাত্র ইশরায়ই প্রয়োজনীয় শক্তি সমাবেশ করতে সক্ষম হবেন ; কেবল তখনই আপনাদের মহান উদ্দেশ্য সফল হতে পারে।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীতে দীন ইসলাম বাস্তব রূপায়ণের উদ্দেশ্য গঠিত কোনো জামায়াত তার নির্বাচিত আমীরের নেক কাজে আনুগত্য করা মূলত আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (স) এরই আনুগত্যের শামিল। যে বেক্তি আল্লাহ তাআলার কাজ মনে করে এ আন্দোলনে শরীক হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার রেযামন্দির উদ্দেশ্যেই নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে আমীর নির্বাচিত করেছে, সে উক্ত আমীরের জায়েয ও সংগত আদেশ-নিষেধ পালন করে মূলত তার নয় বরং আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। মোটকথা আল্লাহ এবং তাঁর মনোনীত দীনের (জীবন ব্যবস্থার) সাথে তার যত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে, সে ততবেশী আনুগত্য পরায়ণ বলে প্রমাণিত হবে। পক্ষান্তরে এই সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতখানি পশ্চাদপদ ও দুর্বল থাকবে, আনুগত্য ও নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে সে ততখানি দুর্বল সাব্যস্ত হবে। আপনার উপর যার যতটুকু প্রভুত্ব নেই, আপনি যাকে শুধু আল্লাহ তাআলার কাজের জন্যই আমীর হিসেবে বরণ করেছেন, একজন লোকের ন্যায় নিজের অভীরুচী, পছন্দ এবং স্বার্থের বিরুদ্ধে তার নির্দেশ আপনি একান্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলবেন এতদপেক্ষা বড় কুরবানী আর কি হতে পারে? যেহেতু এ কুরবানী মূলত আল্লাহ তাআলার জন্যই করা হচ্ছে, সে জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট হতেও এর বিনিময় বিরাট পুরষ্কার পাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে কোনো ব্যক্তি যদি এ আন্দোলনের শরীক হওয়ার পরও কোনো অবস্থাতেই ছোট কাজে রাযী না হয়, আনুগত্য করাটাকে মর্যাদাহীনকর মনে করে অথবা কোনো নির্দেশের ফলে মনে মনে ক্ষুন্ন হয় এবং এতে বিরক্তি ও অস্বস্তিরোধ করে কিংবা নিজের ইচ্ছা ও স্বার্থের খেলাপ কোনো আদেশ পালনে ইতস্তত করে তবে বুঝতে হবে, সে এখনো তার ইচ্ছা-প্রবৃত্তিকে আল্লাহ তাআলার সামনে সম্পূর্ণরূপে নত করেনি এবং এখনো তার আমিত্ববোধ নিজের দাবী-দাওয়া পরিত্যাগ করেনি।
জামায়াতের সদস্যগণকে আনুগত্যের অনুরোধ জানাবার সাথে সাথে জামায়াতের নেতৃবৃন্দকে আমি হুকুম চালাবার সঠিক পন্থা শিক্ষা করার উপদেশ দিচ্ছি। যিনি জামায়াতের কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হবেন, যার অধীনে কিছু সংখ্যক লোক থাকবে, তার পক্ষে নিজেকে বড় কিছু একটা মনে করে অধস্তন সমকর্মীদের উপর অহেতুক কর্তাগিরী ফলানো কোনো মতেই সংগত নয়। তার পক্ষে কখনো প্রভুত্বের স্বাদ গ্রহণ করা উচিত নয়, বরং সহকর্মীদের সাথে নম্র ও মধুর ব্যবহার করাই তার কর্তব্য। কোনো কর্মীর মনে বিদ্রোহের ভাব ও কর্মপন্থার উপর অর্পিত না হয়, সে জন্য সর্বদা তার বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার। যুবক-বৃদ্ধ, দুর্বল-সবল, ধনী-গরীব ইতাদির ব্যাচ বিচার না করে সকলের জন্য একটা ধারা অবলম্বন করা তার পক্ষে ব্যক্তিগত অবস্থার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত এবং যে এতটুকু সুযোগ-সুবিধা লাভের যোগ্য তাকে ততটুকু সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত। জামায়াতকে তার এমনভাবে গড়ে তোলা উচিত, যেন আমীর কোন বিষয়ে উপদেশ দিলেন কিংবা আবেদন করলেন, কর্মীগণ যেন তা নির্দেশ হিসেবেই গ্রহণ করে তদানুযায়ী কাজ সম্পন্ন করে। কোনো বিষয়ে যদি আমীরের আবেদন কার্যকরী না হয় এবং বাধ্য হয়ে তিনি হুকুম দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন তবে তা দ্বারা সাংগঠনিক চেতনারই অভা¬¬ব প্রমাণিত হয়। প্রকৃতপক্ষে বেতন ভুক্ত সিপাহীদেরকেই হুকুম দিতে হয়। কিন্তু যে স্বেচ্ছা-সৈনিকরা আপন প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই সমবেত হয়েছে, আল্লাহর কাছে নিজেকে নির্বাচিত আমীরের আনুগত্যের বেলায় তাদের নির্দেশের কোনো প্রয়োজন হয় না। তাদের জন্য শুধু এটুকু ইশারাই যথেষ্ট যে, অমুক জায়গায়, অমুক কাজ সম্পাদন করে আপন প্রভুর খেদমত আনজাম দেয়ার সুযোগ তোমার উপস্থিত হয়েছে। যেদিন আপনারা দেখতে পাবেন যে, নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে যেসব তিক্ততার সৃষ্টি হয়, তার প্রায় সবগুলোই স্বাভাবিকভাবে দূরীভূত হয়েছে।
শেষ উপদেশঃ
আমার শেষ আবেদন এই যে, জামায়াতে ইসলামীর সাথে যারা সংশিষ্ট রয়েছেন-রুকুন ও মুত্তাফিক নির্বিশেষে তারা সকলে ...... আল্লাহর পথে ব্যয়ের আগ্রহ ও অভ্যাস বর্জন করুন, আল্লাহর কাজকে ব্যক্তিগত কাজের উপর প্রাধান্য দিতে থাকুন এবং এর জন্য এতখানি আগহ ও উৎসাহের সৃষ্টি করুন যে, তা যেন আপনাদেরকে নিশ্চিত মনে বসে থাকতে না দেয়। আপনি কেবলমাত্র নিজেই মুসলমান না হয়ে নিজের পকেটকেও মুসলমান করুন। একথা কখনো ভুলবেন না যে, আল্লাহর হক শুধু আপনার প্রাণ, দেহ এবং সময়ের উপরই সীমাবদ্ধ নয় বরং আপনার পকেটের উপরও তাঁর হক ও দাবী রয়েছে। এ হক আদায়ের জন্য আল্লাহর ও তাঁর রাসূল নূণ্যতম পরিমাণ নিধারণ করেছেন, কিন্তু সর্বাধিক পরিমাণ সম্পর্কে কোনো সীমা নির্দেশ করেননি। এটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব আপনার উপরই ন্যস্ত হয়েছে, এজন্য আপনার বিবেক-বুদ্ধিকে আপনি জিজ্ঞেস করুন, কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলে আপনার ধন-সম্পত্তিতে আল্লাহ তাআলার যতটুকু অধিকার রয়েছে তা আদায় করা হলো বলে আপনি মনে করতে পারবেন। এ বিষয়ে আমি কারো অবস্থা বিচার করতে পারি না। তবে একথা আমি অবশ্যই বলবো, যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, আখেরাতেও কোনো পরোয়া যাদের নেই, তাদের নিজেদের ভ্রান্ত ও বিকৃত মতবাদের প্রতিষ্ঠার জন্য যেরূপ বিরাট ত্যাগ স্বীকার করছে তা দেখে আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি আস্থাশীল ব্যক্তিদের লজ্জিত হওয় উচিত।
দীন ইসলামকে কায়েম করারা ব্যাপারে কর্মীদের যতখানি তৎপর হওয়া আবশ্যক, তাতে এখনো যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে আমি অনুভব করছি। জামায়াতের কতিপয় কর্মী নিসন্দেহে পূর্ণ নিবিষ্টিচিত্তে দায়িত্ব পালন করছে-যা দেখে স্বাভাবিকভাবেই আনন্দে হৃদয় ভরে য়ায এবং তাদের জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু অধিকাংশ কর্মীর মধ্যে এখনো তদ্রুপ আগ্রহ দেখা যায় না। ফাসেকী ও আল্লাহদ্রোহীতার প্রাধান্য এবং আল্লাহর দীনের (জীবন ব্যবস্থ) বর্তমান অসহায় অবস্থা দেখে একজন মুমিনের অন্তরের যে যাতনা ও ক্ষোভের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হওয়া উচিত তা খুব কম লোকের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে আপনার পক্ষে অন্তত ততখানি অস্থির হওয়া উচিত, নিজের অসুস্থ সন্তানকে দেখে কিংবা ঘরে আগুন লাগার আশাংকা দেকা দিলে আপনি যতখানি অস্থিরবোধ করেন। অবশ্য এ বিষয়েও একজনের কর্ম তৎপরতা ও আগ্রহ সম্পর্কে কোনো সীমা নির্দেশ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ বিষয়ে প্রত্যেকের আপন বিবেক-বুদ্ধি অনুসারেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত যে, কতখানি কাজ করার পর তার সত্য প্রীতির দায়িত্বসমূহ সুসম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করা সংগত হবে। অবশ্য আপনাদের শিক্ষার জন্য সেই সমস্ত বাতিলপন্থীদের কর্মতৎপরতার প্রতি একবার লক্ষ্য করাই যথেষ্ট হবে, যারা দুনিয়ার বুকে কোনো না কোনো বাতিল মতবাদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য অষ্পপ্রহর সংগ্রাম করছে এবং সেজন্য নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করেছে।
এখন আমি জামায়াতের বিরুদ্ধে সম্প্রতি পরিচালিত ব্যাপক প্রচার অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বরতে চাই। যুক্তিসংগত ও প্রামাণভিত্তিক মতদ্বৈততা-যার উদ্দেশ্য নিজে বুঝা ও অপরকে বুঝার সুযোগ দেয়া এবং মূলে সদুদ্দেশ্য ও সত্যপ্রীতি সক্রিয় রয়েছে-আমরা তা কখনো অপছন্দ করিনি, ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। আমরা যখন বহুবার অপরের সাথে এ ধরণের মত প্রকাশ করেছি, তখন অপরকে কেন এ অধিকার হতে আমরা বঞ্চিত করবো। কিন্তু আফসোস এই যে, আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে এ নীতি অনুসরণকারীদের সংখ্যা খুবই কম। তাদের মধ্যে অধিকাংশই আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ও অপবাদ আমদের রচনাবলীকে বিকৃত করে নিজেদের ইচ্ছামত তার ব্যাখ্যা প্রচার করেছেন। এই সমস্ত কাজ আমাদের অথবা জনসাধারণের কল্যাণের জন্য নয় বরং আমাদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের উত্তেজিত করে তোলে এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য আমরা যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, তা বানচাল করাই এসবের মূল লক্ষ্য।
মিথ্যার এ ঝড়-ঝঞ্ঝার মূলে বিভিন্ন দল বিশেষভাবে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ ও তাদের সহায্যে পুষ্ট পত্রিকাগুলো রয়েছে, কালণ এরা এ দেশে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলনকে নিজেদের জন্য বিপদজ্জনক বলে মনে করে। অপরদিকে রয়েছে পাশ্চাত্যের আল্লাহদ্রোহী ও ধর্মবিরোধী মতবাদের ধারক ও বাহক গোষ্ঠী, এদের নিকট চিন্তা ও কার্যকলাপের লাগামহীন স্বধীনতার উপর ইসলামী মত-বিশ্বাস ও নৈতিক চিরত্রের বিধি-নিষেধ অসহ্য বিবেচিত হচ্ছে। তৃতীয় দিকে রয়েছে বিভিন্ন গুমরাহ দল, তারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভবনায় অত্যন্ত শংকাবোধ করছে। কারণ তারা জানে যে, এ দেশে সত্য সত্যই ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হলে তাদের বিভ্রান্তিকর কারসাজির পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের বিরুদ্ধে আর যে দলটি রয়েছে তারা হচ্ছে কম্যুনিষ্ট। তারাও একথা ভালো করেই জানেন যে, তাদের পথে সত্যিই যদি কোনো কঠিন প্রতিবন্ধক থাকে তবে তা হচ্ছে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী। এ দলগুলোর বিরোধিতাকে অনেকটা স্বাভাবিক বলা চলে। বরঞ্চ এরা যদি আমাদের বিরোধিতা না করতো, তবে তাই আশ্চার্যজনক হতো। কারণ, মিথ্যার কদর্যতা দ্বারা সত্যকে প্রলিপ্ত করায় এদের কোনো আপত্তি নেই। কাজেই এদের এ আচরণ মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু যে বিষয়ে আমাদের বিরোধী দলের মধ্যে কিছু আলেমও শামিল রয়েছেন। আরো পরিতাপের বিষয় এই যে, মিথ্যা প্রচারে ও অপপ্রচারে এ মহান ব্যক্তিগণ তাদের গুমরাহ সহযোগীদেরও হার মানাচ্ছে। এ শেষোক্ত আঘাতটি বাস্তবিক আমাদের জন্য চরম বেদনাদায়ক। কিন্তু এর কারণ এই নয় যে, আমরা তাদের শক্তি সামর্থ দেখে শংকিত হয়েছি, বরং এজন্য যে, এসব ছাহেবানকে দীনদার ও আল্লাহভীরু বলে মনে করতাম এবং তাদের বর্তমান চেহারা দেখতে আমরা কোনো দিন প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের মনে তো এ আশাই ছিলো যে, ইসলামী বিপ্লব সাধনের এ প্রচেষ্টায় তাঁরাই অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করবেন আর আমরা শুধু তাঁদেরই পদাংক অনুসরণ করবো মাত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, তাঁরা কাম্যুনিষ্ট, হাদীস অমান্যকারী, কাদীয়ানী এবং পাশ্চাত্যের আল্লাহদোহী ও ধর্মবিরোধী মতবাদের ধারক ও বাহকদের সাথে এক সারিতে দাঁড়িয়ে তাদের কাঁধে কাধঁ মিলিয়ে আমাদের উপর আঘাত হেনেছে।
হায়! তাঁরা মুহূর্তের জন্যও যদি একথাটি ভেবে দেখতেন যে, এরূপ করার ফলে তারা কাকে ছেড়ে কাকে গ্রহণ করছেন।
যা-ই হোক, আমাদের বিরুদ্ধে যখন চারদিক হতেই আক্রমণ ও বিরোধিতা চলছে-তখন জামায়াতের কর্মীগণকে এ ব্যাপারে ও কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক বোধ করছি।
এ প্রসংগে আমার প্রথম কথা যে, আপনারা কোনো অবস্থাতেই উত্তেজিত হবেন না। নিজেদের কথা, মেজায সকল অবস্থায়ই আয়ত্বাধীন রাখবেন। যখনই উত্তেজনামূলক অবস্থা দেখা দিবে আপনারা এটাকে শয়তানের চক্রান্ত মনে করে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রর্থনা করবেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এ আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য শয়তানই এরূপ চালবাযী শুরু করেছে। সে একদিকে আমাদের বিরোধী দলকে গিয়ে উস্কানি দিচ্ছে এবং তা দ্বারা আমাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, অপরদিকে আমাদেরকে উত্তেজিত করার জন্য চেষ্টায় রত হয়েছে, যেন আমরা উত্তর-প্রত্যুত্তরে বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে পড়ি আর আমাদের একাজই যেন কোনো মতে সম্পন্ন না হয়, এটাই তার বাসনা। কারণ, আমাদের মূল লক্ষ্যবস্তুটি তার নিকট অত্যন্ত অপ্রিয়। কাজেই আমাদের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই তার চালে পড়া উচিত নয়।
দ্বিতীয়, বিভিন্ন আলেম এবং তাদের শাগরেদ ও ভক্ত-অনুরক্তদের ব্যবহারে আপনারা যতই মনক্ষুন্ন হোন না কেন, তা শুধু দুঃখ ক্ষোভ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখবেন, এটাকে কোনো মতেই ঘৃণায় পরিণত হতে দিবেন না। কতিপয় আলেমর বাড়াবাড়ির ফলে ইতিপূর্বে একদল লোক গোটা আলেম সমাজকেই নিন্দাযোগ্য সাব্যস্ত করে গালি গালাযে রত হয়েছে। কেবল এখানেই শেষ নয়, এর পরিণতিতে মূল দীনি ইলম কে পর্যন্ত নিন্দানীয় বলে প্রচার করা হয়েছে, সেরূপ ভুলের যাতে পুনাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে আপনারা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন। আপনারা স্মরণ রাখবেন যে, আল্লাহর আলেমদের অধিকাংশই সত্যনিষ্ঠ ও আদর্শবাদী। তাঁদের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ যোগ্যতম সহকর্মী আপনারা লাভ করেছেন এবং এ ধরনের কর্মীদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তৃতীয় কথা এই যে, বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করার কাজ আপনারা আমার উপরই ন্যস্ত করুন। আপনারা শুধু নিজ নিজ কর্তব্য সম্পাদন করতে থাকনু। প্রয়োজন অনুসারে আত্মরক্ষায় দায়িত্ব আমিই পালন করবো অথবা জামায়াতের দায়িত্বশীল লোকদের মাধ্যমে তা করানো হবে। আপনাদের কাজ শুধু এটা যে, কোনো প্রকার মিথ্যা অভিযোগ আপনাদের সামনে উত্থাপন করা হলে জামায়াতের পুস্তকাদি হতে তার জবাব অভিযোগকারীর সামনে পেশ করবেন। এরপরও যদি কেউ তর্ক করতে চায়, তবে তাকে সালাম জানিয়ে অন্য কাজে মনোনিবেশ করবেন। যাকে পথ চলতে হবে, তার জন্য সর্বোত্তম নীতি এটাই যে, পথের কাঁটায় পরিধানের বস্ত্র জড়িয়ে পড়লে এক মুহূর্ত সেখানে বসে না থাকে কাপড়ের সেই অংশটুকু ছিড়ে ফেলে লক্ষ্য পথে অগ্রসর হতে হবে।
চতুর্থ কথা এই যে, বিরোধিতা যতই অহেতুক হোক না কেন এর জবাবদানের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সীমা কখনো লংঘন করবেন না। প্রত্যেকটি শব্দ বলা কিংবা লেখার পূর্বে তা সত্যের পরিপন্থী কিনা এবং আল্লাহর দরবারে তার হিসেব পেশ করতে পারেবন কিনা তা আপনি উত্তমরূপে বিচার-বিবেচনা করে দেখবেন। আপনার বিরুদ্ধবাদীরা আল্লাহকে ভয় করুক কিংবা না করুক আপনাকেই ভয় করে চলতে হবে।
পঞ্চম কথাএই যে, বিরোধিতা ফলে আপনাদের আন্দোলনের জন্য সাফল্য ও অগ্রগতির যে অপূর্ব সুযোগ উপস্থিত হয়েছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করুন। আল্লাহ তাআলা এভাবে আপনার বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনারা এতে ভীত না হয়ে এ সুযোগে কাজ করে নিন। আরবে নবী করীম (স) এর বিরুদ্ধে যখন এ ধরনের অপপ্রচার চলছিলো, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে ...বলে খোশ খবর দিয়েছেন।
আমাদের উচিত শোকর আদায় করা, কারণ, একদিকে সরকার ক্রমাগত সার্কুলার জারী করে সরকারী কর্মচারীদের সাথে আমাদের পরিচয় লাভের মূল্যবান সুযোগ করে দিয়েছেন। অপরদিকে গুমরাহ দলগুলো নিজ মহলে আমাদেরকে পরিচিত করে তুলছে। এছাড়া যে সমস্ত আলেম আমাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করেছেন তাঁরাও দেশের ধর্মীয় ভাবধারাসম্পন্ন এলাকার সর্বত্র আমাদের সম্পর্কে প্রচার করেছেন। এ বিপুল প্রচার আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলে বিশ বছরেও সম্ভব হতো না। এখন আমাদের কাজ হলো যেসব জায়গায় আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার হয়েছে, সেখানে আমাদের সঠিক পরিচয় দিতে হবে। ইনশাআল্লাহ এতে আমাদের দ্বিগুণ লাভ হবে। যারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারের রহস্য উপলদ্ধি করতে পারবে, তাঁরা শুধূ জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আস্থা-ই স্থাপন করবেন না, বরং তাঁরা শুধু জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আস্থা-ই স্থাপন করবেন না, বরং তাঁদের নিকট আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারীদের বাহাদুরীও ধরা পড়ে যাবে। সত্য ও ন্যায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রত্যক্ষ্য করার পর তাঁদের মনে বিরুদ্ধাবাদীদের সম্পর্কে যে শ্রদ্ধাভাবটি রয়েছে, তাও বিলিন হয়ে যাবে। এজন্যই আল্লাহ তাআলা শয়তানের চক্রান্তকে বিশেষ দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। সে তাঁর অনুগামীদের হাতে এমন হাতিয়ার তুলে দেয়, যা সাময়িকভাবে বড়ই কার্যকরী মনে হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যবাহারকারীদের মূল শিরা-ই কেটে ফেলে। পরিশেষে আমি জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট আলেম কর্মীগণকে বলতে চাই যে, আপনারা নিজ নিজ গোত্রের আলেমগণকে বিষেষভাবে বুঝিয়ে দিন, তাঁদের সাথে ব্যক্তিগত কিংবা সংঘবদ্ধভাবে দেখা-সক্ষাত ও চিঠি-পত্র আদান-প্রদান করবেন। তাদেরকে আপনারা বুঝিয়ে বলুনঃ আপনারা যা করেছেন, তার পরিণাম চিন্তা করেছেন কি? ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে আপনাদের সাথে আধুনিক শিক্ষিত লোকদের যে বিরোধ দেখা দিয়েছিলো তার ফলে শুধু আধুনিক শিক্ষিত লোকদের যে বিরোধ দেখা দিয়েছিলো তার ফলে শুধু আপনাদের নয়, বরং ইসলামী আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে থেকে একদল যোগ্যতম ব্যক্তিকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে এবং দীনের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আকর্ষণের ফলেই তারা আপনাদের নিকটবর্তী হচ্ছে, ঠিক এ সময়েই আপনারা জামায়াতের বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান শুর উ করলেন। তাও আবার এমন ন্যাক্কারজনক পন্থায় যে, আধুনিক শিক্ষিতগণ তো দূরের কথা, আপনাদের শাগরেদগণের মনেও আপনাদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সমস্ত কার্যকলাপ দ্বারা আপনাদের কি উপকারটা হবে বলে আশা করেন। একথাতো আপনারও জানেন যে, এদেশে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন ও তা সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা অন্তত আপনাদের কাজ নয়। এ কাজ বরং আপনাদের পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষিত লোকেরাই করতে পারেন, যারা ইসলামী আদর্শ অনুসারে নিজেদের চিন্তাধারা, কার্যকলাপ ও নৈতিক চরিত্রের সংশোধন-পুনর্গঠন করেছে। আর তারাই এখন জামায়াতে ইসলামীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদের বাদ দিয়ে এ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে সক্রিয় ও শক্তিশালী ইসলামী ভাবাপন্ন কোনো দলের অস্তিত্বও আপনারা প্রমাণ করতে পারবেন না। আর আপনাদেরও তো এরূপ ক্ষমতা নেই যে, তাদের মধ্যে থেকে এমন কোনো দল আপনারা গড়ে তুলবেন। এমতবস্থায় আপনারা জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা করতে থাকলে এর পরিষ্কার অর্থ দাঁড়াবে যে, আপনারা যে কোনো ফাসেক-ফাজের ও গুমরাহ দলের নেতৃত্ব স্বচ্ছন্দে বরদাশত করতে পারেন, কিন্তু আপনাদের সহ্য হয় না কেবলমাত্র দীনদার দলের নেতৃত্ব, সত্যিই কি আপনারা এ ভূমিকা গ্রহনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন? এবং এজন্য আল্লাহর কাছে যে জবাবদিহি করতে হবে তার পরিণাম কি দাঁড়াতে পারে, তাও ভেবে দেখেছেন কি? যদি ধরেও নেয়া যায় যে, কতিপয় ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর সাথে আপনাদের মতবিরোধ রয়েছে, তবে তা নিয়ে আন্দোলন করার উপযুক্ত সময় কি এটাই? এসব মতবিরোধ কি সাক্ষাত, আলাপ-আলোচনা কিংবা অন্য কোনো উপায়ে দূর করা সম্ভব ছিলো না? এ বিষয়টা কি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, জামায়াতের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করা, প্রচারপত্র ছড়ানো এবং পুস্তিকা প্রকাশ ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। এতসব আয়োজন যদি সত্যিই অপরিহার্য ছিলো এবং আপনারা একান্তই দীনের উদ্দেশ্য এহেন মহৎ(?) কাজে ব্রতী হয়ে থাকেন, তবে জিজ্ঞেস করি, এ উদ্দেশ্য কি কেউ অপরের বক্তব্যকে বিকৃত করে এবং সে যা বলেনি তাই তার উপর চাপিয়ে দিয়ে থাকে? এবং তার রচনা দ্বারা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও কি তা আকঁড়িয়ে থাকে? আমাদের জামায়াতে বিভিন্ন দীনি মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত যেসব কর্মী রয়েছেন এই সকল কথা তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বুযর্গানদের থেকে স্পষ্পভাবে আমি বলতে চাই যে, দেওবন্দ ও মাযাহেরুল উলুমের বুযর্গান এ নিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রচার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন যে, পাক-ভারতের সর্বত্র তাঁদের শাগরেদগণ ছড়িয়ে রয়েছেন। কাজেই তাঁরা যদি কোনো ফতোয়া কিংবা প্রচারপত্র প্রকাশ করেন,তবে সমস্ত দেওবন্দী ও মাযাহেরী শাগরেদ চোখ বন্ধ করে নিছক গুরুভক্তি ও উপদলীয় বিদ্বেষ নিয়ে চারদিকে থেকে তাঁদের সুরে সুর মিলিয়ে জামায়াতের উপর হামলা চালাতে থাকবে। এমতবস্থায় তাঁদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করা এবং তাঁদেরকে একথা বুঝিয়ে বলা আপনাদেরই কর্তব্য যে, দেওবন্দ ও মাযহেরুল উলুম হতে আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা অবশ্যই হাসিল করেছি; কিন্তু ঈমান বিক্রি করতে শিখিনি। কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার পরও যদি কেউ সত্য ও ন্যায়পরায়নতার পরিবর্তে ওস্তাদ ও পীর পূজাই শিখলে এবং ইসলামী ভাবধারার পরিবর্তে উপদলীয় কোন্দলেই অভ্যস্ত হলো, তবে তাতে লাভ কি?
অতপর আমি আন্দোলনের প্রসারকল্পে আপনাদেরকে কয়েকটি পরামর্শ দিতে চাই। এ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন সম্পর্ক পূর্ণাঙ্গ অথচ সংক্ষিপ্ত একটি পাঠ্য তালিকা রচিত হয়েছে। এর সাহায্য আপনারা সহজে কাজ করতে পারেন। এতদিন জামায়াতের কর্মীদের একটি বিশেষ সমস্যা ছিলো যে, জামায়াতের পুস্তাকাদি সাংখ্যায় যথেষ্ট ছিলো না বলে সকল লোককে তা পড়ানো অত্যন্ত অসুবিধাজনক ছিলো। এছাড়া আর একটি অসুবিধা ছিলো যে, জামায়াতের পুস্তকাদির মধ্যে থেকে কোন কোন পুস্তক অধ্যয়ন করার পর একজন লোক জামায়াতে শরীক হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে-এটা নির্ধারণ করা। কিন্তু আমাদের কয়েকটি জরুরী পুস্তক প্রকাশের ফলে এ অসুবিধা দূরীভূত হয়েছে।
১. বাংলাদেশ ও জামায়াতে ইসলামী
২. জামায়াতে ইসলামীর বৈশিষ্ট্য
৩. ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি
৪. মুসলমানদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মসূচী
৫. জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী
৬. জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস
৭. ইসলামী বিপ্লবের ৭ দফা গণদাবী
কেউ যদি উক্ত পুস্তিকাসমূহ অধ্যয়ন করে, তাকে জামায়াতে শামিল হওয়ার ব্যাপারে তার মর্যীর উপরেই ছেড়ে দিন।
জামায়াতে শরীক হওয়ার পর তাকে অবশ্যই জামায়াতের ও যাবতীয় পুস্তিকাদি পাঠের পরামর্শ দিবেন। কারণ, এছাড়া তার চিন্তাধার ও নৈতিক চরিত্র উত্তমরূপে গঠিত হবে না এবং ইসলামী দৃষ্টিভংগীতে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্নমুখী সমস্যার সঠিক সমাধান কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারবে না। তবে জামায়াতে শরীক হওয়ার পূর্বে সমস্ত পুস্তক পাঠ করা কারো পক্ষে জরুরী নয়।
এতক্ষণ আমি যে সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করেছি, তার অধিকাংশই পুরুষ ও মহিলাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমি জামায়াতের মহিলা কর্মী এবং জামায়াত সম্পর্কে আগ্রহপরায়ণ মহিলাদের উদ্দেশ্য কয়েকটি কথা বিশেষভাবে আরয করতে চাই।
সর্বপ্রথম আরয এই যে, আপনারা নিজেদের জীবনকে গড়ার জন্য দীন ইসলাম সম্পর্কে যথাসাধ্য জ্ঞান লাভের চেষ্টা করুন।
আপনারা শুধু কুরআন শরীফের অর্থ বুঝে পাঠ করেই ক্ষান্ত হবেন না, বরং হাদীস এবং ফিকাহ সম্পর্কে কিছু পড়াশুনা অবশ্যই করবেন। আপনাদের শুধু দীন ইসলামের মূল বিষয়বস্তু এবং ঈমানের দাবী সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান লাভই যথেষ্ট নয়, বরং আপনাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম সম্পর্কে দীন ইসলাম কি কি নির্দেশ দিচ্ছে তাও আপনাদের জানতে হবে। আজ মুসলমান পরিবার-সমূহে যে শরীয়াত বিরোধী কার্যকলাপ প্রচলিত হয়েছে এবং জাহেলী রসম-রেওয়াজ স্থান লাভ করেছে, এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দীন ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে মহিলাদের ব্যাপক অজ্ঞতা। তাই সর্বপ্রথম নিজেদের দুর্বলতাসমূহ দূর করাই আপনাদের প্রধান কর্তব্য।
দ্বিতীয় কাজ এই যে, দীন ইসলাম সম্পর্কে আপনি যতটুকু শিক্ষালাভ করবেন, তদানুযায়ী নিজেদের বাস্তব জীবন, নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার ও সাংসারিক জীবনকে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। একজন মুসলমান মহিলার চরিত্র এতখানি মযবুত হওয়া দরকার যে, কোন জিনিসকে যদি সথ্য বলে বিশ্বাস করে, তবে তার গোটা সংসার ও পরিবার-পরিজন সকলে একযোগে বিরোধিতা করলেও যেন তার বিশ্বাস অটল থাকে। আবার যে জিনিসকে সে বাতিল বা অন্যায় বিশ্বাস করবে কারো চাপে পড়ে এটাকে সত্য বলে স্বীকার করবে না। মাতা, পিতা, স্বামী ও পরিবারের অন্যান্য গুরুজন নিশ্চয়ই শ্রদ্ধার পাত্র, তাঁদের হুকুম অবশ্যই পালন করতে হবে, তাদের সাথে অবশ্যই আদব রক্ষা করে চলতে হবে; তাদের সাথে বেয়াদবি কিংবা উচ্ছৃংখলাপূর্ণ ব্যবহার করা চলবে না। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অধিকার সকলের উর্ধে। কাজেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফারমানীর পথে চলতে কেউ নির্দেশ দিলে আপনারা পরিষ্কার ভাষায় তা অস্বীকার করবেন। তিনি আপনার পিতাই হোন কিংবা স্বামী এ ব্যাপারে কোনো প্রকার দুর্বলতার প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। বরং এর পরিণাম হিসেবে এ পার্থিব জীবনের যত ভয়ঙ্কর দেখা দিক না কেন, আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা রেখে আপনাকে তা হাসিমুখে বরদাশত করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। দীনের আনুগত্যের ব্যাপারে আপনি যতখানি দৃঢ়তা প্রকাশ করবেন, ইনশাআল্লাহ আপনার পরিবেশে ততই এর শুভ প্রভাব বিস্তারিত হবে। এবং বিভ্রান্ত পরিবারগুলোর সংস্কার সংশোধনের ও আপনি সুযোগ পাবেন। পক্ষান্তরে শরীয়ত বিরোধী রীতিনীতি এবং দাবীর সামনে আপনি যতখানি নতি স্বীকার করবেন, ইসলামের বরকত ও কল্যাণকর হতে আপনার সমাজ ও পরিবেশে ঈমান ও নৈতিক দুর্বলতার একটি জঘন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হবেন।
আপনার তৃতীয় কাজ এই যে, প্রচার ও সংশোধনমূলক কাজে সংসারের লোকজন, নিজের ভাই-বোন ও ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজনের প্রতি আপনাদের সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা যে সমস্ত মহিলাকে সন্তান-সন্ততি দান করেছেন তাঁদের তো ইতিমধ্যেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিয়েছেন। এখন তাঁরা যদি পাসের উপযোগী নম্বর লাভ না করেন, তবে অন্য কোনো জিনিসই তাঁদের ক্ষতিপূরণ করতে পারবে না; কাজেই তাঁদের নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষবস্ত হচ্ছে নিজেদের সন্তা-সন্ততি। এদেরকে দীন ও দীনি চরিত্র শিক্ষা দান করা আমাদের কর্তব্য। বিবাহিতা মহিলাদের আর একটি কর্তব্য হচ্ছে আপন স্বামীকে সৎপথ প্রদর্শন করা, স্বামী যদি সৎপথেই চলতে থাকেন, তবে এ ব্যাপারে তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করা কর্তব্য। তাছাড়া একটি বালিকা আদব-কর্ম সম্পন্ন করার পর যতটুকু সময় আপনারা বাঁচাতে পারেন, তা অন্যান্য মহিলাদের নিকট দীনের দাওয়াত পৌঁছাবার কাজে ব্যয় করবেন। আপনারা ছোট ছোট বালিকা ও অশিক্ষিত বৃদ্ধাগণকে লেখাপড়া শিখান এবং শিক্ষিতা মহিলাগণকে ইসলামী সাহিত্য পড়তে দেন। মহিলাদের জন্য নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন করে তাঁদেরকে দীনি শিক্ষার সুযোগ দিন। আপনাদের মধ্যে যদি কেউ বক্তৃতা করতে না পারেন তবে কোনো ভালো পুস্তকের অংশবিশেষ পাঠ করে শুনাবেন। মোটকথা যেভাবেই হোক না হোক কেন, নিজেদের সাধ্যশক্তি অনুসারে আপনারা কাজ করবেন এবং নিজ নিজ পরিচিত এলাকার মহিলাদের মধ্যে থেকে অজ্ঞতা কুসংস্কার দূর করার জন্য পুরোপুরি চেষ্টা করবেন। শিক্ষিত মহিলাদের উপর বর্তমান আরো একটি বিরাট দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এক হিসেবে এ কাজটির গুরুত্ব অন্যান্য সকল কাজের তুলনায় অনেক বেশী। তা এই যে, বর্তমান পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন মহিলারা যেভাবে এ দেশের সাধারণ মহিলা সমাজকে গুমরাহী, নিজ্র্জলতা এবং মানসিক ও নৈতিক উচ্ছৃংখলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং এ উদ্দেশ্যে তারা যেভাবে সরকারী উপায়-উপাদান ও সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার করে মুসলমান মহিলা সমাজকে ভ্রান্ত পথে টেনে নিচ্ছেসমগ্র শক্তি দিয়ে এর প্রতিরোধ করা।
একাজটি শুধূ পুরুষদের একক প্রচেষ্টায় সম্পন্ন হতে পারে না। কারণ, পুরুষরা যখন এ গুমরাহীর প্রতিবাদ করে, তখন নারী সমাজাকে এই বলে বিভ্রান্ত করা হয় যে, এরা তোমাদেরকে শুধু দাসী বানিয়ে রাখতে চায়। চিরকাল এর ইচ্ছা পোষণ করে আসছে যে, নারী সমাজ চার বেড়ার মধ্যে আবদ্ধ থেকে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করুক। এ আযাদীর হাওয়া যেন তাদেরকে আদৌ স্পর্শ করতে না পারে। কাজেই এ বিপদকে দূর করার জন্য মহিলা সমাজের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করা আমাদের একান্ত আবশ্যক। আল্লাহর ফযলে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষিতা ভদ্র ও আল্লাহ ভীরু মহিলাদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তাঁরা আপওয়া মার্কা বেগমদের দাঁতাভাংগা জবাব দেয়া তাদের কর্তব্য। তাদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া উচিত যে, মুসলমান মহিলা সমাজ আল্লাহ তাআলার বিধি-নিষেধের সীমালংঘন করে যে তরক্কী ও প্রগতি লাভ করতে হবে তার প্রতি লানত-শত ধিক্কার, একথা তাদের দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করা উচিত। শুধু এটাই নয়, যেসব বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহ ও রাসূলের বিধি-নিষেধ লংঘন করা আবশ্যক বলে প্রচার করা হচ্ছে, ইসলামী সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে সংঘবদ্ধভাবে এর সমাধান করেও তাদের দেখানো উচিত। এরূপ কাজের ফলে বিভ্রান্তকারী পুরুষ-নারীদের মুখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
ভূমিকা: ১৯৫১ সালের ১৩ই নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত জামায়াত ইসলামীর বার্ষিক সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে কর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বক্তৃতা। এই বইটিতে ১৮টি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক -
- নবী রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহ কে ভয় করতে, মনে প্রাণে তার প্রতি ভক্তি পোষণ করতে এবং তার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে তাকিদ দিয়েছেন।
- আমাদের সামগ্রিক জীবনরে সংস্কার সংশোধন এবং উন্নতির জন্য যাবতীয় চেষ্টা তৎপরতার মূলে অন্যান্য উদ্দেশ্যের তুলনায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আগ্রহই প্রাধান্য লাভ করাই বাঞ্চনিয়। আমাদের আন্দোলন আল্লাহ সন্তুষ্টির ভিত্তিতেই সম্পন্ন হবে।
ফজিলত
খোদার সাথে আমাদের যতখানি গভীর সম্পর্ক থাকবে আন্দোলন তত মজবুত হবে। আর সম্পর্ক যত দূর্বল হবে আন্দোলন তত দূর্বল হবে।
- এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের সঠিক জবাব না জানার কারণে অনেকে নিস্তেজ হয়ে যায়, নিজেকে অসহায় মনে করে।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের অর্থ আল্লাহর সাথে সম্পর্কের সঠিক অর্থ কোরআনে বলে দিয়েছে।
অর্থ- নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, জীবন, মৃত্যূ সবই একমাত্র রব্বুল আলামিনের জন্যই উৎসর্গকৃত। (আনফাল-১৩)
- সে সম্পুর্ণ একাগ্রতার সাথে নিজের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করে তার ইবাদত করবে।
- সকল প্রকার কাজ যদি আল্লাহর উদ্দেশ্য করে থাকে তবে সে খোদার সাথে সম্পর্ক পূর্ণ বহর। যেমন হাদিসে আছে
- দোয়া কুনুত যা আমরা নামাজের ভিতর পড়ে থাকি খোদার সাথে সম্পর্কের পরিচয় তুলে ধরে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায়
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপায় একটি আর সেটি হলো মানুষকে সর্বান্ত করনে এক ও লাশরিক আল্লাহকে নিজের এবং সমগ্র জগতের মালিক, উপাস্য এবং শাসক রুপে স্বীকার করতে হবে।
সম্পর্ক বৃদ্ধির উপায় ২টি
১. চিন্তা ও গবেষনার পন্থা
২. বাস্তব কাজের পন্থা
১) চিন্তা ও গবেষণার পন্থা
ক) পবিত্র কোরআন ও হাদিস বুঝে অধ্যয়ন করতে হবে
খ) বারবার অনুশীলন করতে হবে
গ) খোদার সাথে যেই রুপ সম্পর্ক থাকা উচিত সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে।
ঘ) কোরআন ও হাদিসের আলোকে যে সকল বিষয়ে আল্লাহর সাথে যোগসূত্র অনুভূত হবে সে বিষয়ে চিন্তা করা এই অনুভূতিই যতই ভাল হবে সম্পর্ক ততোই ভাল হবে।
ঙ) নিজের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে।
আল্লাহর সাথে আমাদের ৪টি সম্পর্ক রয়েছে যথা-
১. তিনি আমাদের মাবুদ ও আমরা তার গোলাম
২. পৃথিবীর বুকে আমরাই তার প্রতি ঈমান এনেছি
৩. আমরা ঈমান এনে তার সাথে একটি বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করেছি।
৪. আমাদেরকে তার নিকট প্রতিদিন অনুপরিমান জিনিসের জবাব দিহি করতে হবে।
২) বাস্তব কাজের পন্থা
বাস্তব কাজ বলতে বুঝায় নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করা এবং তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য অনুরুপ প্রতিটি কাজে প্রাণপাত পরিশ্রম করা।
আর নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর আনুগত্যের অর্থ হলো, কেবল অনিচ্ছায় নয় বরং স্বত:স্ফুর্ত আগ্রহ উৎসাহের সাথে গোপনে এবং প্রকাশ্যে সর্ব অবস্থায় আল্লাহর যাবতীয় নির্দেশিত কাজ সম্পন্ন করা।
আল্লাহ তায়ালার পছন্দ অনুসারে প্রত্যেকটি সৎ কাজের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় আগ্রহের সাথে আতœনিয়োগ করবে এবং তার অপছন্দনীয় প্রত্যেকটি কাজ প্রতিরোধ করতে ব্রত হবে।
আল্লাহর সম্পর্কের বিকাশ সাধনের উপায়
সালাত - ফরজ নামাজের সাথে সুন্নাত ও নফল নামাজ বেশি করে আদায় করা।
আল্লাহর জিকির - রাসূল (সা:) দোয়া ও যিকির যতখানি সম্ভব মুখস্ত করা এর শব্দের অর্থ জেনে নিয়ে তা সব সময় পড়ার চেষ্টা করা। পড়ার সময় অর্থের দিকে ল্য রাখা।
সাওম - ফরজের সাথে সাথে নফল রোজা রাখার অভ্যাস করতে হবে। তবে শর্ত হলো দান যত ুদ্রই হোকনা কেন এখলাসের সাথে করা।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক যাচাই করার উপায় -
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক যাচাই করার জন্য কাশফ কেরামতের ধ্যান-ধারনার কোন প্রয়োজন নেই। বরং নিজেই নিজের প্রাত্যহিক জীবনের প্রত্যেকটি নের হিসাব গ্রহণ করা, যে নিজের উপর খোদা প্রদত্ত যে দায়িত্ব ছিল তা যথাযথ ভাবে পূরণ হয়েছে কিনা।
আখিরাতকে অগ্রাধিকার দান -
সকল কাজে দুনিয়ার সুযোগ সুবিধার চেয়ে আখেরাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এবং প্রত্যেকটি কাজের মূল্যে আখেরাতের সাফল্য লাভের আকাংখাকেই একমাত্র ল হিসাবে গ্রহণ করতে হবে।
আখেরাতের চিন্তার লালন –
আখেরাতে চিন্তার লালন দু’ভাবে করা যায় -
১. চিন্তা ও আদর্শ মূলক
২. বাস্তব কর্মপন্থা
১) চিন্তা ও আদর্শ মূলক : অনুশীলন হলে নিয়মিত কোরআন বুঝে পড়তে হবে এবং আখেরাতের চিত্র স্মৃতিপটে ফুটিয়ে তুলতে হবে
রাসূল (সা:) এর আখিরাত সম্পর্কিত হাদিস গুলি গতির মনোনিবেস সহ অধ্যয়ন করতে হবে।
সাহাবাদের আখিরাত সম্পর্কে অনুভূতি মনের মধ্যে সর্বদা জাগ্রত রাখতে হবে।
বেশি বেশি কবর জিয়ারত করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে মনে মৃত্যু ভয় জাগে
২) বাস্তব কর্মপন্থা
যখন নিজের সামনে দুনিয়া ও আখেরাত দুটি জিনিসের হাতছানি দেয় তখন আখিরাতের পথ বেছে নিতে হবে।
যদি ভুল পথে অগ্রসর হয় এবং ভুল বুঝতে পারে তবে সাথে সাথে ফিরে আসতে হবে।
দুনিয়ার কাছে কোন কোন ক্ষেত্রে পরাজিত আর কোন কোন ক্ষেত্রে জয়ী তা মাঝে মাঝে হিসাব করে দেখাতে হবে।
এ চিন্তা থেকে বুঝা যাবে আখেরাত সম্পর্কে ধারণা বা সম্পর্ক কতখানি মজবুত আছে আর কতখানি ঘাটতি আছে এর মাধ্যমে যে, দূর্বলতা প্রকাশ পাবে তা কাটিয়ে উঠতে হবে।
অযথা অহমিকা বর্জন
অহমিকা বর্জন করা একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী একান্ত কর্তব্য। এর বিভিন্ন উপায় রয়েছে
ইসলামী সংগঠনে এসে পড়ায় বিরাট কিছু করে ফেলা হয়েছে বা বিরাট ফামিলিয়াত হাসিল হয়েছে এমন ভাবার কোন কারণ নেই।
সাহাবাদের আমলের কামিলিয়াত ও তাদের সামগ্রিক মনে রাখতে হবে। তাদের মান অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।
সর্বদা উন্নত আমল সম্পন্ন লোকেদের অনুকরন করতে হবে।
ধন সম্পদের ক্ষেত্রে গরিবদের দিকে নজর দিয়ে শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
ট্রেনিং কেন্দ্র সমূহের উপকারিতা -
ট্রেনিং কোর্সের দুটি দিক রয়েছে -
১. শিক্ষা মূলক
২. অনুশীলন মূলক
শিক্ষা মূলক : এর লক্ষ্য হলো যাতে করে শিার্থীরা অল্প সময়ে কোরআন, হাদিস, ও ফেকাহর হুকুম আহকাম ও জামায়াতের পুস্তকাদি সম্পর্কে একটি ধারণা লাভ করতে পারে এবং এর আলোকে ময়দান কেমন ভূমিকা গ্রহণ করার প্রয়োজন তা জেনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অনুশীলন মূলক কার্যক্রমের উদ্দেশ্য এর ফলে কর্মীরা কিছু সময়ের জন্য সংসারের ঝামেলা রেখে একটি ইসলামিক পরিবেশে অবস্থান করে, নিয়মানুবর্তিতা, শৃংখলা ভ্রাতৃত্ব অর্জন এবং নিজেদের যাবতীয় ভুল ত্র“টি ও দূর্বলতা গুলি দুর করার সুযোগ লাভ করবে।
পারস্পরিক সমালোচনার সঠিক পন্থা -
যেখানে সেখানে সমালোচনা না করা
সার্বিক ভাবে সমালোচনার বিষয় সম্পর্কে জানা
কল্যাণ কামনা উদ্দেশ্য থাকা
সমালোচনার ভাষ্য নরম ও মিষ্টি হওয়া
সমালোচনার পূর্বে এ সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমান থাকা।
সমালোচিত ব্যক্তির কথা ধৈর্য্যরে সাথে শুনা
যুক্তির মাধ্যমে এর জবাব দেওয়া
সমালোচনা এবং এর জবাবের ধারা সীমাহিন ভাবে চলা উচিত নয়। এর ফলে স্থায়ী বিবাদ সৃষ্টি হতে পারে।
আনুগত্য ও নিয়ম শৃংখলা সংরণ
আমাদের মধ্যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট দূর্বলতা রয়েছে। তাই আনুগত্য ও নিয়ম শৃংখলাকে সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।